প্রথম পর্বঃ রাষ্ট্র ও সমাজের পরিসর বহুবিধ সংকটে পুর্ণ, অনেকগুলি গুরুতর, মানুষ উদ্বিগ্ন। জনজীবন বিপর্যস্তের বিশেষ কারণ দ্রব্য মুল্যের আকাশ ছোঁয়ার অভিযান ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবিনতি। খবরের কাগজ প্রতিদিন এসব উত্তাপের হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে, মানুষের হতাশা ও উদ্বেগ গভীরতর হয়। সমাজের পথে পথে চলাচলকারী মানুষ বিষয়টা অবহিত। এর বাইরে বিশদে জানতে চাইলে দৃষ্টি দিতে হবে পরিস্থিতির অভ্যন্তরে।
মানুষ প্রতিদিন বাজারে হাসপাতালে নানা দপ্তরে যাওয়া-আসা করেন, তারা ভাল বলতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হলে সিট পেয়েছেন তবে থাকছেন মেসে এবং হল কর্তৃপক্ষ লা-জবাব, তাদের কাছে জবাব আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামসুল ইসলাম (যাকে হলে ডেকে নিয়ে মারধর করে কুড়ি হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং পরে আপোষ করতে বাধ্য করা হয়) এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন।
তবে সবচেয়ে বেশী ভাল বলতে পারবেন বুয়েটে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত আবরার ফাহাদ (২০১৯ সালে নিহত) ও সনির (২০০২ সালে নিহত) পরিবার। ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে টাংগাইলের মধুপুরে অনেক রাতে বাসের মধ্যে একা থাকা এক তরুণী-রুপা খাতুন -ধর্ষণের শিকার ও খুন হন। তাঁর পরিবারের কাছেও কিছু খবর আছে।
বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাবে ডেসটিনি গ্রুপ, পিকে হালদার, বেসিক ব্যাংকের বৃহৎ খেলাপীদের কাছে। ঘটনা অসংখ্য, সবগুলির বর্ণনা সম্ভব নয়। নিবন্ধের মুখ রক্ষায় এখানে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করা হল। বাস্তবে এই রাষ্ট্র ‘ঘটনার’ খনি; রপ্তানী করা গেলে মনে হয় বাংলাদেশ অনেক ধনী একটি দেশে পরিণত হতে পারত। চেতনা অবশ করা এসব ঘটনা ক্রমাগত উৎপাদন করা ও জনগণকে উপহার দেয়া প্রচলিত শাসন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সাফল্য।
ব্যাপকভাবে বিকশিত নেতিবাচক নানা সামাজিক প্রবণতা এর একটি প্রধান কারণ। অপরিমেয় অর্থলিপ্সা লোভ হানাহানি হিংসা-বিদ্বেষ নৈতিকতা ও মুল্যবোধের অবক্ষয় ক্যান্সারের ন্যায় বিস্তৃত। অর্থপাচার সন্ত্রাস লুটপাট দুবৃত্তায়ন সীমাহীন।
সমাজকে এতটা নীচতায় আবদ্ধ হতে আগে কখনও দেখা যায়নি। দৃশ্যতঃ মনে হয় বিবেক নামক বস্তুটি মৃত। সেকারণে কোন প্রকার অনুশোচনা কোথাও পরিলক্ষিত হয়না। উদ্ভুত পরিবেশ যেন ঘনীভুত হয়ে মানুষকে নির্মুল করার প্রাণপণ চেষ্টায় লিপ্ত। তাই খুব তুচ্ছ কারণে, অত্যন্ত অবলীলায় হত্যা ও খুনের মত নির্মম ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। এর আগে কেউ জানতে পারেননি যে জীবন এতটা তুচ্ছ ও মুল্যহীন।
সমাজের মধ্যেকার এক নিরব প্রক্রিয়া অজান্তে অনেককে শেষ পরিণতির সীমানায় নিয়ে যাচ্ছে, এটা রোধ করা যায়না; মনে হয় কেউ বুঝতে পারেননা না, সেজন্য কোন চেষ্টা করেন না। বিশেষভাবে হতবাক করে আত্মহত্যার ঘটনাগুলি। আত্মহনন করেন বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন (সুত্র সময়ের আলোঃ ৪/২/২০২২ উৎস বি বি এস)।
অন্যকে শেষ করার পাশাপাশি মানুষ এখন নিজেকেও শেষ করার দিকে অগ্রসর। বর্তমান দানবীয় ব্যবস্থার মনে হয় এটা চুড়ান্ত পদক্ষেপ -অনেক মানুষের নিজেকে নিজে শেষ করে দেয়া। বয়স্ক মানুষ তরুণ শিশু কিশোর গৃহবধু – অনেকেই আবেগের বশে, হয়তঃ নিরুপায় হয়ে সকল দুর্ভোগ হতে মুক্তি পেতে অনন্তের পথে ছুটছেন। বোঝা যায় তাঁদের জন্য জীবনের অন্য পথগুলি বন্ধ।
অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ,প্রচুর উন্নয়ন কর্মকান্ড তেমনই স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় ভরপুর। জীবনের জন্য অনেক পথ খুলে যাবার কথা, কিন্ত খোলেনি। রাষ্ট্র ও সমাজের এত নিষ্ঠুর ও প্রতিকারহীন একটি অবস্থানে অধঃপতিত হওয়া নিয়ে কারো উদ্বেগ নাই।
মনে হয় সবাই কেবল দর্শক, আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অভুতপুর্ব চরিত্রটি অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করছেন। ক্ষেত্রমতে কিছু কিছু ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এগুলি সমুদ্রে গোষ্পদ মাত্র, স্থায়ী বা মৌলিক কোন পরিবর্তন আনেনা। তাই ঘটনাগুলির পুনরাবৃত্তি থামেনা, কমেও না।
দরকার একেবারে গোঁড়ায় সমাধান করা। রাষ্ট্রের সংষ্কার এবং জনগণের ক্ষমতায়ন করতে হবে। তখন রাষ্টের এই মুল জায়গা হতে প্রবাহিত সঞ্জিবনী দেশের গোটা শরীরকে সুস্থ রাখবে। কাজটা কঠিন। সমাজের বিবেকবান অংশকে নিস্ক্রিয় মনে হয়। তাদের এতটা বিচ্ছিন্নতা অসমীচিন। ভীতি এর একটা কারণ হতে পারে। পরিস্থিতির নেপথ্যের কারণগুলি অনুসন্ধান করে দেখা উচিৎ। সমাধানের পথে অগ্রসর হবার আগে অবনতির কারণগুলি সঠিকরুপে চিহ্নিত হওয়া দরকার।
রাষ্ট্র সমাজ ব্যক্তি গোষ্ঠী শ্রেণী -সবার দায়-দায়িত্ব বা ব্যর্থতা নিরুপিত হওয়া প্রয়োজন। একটি সার্বিক মুল্যায়ন আবশ্যক। চলমান বাস্তবতার নিরিখে বলা যায় এরকম অনুসন্ধান আরও আগে হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু দুখঃজনকভাবে তেমন কোন পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নাই।সবার দৃষ্টি কেবল আর্থিক বিষয়াবলির দিকে; টার্গেট, কীভাবে ব্যবসাকে আরও সাবলীল করা যায়। মনে হয় দেশটা কেবল আর্থিক কারবারের জায়গা, এখানে মানুষের জীবন বা তার ভালভাবে বেঁচে থাকা কোন গুরুত্বপুর্ণ বিষয় নয়। বোঝা যায়না এসব বন্ধে আরও অনেক মৃত্যুর নজীর প্রয়োজন আছে কিনা।
আজকের এই অন্ধকার দীর্ঘ সময়ের -অন্ততঃ পঞ্চাশ বছরের ‘প্রচেষ্টার’ ফল। অনেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানে সময়ের পাত্রটি এখন পুর্ণ। সবার ঢালার কথা ছিল দুধ কিন্তু বেশীরভাগ ঢেলেছেন জল। এখন সেই জলে সবার হাবুডুবু দশা; দোষ চাপানোর কাঁধগুলি উধাও হয়ে গেছে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নিয়ে কখনো কখনো বিতর্ক ওঠে। মনে হয় এটা বুদ্ধিমানদের একটা খেলা। কিছু মানুষ নিত্য নতুন ইস্যু বানিয়ে সর্বদা খেলতে সিদ্ধহস্ত। এটা সেরকমের একটা ব্যাপার। যে ব্যবস্থা মানুষদেরতো নয়ই , শিশুদেরও টিকে থাকার উপায় সুরাহা করতে ব্যর্থ তার কার্যকারিতার প্রসংগ না তোলাই সম্মানজনক। রাষ্টীয়্র সমাজ ও অগ্রসর শ্রেণী সৃষ্ট পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না। তাঁদের ব্যর্থতা ও অবহেলা ছাড়া এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিলনা।
দ্বিতীয় পর্ব
মানুষ এসবের সমাধান চান ; তার আগে জানতে চান পরিস্থিতির দায় কার এবং কতটা। সবাই নিজের কাছে বা আলাপ চারিতায় নিজের মত করে সে দায় নির্ধারণের চেষ্টা করেন। স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই আসে রাজনীতির নাম। এখন সেই সবকিছুর নিয়ন্তা বা গুরু। ব্যবস্থাটি চরম এককেন্দ্রীক, অন্যকোন পক্ষকে কোন স্পেস দেয়না। এরা আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেয়ার মত উপযুক্ত নন।
বাস্তবে এরা অনেক ব্যস্ত, মনযোগ দেবার সময় নাই, সে স্পৃহাও নাই। অনুক্ষণ চলে মাঠের রাজনীতি লড়াই-সংগ্রাম ‘গণতন্ত্র’ চর্চা ধান্দা এবং এসবের চেয়েও অনেক বেশী আভ্যন্তরীণ কোন্দল। এরপর হাতে পাওয়া সময়টুকুতে কোন রকমে লিপ সার্ভিসটা দেন। বাকীটা সামাল দেন দলীয় ক্যাডাররা। এ অবস্থায় সমস্যার মুলে দৃষ্টি দিবেন কীভাবে। প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা আর কোন্দল ছাড়া অন্য কিছু আদৌ আছে কি না -তা নিয়ে সমাজ সন্দিহান।
দায়ী দ্বিতীয় বৃহৎ বিষয়টির নাম মৌলবাদ। প্রতিদিন দেখা হয় তাই একে সবাই চেনেন।এর সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী, বদ্ধ ও খন্ডিত চেতনা বিকৃত রাজনৈতিক ধারার সংগে মিশে সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। উভয়ের গাঁটছড়া বেশ মজবুত। ধর্মীয় মৌলবাদ প্রচলিত রাজনীতির পোষ্য। তাই তাকে দোষারোপ করার আগে বর্তমান রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করা উচিৎ।
রাজনীতি একে ছাড়া চলতে অপারগ হলে দোষ দিয়ে লাভ হবেনা। সেইজন্য মৌলবাদ মুলতঃ একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এটা প্রচলিত রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার। সংঘর্ষবহুল (টিকে থাকার প্রয়োজনে) রাজনীতির জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অনেক।
দ্বিতীয়তঃ এটি একটি শিক্ষাগত সমস্যা। বর্তমান শিক্ষা মৌলবাদকে চিনতে সাহায্য করেনা। এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় চেতনা বোধ ও প্রসারিত দৃষ্টি ভংগী নির্মাণ করেনা। বরং আশকারা দেয়। গোঁড়ামি ও অন্ধ বিশ্বাসসগুলি এর সুযোগ নেয় এবং অতঃপর অনেকের ঘাড়ে দৃঢ়ভাবে চেপে বসে। এরপর রাজনীতি বাণিজ্য সহ নানা স্বার্থ লোলুপ বিষয়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে প্রায়শঃ হানাহানির জন্ম দেয় যা কখনো কখনো মারাত্মক আকার ধারণ করে।
বোধ-বিবর্জিত শক্তির পক্ষে যা করা সম্ভব এরা তাই করে। মৌলবাদ রাজনৈতিক সামন্তদের লাঠিয়াল স্বরুপ। বল প্রয়োগে পারংগম বলে এদের খ্যাতি আছে তাই রাজনৈতিক সামন্তদের বেশ পছন্দের বিষয়। লাঠিয়াল অবশ্য আরও আছে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে, যাদের কাজ হুকুম মত রাস্তায় নেমে পড়া এবং ‘সংগ্রামকে’ সফল করা।পরিস্থিতি অনেকদুর গড়িয়েছে; সহসা নিষ্কৃতি পাওয়া যাবেনা।
অনেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করেন। এ অভিযোগ যথার্থ বলে মনে করি। মানুষ শিখে জন্মায়না.জন্মের পর বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হতে শেখে। প্রক্রিয়া সঠিক হলে অনেকের মানবিক উদার সহিষ্ঞ ও মননশীল হওয়ার কথা।
এতে পরিবেশ অনেকটা ভাল হত। অনেকে মানুষ হতেন, সমাজ আজকের এই দুর্বহ অবস্থায় নিপতিত হতনা। প্রক্রিয়া বিকৃত হওয়ায় সমাজ নিরেট বস্তুবাদী হয়ে উঠেছে, অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন এখন এর প্রধান লক্ষ্য। এর ফলে গোঁড়ায় একটা বড় রকমের সমস্যা তৈরি হয়েছে, এতে মানুষ হওয়ার উদ্দীপনা ও উপাদান কম,পয়সা কামানোর ধান্দা প্রবল। পেশা-কে বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত করতে সফল হওয়ায় শিক্ষা এখন বেশ দামী একটি বিষয়।
সবাই প্রথমে শিক্ষিত এবং কাজ না হলে পরে উচ্চ শিক্ষিত হতে চান। তা না হলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ নিয়ে দেশটা এই পঞ্চাশ বছরে অনেকটা এগিয়ে যেত। অনেক দেশ এরকমভাবে এগিয়েছে।
শিক্ষা ধারাবাহিক নিখুঁত ও সুঠাম হওয়া উচিৎ। বিদ্যমান অবস্থার কারণে এখানে সহজে কোনকিছু প্রবর্তন করা যায়না; মৌলবাদী মহল ও ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী বিপত্তি সৃষ্টি করে, চাপ আসে, বার বার পরিবর্তন বা কখনো একেবারে বাতিল করতে হয়। এরকম অস্থিরতায় শিক্ষা ডানা মেলতে পারেনা, মানুষকে বিশেষ করে মানবিক গুণাবলী ভালোমত শেখানো যায়না। এর পেছনের কারণ বাণিজ্য।
বাণিজ্যের উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন, কাউকে মানুষ করা নয়। সম্প্রতি প্রণীত শিক্ষা আইনের খসড়ায় এর ছাপ প্রকট। তাই -ব্যতিক্রম বাদে -এই প্রক্রিয়া কাউকে মানুষ করেনি। দৃশ্যমান অবস্থা মনে করায় সমাজ অমানুষে ছেয়ে গেছ। রাজনীতির পরে এর দায় বর্তায় শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে ।
প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি অতিপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু শেখায়না। যেমনঃ দেশটা সবার, তাই মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ তৈরি করা যাবেনা। রাষ্ট্র একটি সামগ্রিকতার নাম। এখানে সকলের অধিকার ও মর্যাদা সমান। আগে সবার জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলি স্থির করা দরকার। এরপর শ্রেণী বিশেষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে।
রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সকলকে আবশ্যিকভাবে ঐকবদ্ধ হতে হবে, এর বিকল্প নাই। একজন শিক্ষার্থী এমত পরিবেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলে তার সুনাগরিক হয়ে ওঠার কথা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়; কারণ তার মানসিকতা হবে সুঠাম। এই অতিদরকারী কথাগুলি শিক্ষায় অনুপস্থিত সেকারণে বৈষম্য ও বিভাজন অনেক।
ঐক্যবদ্ধ মানুষ রাষ্ট্রের একটি মৌলিক চাহিদা। এর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়াও আরো কিছু সামাজিক চর্চা দরকার। সকলকে সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করে একইমঞ্চে আনতে হবে। এটা করার আগে অগ্রসর শ্রেণীকে অনেক কিছুতে ছাড় দিয়ে উদারতা প্রদর্শন ও ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে সমতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
কিন্তু বর্তমান অবস্থা ঠিক এর বিপরীত, কেউ মুষ্টি আলগা করতে রাজী নয়। ফলে দল মত ধর্ম বর্ণ রাজনীতি পেশা আদর্শ ধনী-দরিদ্র চিন্তা-চেতনা প্রভৃতির ব্যাপক মেরুকরণে দেশটার বেহাল অবস্থা। প্রবল এই বিভাজন-তরংগে বিবেকবান সমাজ অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেছেন।
ভারতীয় ইতিহাসের মুলসুর বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। সেরকম হলে সবার মাঝে মোটামুটি একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা -বৈচিত্রের পথে হাজির বিভাজন। এর মুল সুর হল ভাগ কর এবং শাসন কর। এটি অতীতে বৃটিশদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির আদলে গড়া। এসব নিরসনে শিক্ষার কোন ভুমিকা নাই। শিক্ষা কেবল কর্পোরেটদের বেঁধে দেয়া সুরটি নিয়ম মেনে বাজিয়ে চলেছে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনীতি বাজার ও ধর্মীয় মৌলবাদ -এই ত্রয়ীর একটি যৌথ উদ্যোগ। এরা একটি সীমা বেঁধে দেয় যার উপরে ওঠা এই ব্যবস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। আদি বৈশিষ্টের কারণে এটা ভেদাভেদহীনতার শিক্ষা দেয়না, সে ক্ষমতা নাই। ভেদাভেদ পারদর্শিতায় টিকে থাকার দল অন্যদেরকে কীভাবে এর বিপরীত শিক্ষা দেবে। এরা ধর্ম বিশেষকে ছোট বড় বা বিশেষ মর্যাদা দেয়ার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। সাম্যতা বিনষ্ট করে বিধায় এই ব্যবস্থা এক প্রকার সামাজিক অবিচার।
জেনেও সবাই না-জানার ভান করেন। গোঁড়ায় মত-পথের এরুপ রেষারেষির কারণে এই ব্যবস্থার পক্ষে মানুষকে এসবের উর্ধ্বে ওঠার এবং উদার ও ঐক্যবদ্ধ হবার শিক্ষা দেয়া সম্ভব হয়না। তাই এটা বিভাজন ও সহিংসতার উৎস , শঠ ও ক্ষতিকর। দৃশ্যমান বাস্তবতার মধ্যে এর অনেক নিদর্শন আছে।
বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি রাজনৈতিক কারণে প্রথাগত অন্ধবিশ্বাসকে মাত্রাতিরিক্ত মুল্য দেয়। এটা এর বড় ত্রুটি। ফলে যুক্তিপুর্ণ ও মুক্ত চিন্তার মানুষের জন্ম হয়না। এই খরা বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য অনেকটা দায়ী। এটা গণতন্ত্র ও মানবতার তেমন কাজে লাগেনা। যার কাজে লাগে তার দৌরাত্ম দৃশ্যমান, প্রতিদিন ভোগাচ্ছে; সমাজে অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কর্মকান্ডের ছড়াছড়ি। শিক্ষায় দৃষ্টান্তের অভাবও প্রকট।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষক সমাজকে অনুসরণ করে। কিন্তু এই সমাজের মধ্যে দলাদলি আর নীচতা অনেক বেশী, অনুসরণ করতে গেলে ফল উল্টো হবার সম্ভাবনা। এভাবে শিক্ষা নামক আমাদের গোঁড়ার জায়গাটি রয়ে গেছে বিষম ত্রটিপুর। বর্তমান অবস্থা সেই ত্রুটির ফল।
দুর্নীতি সন্ত্রাস দুর্বৃত্তায়ন লুটপাট সম্পর্কে সকলে ওয়াকফিহাল। এর কারণ জবাবদিহির অভাব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শিথিলতা। আমাদের রাজনীতি বুদ্ধিমান, গোঁড়ার কাজটি করে দিয়েছে, জবাবদিহিকে খুব নীচু স্তরে একটা জায়গায় বসিয়ে রেখেছে যেন সে বেশী নড়া চড়া করতে না পারে, অন্যদের কাজে বড় কোন সমস্যা সৃষ্টি করার সুযোগ না পায়।তাই বর্তমানে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে জবাবদিহির তেমন কাজকর্ম বা গুরুত্ব নাই।
জনগণের অর্থ নানাখাতে বেসুমার ঢালা হচ্ছে,যে যতটা পারেন গোঁজামিল হিসাব দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছেন,অন্যেরা ভাগ বসাচ্ছেন সন্ত্রাসের উপায়ে; আরো নানা পথ আছে। কোথাও কোন শৃংখলা বা নিয়ন্ত্রণ নাই। প্রতিনিয়ত পাওয়া খবরগুলি চেতনাকে অবশ করে। কিন্তু বাস্তবে এর জন্য আক্ষেপ করা ও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া মানুষের আর কিছু করার নাই। আগে এসবের বিপরীতে সমাজের মুল্যবোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতকটা কার্যকর ছিল। ফলে দুর্নীতি বিশৃংখলা অরাজকতা দুরীভুত না হলেও বেশ চাপে থাকত; তাদের পক্ষে মাথাচাড়া দেয়া কঠিন ছিল।
কিন্তু এখন পরিবেশ ভিন্ন। বিকৃত আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার চাপে সমাজের মুল্যবোধ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা পিছু হঠেছে। তাই নেতিবাচক ধারাগুলি এখন চাপমুক্ত; যখন যা খুশী করতে পারে, তাদেরকে সাহায্য করার পক্ষও অনেক যাদের প্রায় সবাই প্রচলিত রাজনীতির কর্মী-সমর্থক। কেবল বাহিরের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলি চালু আছে।
তবে এদের দ্বারা স্থায়ী সমাধান ঘটেনা; ভেতরে আগুন থেকে যায় এবং সুযোগ-অবকাশ বুঝে আবার ফণা তোলে। তাই দেখা যায় অনুরুপ ঘটনা বার বার ঘটছে। মানুষ ভেবে অবাক হন, আইন-শৃংখলা কোন ফল দিচ্ছেনা কেন! ফল সহজ বিষয় নয়; উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে, ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন , সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। কেবল এরকম একটি ব্যবস্থার পক্ষে দুর্নীতি অনিয়মকে কাঠামোগতভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব । তখন সেসব দাঁড়ানোর কোন সুযোগ পাবেনা।
মুল দুর্বৃত্তের পরিমাণ বেশী নয়। এদের সংগে সুযোগ পেয়ে যুক্ত হয়েছে বহুসংখ্যক শিষ্য তাই সংখ্যাটা অনেক। এখন থামানোর জন্য দরকার গণমানুষের সম্পৃক্ততায় নির্মিত একটি উপযোগী কাঠামো। এটা হবে প্রতিরোধের মৌলিক ব্যবস্থা।
রাষ্ট্রের প্রচলিত ধারা কিছু অনুগত লোক (যাদের রাজনৈতিক নাম ‘জনগণ’) নিয়ে কাজ করে। এর বাইরে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিছু জানতে পারেন না। রাজনীতি এভাবে দুর্বত্ত-শঠদেরকে মাঠে রেখে ভাল মানুষদেরকে সরিয়েছে। সেই মাঠে আবার তাদেরকে ফেরাতে হবে। রাষ্ট্রের সংষ্কার ও জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সেখানে ফেরার পথ। জনগণ ফিরবেন তাদের নিজেদের মাঠে, সন্ত্রাসী বখাটে চোর বাঁটপার দালাল দুবৃর্ত্তদের মাঠে নয়।
তৃত্বীয় পর্ব
সবকিছু বিবেচনায় বলা যায় মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকার উপক্রম। এর বিপরীতে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তপরায়ণতার অগ্রযাত্রা নিরবচ্ছিন্ন। নানা পক্ষের লোকজনের দলবদ্ধ হয়ে ভয় দেখিয়ে বেড়ানো, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ,চাঁদাবাজী, দখল-বাণিজ্য ,‘যৌথ কারবার’ নির্মাণ, ছাত্র রাজনীতি, বাণিজ্যের নামে হরিলুট, প্রথাগত অন্ধবিশ্বাসের রাজনৈতিক উত্থান ,বাজারের অবাধ উল্লম্ফন সহ প্রক্রিয়াগত আরো নানা বিষয় এর উদাহরণ। প্রচলিত রাজনীতি এদের চলার শক্তি।
রাজনীতি কেবল শক্তিই যোগায়না ,সাহসও দেয়। বর্তমানে চাল ডাল তেল সাবান প্রভৃতির মুল্যগত উল্লম্ফন বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা ধরা পরে। তাই এই রাজনীতি সংষ্কার করা দরকার। কিন্তু সেটা করা খুব শক্ত, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা কঠিন। এরা হলেন প্রথম ভাগের দখলদার।
দ্বিতীয় ভাগে আরও অনেকে আছেন, কেউ নিয়েছেন জল মহাল কেউ নিয়েছেন বালু মহাল কেউ নিয়েছেন নদীর ঘাট বা রেলের জমি; উদাহরণ অনেক। আগে সংষ্কার করতে হবে রাষ্ট্রকে। এরপর রাজনীতি এমনিতে অনেকটা ঠিক হয়ে যাবে। কাজটা খুব কঠিন, একটি লড়াই আবশ্যক বলে মনে হয়।
সমাজে এখন দুই ধরণের সংগ্রাম চোখে পড়ে -একটি ‘ত্রয়ীর’ সংগ্রাম এবং অন্যটি এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার লড়াই। অনেকে মুখ বুঁজে অনেক ঝুঁকি নিয়ে জীবনের লড়াইটা চালিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন, কেউ কেউ বিপর্যস্ত, ক্রমাগত পিছু হঠতে হচ্ছে। অভিযোগ করার জায়গাগুলো দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের মত। এর বিপরীতে থাকা সকলে একজোট, বল প্রয়োগে সরিয়ে দেয় (যেমন দিয়েছিল ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ৬ এপ্রিল ২০১৯ -এ)। কেউ কেউ প্রতিবাদে ব্যর্থ হয়ে শেষে নিজেই সে পথ বেছে নেন।
রাষ্ট্র আইন প্রশাসন প্রভৃতি সম্পর্কে এক সীমহীন হতাশা তাঁদেরকে গ্রাস করে। প্রতিকারবিহীন এ রাষ্ট্র ও সমাজে অনেকের বাঁচার পথ রুদ্ধ। আগেই বলা হয়েছে এর শিকার প্রতিদিন গড়ে অন্ততঃ ৩৫জন। এরপর রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনার আর কী আছে।
মানুষের জন্য নতুন পথ ও প্রেরণার জায়গা প্রস্তুত করা দরকার। এই জনপদে সাধারণ মানুষ ও তাদের সমাজ স্থায়ী। তাই তাদের টিকে থাকা সহ উদ্যম স্বপ্ন ও প্রত্যাশাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে, দরকার নেতিবাচক সকল আয়োজনের পরিসমাপ্তি। এজন্য প্রয়োজন নতুন ব্যবস্থা নির্মাণ। এগুলো মানুষই করবে তবে তার আগে তাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। একটা প্লাটফরম দরকার।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পার করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকে আবেগাশ্রয়ী; নতুন প্রজন্মকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন। এরা আসছে, সবকিছু বুঝে নেবে, মেরামত করবে, আবার সবকিছু চলতে শুরু করবে স্বাভাবিক-সঠিক নিয়মে।
এগুলি অনেকটাই কেবল প্রত্যাশা, ফলাফলের ঘরে তেমন কিছু যোগ করেনা। এই দীর্ঘ জীবনে অনেক প্রত্যাশা ছিল কিন্ত কিছুই পাননি, কিছু করতেও পারেননি। এই জায়গা থেকে যৌবনের ‘অপচয়’ আর বার্ধক্যের আত্মজিজ্ঞাসাগুলি তাঁদেরকে ভিড়িয়ে দেয় নতুন এই উপকুলে। এটা মানুষের স্বভাব, স্বস্তিÍ পেতে কোথাও না কোথাও ঠাঁই নিতে হবে।
বিদ্যমান বাস্তবতা আশাবাদী হওয়ার মত নয়। কিশোর গ্যাং এর প্রক্রিয়ায় উঠে আসছে এক ভয়ংকর প্রজন্ম, সুবিস্তৃত নেশা-সামগ্রীর জালে আটক বিপুল সংখ্যক তরুণ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতাপান্বিত ও ছাত্রনামধারী একদল খুনি, পথে পথে ঘুরে বেড়ায় গোপন মৃত্যু পরওয়ানা সম্বলিত যুবকের দল, চরম হতাশাগ্রস্ত চাকুরিহীন লক্ষ লক্ষ তরুণ (এদের দলে প্রতি বছর ২০ লক্ষ করে যুক্ত হয়) স্কলারশীপের সুযোগে ইউরোপ আমেরিকায় পলায়নপর অনেক মেধাবী মুখ সবশেষে গড়ে প্রতিদিন আত্মহননের পথে যাচ্ছেন জনা পঁয়ত্রিশেক মানুষ। এদেরকে দেখতে পাননা বলেই হয়তঃ তারা এখনো আশাবাদী। সেই পুরোনো কথাটি বলতে হয় আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
সম্ভাবনা তবু শেষ হয়ে যায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মাটি কামড়ে ভগ্নদ্বীপের মত দেশটাকে ধরে আছেন।এদের সামনে সেই অর্থে কোন সুযোগ নাই। এরাই সম্ভাবনা। নতুন দেশ গড়ার জন্য এদেরকে একটা উদ্যোগ নিতে হবে। দেশটা পুরোনো ও অচল তাই তৈরি হচ্ছে এত সমস্যা ও জটিলতা। এর নাটবল্টু বদলানো দরকার। দু’একটা জিনিষ পাল্টালে মেরামত হয়। কিন্তু যখন অনেক কিছু বদলানো দরকার হয় তখন একটা নতুন জিনিষ গড়াই ভাল, দীর্ঘকালের প্রয়োজন মেটে। কাজেই দরকার একটি নতুন রাষ্ট্র কাঠামো।
চতুর্থ পর্ব
শুরু করতে হবে একেবারে গোঁড়া অর্থ্যাৎ সংবিধান থেকে। দেশটার নামের আগে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ (সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদ) বলে একটি শব্দ আছে। এর অর্থ প্রজাদের তন্ত্র বা ব্যবস্থা। কিন্তু নাগরিকগণতো রাষ্ট্রের মালিক, প্রজা নন। কাজেই এর বদল হওয়া উচিৎ। নামটা হওয়া উচিৎ ‘গণমালিকতন্ত্র’ যার অর্থ মালিকদের ব্যবস্থা। রাষ্ট্রতো আসলে এর মালিকদের তৈরী একটি ব্যবস্থা। এখন এটা কার্যতঃ মুষ্টিময়ের মালিকানায় আর বাদবাকী মানুষ তাঁদের প্রজা। বলা যায় ‘প্রজাতন্ত্র’ মানুষকে প্রজা বানানোর সুত্র। ‘গণমালিকতন্ত্র’ শব্দটির প্রতিস্থাপন জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানায় ফেরৎ আনার প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা।
অবশ্য প্রকৃত ক্ষমতায়ন ব্যতিরেকে নাম পরিবর্তনে কিছু আসে যায়না। সংবিধান ‘মালিক’ বললেও তারা প্রজাই থাকবেন,বরং চলমান বাস্তবতা স্থায়ী হলে ক্রমে নিকৃষ্টতর প্রজাতে পরিণত হবেন। নামে মালিক কাজে প্রজা এই ব্যবস্থা প্রচলিত রাজনীতির সুত্র।
অনেক মানুষের দশা প্রকৃতপক্ষে প্রজাদের চেয়েও খারাপ, ক্রীতদাসের মত। চা-বাগান পোষাক কারখানা জাহাজ ভাংগা ইয়ার্ড শুঁটকি পল্লী নদী-ভাংগা চরের মানুষ বস্তির বাসিন্দা -এদের দিকে তাকান, বুঝতে পারবেন; জীবনের মুল্য সম্মান অধিকার কিছুই নাই; কণ্ঠস্বরও অতিনিম্ন।
কিছুদিন আগে শ্রীমংগলের চা-বাগান দেখার সুযোগ হয়। কর্মরত চা-শ্রমিকদের সাথে কথা বলেছি। তাদের কাছে নিরবতা যেন হিরন্ময়, কারো কণ্ঠে পরিষ্কার উচ্চরণ শুনতে পাইনি; মনে হয় তারা যেন এক নিরব জগতের বাসিন্দা, চলেন ফেরেন নিঃশব্দে, ভুতের মত।
মানুষরুপী ভুত দেখতে হলে আপনাকে শ্রীমংগলের চা-বাগানে যেতে হবে। গত সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়া ‘অভিজ্ঞ’ লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে অধিকারের বিষয়ে জানা যাবে। সাধারণ নির্বাচনে মানুষ ‘মালিক’ নামক অধিকারটি প্রয়োগ করার সুযোগ পান। এর বাইরে রাষ্ট্রের সেবা নিতে তাদেরকে আরো অনেক জায়গায় যেতে হয়।
সেখানকার অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের কাছের বিশদ তথ্য আছে। দশা সর্বত্র একইরকম, সবখানে সমস্যা। সংবিধানের মুল কাঠামো পরিবর্তন করে গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া এগুলির নিরসন হবেনা। প্রচলিত প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল হলেও তার নেয়া উদ্যোগ অবস্থার কিছুটা হেরফের ঘটায়। তাই এইরকম প্রচেষ্টার ছাপ সর্বত্র। অর্জিত হেরফেরগুলিকে ‘সদিচ্ছা’ হিসাবে দেথানোর জন্য অনেকে মুখর,চলে মুখে মুখে মণকে মণ ফেনার বিচ্ছুরণ।
মানুষ বিরক্ত। ‘সদিচ্ছা’ গুলি প্রমাণ করে আরো বহুকিছু করা বাকী এবং করা হবেনা। সংবিধানে আছে (৭নং অনুচ্ছেদ ১নং ধারা) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু ক্ষমতার বাইরের যেসব জিনিষ বা বিষয় আছে তার মালিক কে? কথাটা পরিষ্কার নয়। হওয়া উচিৎ ছিল ‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ’, অর্থাৎ এই রাষ্ট্রটির মালিক এই দেশের জনগণ। তাহলে জনগণের সার্বিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা না হওয়া একটি বড় সমস্যা বলে মনে হয়। প্রথম দফায় প্রশ্ন মালিকানার পরের দফা সম্পদের। এরপর আর কিছু বাকী থাকে কি।
রাষ্ট্রের কাঠামো মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সর্বোচ্চ জায়গা। এটা এখন তা নয়। তবে কতটা কি তা-ও মানুষ জানেন না, কেউ তাঁকে জানায় না। কখনও কিছু ভর্তুকী বা খয়রাত দিয়ে তাকে রাষ্ট্রের ‘উপকারীতা’ বোঝানো হয়
তারা অনেকেই মালিক হওয়ার পরিবর্তে হয়েছেন উপকারভোগী। এই ছবি পাঁচ দশকের। রাষ্ট্রের হওয়া উচিৎ জনগণের সমবায়,পরিবর্তে এটি হয়েছে এলিটদের ক্লাব যাদের ক্রীড়া নৈপুণ্য বাজারে গেলে দেখা যায়। সার্বিক সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের একটি অনেক সুপরিসর ও জনসম্পৃক্ত কাঠামো প্রয়োজন। এটি হতে পারে গণপরিষদ।
প্রয়োজন সকল বিভাগে গণপরিষদের একটি করে শাখা গঠন করা, প্রতিটি ইউনিয়ন হতে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সেখানে পাঠানো, নিয়মিত সরকারের কাজকর্মের পর্যলোচনা ও মুল্যায়ন, অন্ততঃ প্রতি দুই বছরে একবার আস্থাভোটের মাধ্যমে সরকারের যোগ্যতা প্রমাণ করা।
বর্তমান সংসদ যথারীতি তার আইন প্রণয়নের কাজ করবেন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি কিন্তু তাঁর কোন দায়িত্ব বা ক্ষমতা নাই। এ এক অদ্ভুৎ বৈষম্য। অবস্থানের মান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা উচিৎ। রাষ্ট্রের একপ্রান্তেÍ
গণপরিষদ আরেক প্রান্তে রাষ্ট্রপ্রতি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সুরক্ষা সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য বিধান করবেন। সংসদ সদস্যগণকে প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বাদ দিতে হবে। অন্যথায় গণপরিষদ সদস্যগণও সেসব দাবী করতে পারে। এনিয়ে বিভ্রাট তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। গণপরিষদ সবচেয়ে বড় কাজটি সম্পাদন করবে -রাষ্ট্র, ক্ষমতা, সম্পদ, সুযোগ বা অধিকারকে দেশজুড়ে সম্প্রসারিত করবে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংগে যুক্ত হবেন, রাষ্ট্রকে অনুভব করতে, জানতে ও বুঝতে পারবেন; তাঁদের ধারণা ও চেতনা পরিবর্তিত হবে ;রাষ্ট্রের অনুকুলে সৃষ্টি হবে নতুন উদ্দীপনা ও উদ্যোগ। এভাবে ভিত্তি মজবুত হওয়ার পর রাষ্ট্রের আর ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নাই।
ইউনিয়ন প্রতিনিধিগণ গ্রাম্য সাধারণ নাগরিক বা ছোটখাট রাজনীতিবিদ। নানা বাস্তব কারণে এদের প্রতি তুল্য বিবেচনার ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। তাই অনুকুল অবস্থা সৃষ্টির জন্য বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে।
বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থা প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল নয়। এটি রুটিন কাজ, গৎবাধা নিয়মে চলে। সুবিধাভোগী মহল এই নিয়মের সুযোগগুলো নেন; জনগণের কোন উপকার নাই; তাদের মতামত পছন্দ-অপছন্দ আশা-আকাংখা -এসবও নাই। নির্বাচনের বিষয়ে যেমন প্রশ্ন, নির্বাচিতদের বিষয়েও প্রশ্ন একই রকমের। এরাও গৎবাঁধা। গৎবাঁধা বিষয়ের ওজন ও আকর্ষণ কম, রিজিডিটিও কম ফ্লেক্সিবিলিটি বেশী, যে কোন সময় বদলে যেতে পারে।
তাই ‘পরীক্ষিতদের’ সভা হওয়া স্বত্তে ও উল্টে যেতে পারে -এই আশংকায় সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদটি যুক্ত করা হয়েছে। এভাবে একটা বড় গিঁট দিয়ে আসলে কী আটকানো হল তা আয়োজনকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। এই বিধান স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মৌলিক অধিকার চর্চায় বড় বাধা ; কারো মানার কথা নয় তবু সবাই মানছেন। এতেই বোঝা যায় জনপ্রতিনিধিদের প্রকৃত অবস্থা কী।
সংবিধানের বাইরেও অনেক কিছুর সংষ্কার দরকার। যেমন বিচার বিভাগ, দুদক, তথ্য বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রভৃতি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুর্ণাংগ নয়। এখনও নির্বাহী হতে বিভাগ বিচারকদের বদলী করা হয়।
এমতাবস্থায় পেছনে সুতার টান অনুভব হওয়া স্বাভাবিক। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে বিচারক বদলীর ঘটনা সবার মনে থাকার কথা। এর অবসান ব্যতিরেকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন। স্বাধীনতার পর গত পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এসেছে, সামরিক শাসনও ছিল। বিচার না পাওয়ার বা পেতে হয়রানীর শিকার বলে অনেকের আহাজারী ছিল, এখনও আছে।
কিন্তু কেউই বিচার বিভাগের পুর্ণাংগ স্বাধীনতার জন্য কিছু করেননি। স্বাধীনতার প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর ২০০৭-২০০৮ সালে ফকরুদ্দীন আহমেদ এর তত্তাবধায়ক সরকার এটা করলেন যারা গণতন্ত্রের কেউ নন।
আমাদের জন্য কে যে ভাল আর কে যে মন্দ ঠাহর করা কঠিন। প্রচলিত রাজনীতির মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এদের ভেতরের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন; কাজ-কারবার ধর্ম স্বভাব বৈশিষ্ট উপাদান ও টিকে থাকার উপায়গুলি বিশ্লেষন করলে জবাব পাওয়া যায়। অন্তর্নিহিত সংকট বিচার বিভাগের পুর্ণাংগ স্বাধীনতার বিষয়ে তাদেরকে স্তিমিত রাখে।
বিভাগটি পুর্ণাগ স্বাধীন হলে তারাই হবেন এর প্রথম এবং সবচেয়ে বড় শিকার; রাজনীতি পরিণত হবে একটি মরা গাছে। তাই জেনে-বুঝে এই আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত আছেন। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফাইল পড়ে থাকতে থাকতে ধুলো জমে গেছে -এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে অতীতে একজন আইন মন্ত্রি (যিনি নিজেও একজন খুব বড় আইনজীবি ছিলেন) বলেছিলেন, যাননা আপনি ধুলো ঝেড়ে দিয়ে আসেন। এখন বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাদের বেশ বড় গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
সুবিধা হল এদেশে রাজনৈতিক দলগুলিকে কখনও নিজের অতীত ও জনগণের মুখোমুখি হতে হয়না। এটা তাদের অন্যতম সুরক্ষা। রাজপথের লড়াই-সংগ্রামে অনেকে প্রাণ দেন কিন্তু সংবিধানের সংগে আপোষ করা হয়না। কেউ জানেনা এই ভয়ংকর নীতির শেষ কোথায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদুক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনা, অন্যথায় পরিস্থিতি উন্নত হতো। দৃশ্যতঃ বর্তমান রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য প্রথমতঃ ক্ষমতা অতঃপর অর্থসম্পদ অর্জন। ক্ষমতা অর্জনের সুত্র ও প্রক্রিয়াগুলো মানুষ জানেন।
অর্থ সম্পদের উৎস বিষয়েও কতক ধারণা আছে। বিশেষ করে বিশাল বাজেটের বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়াগুলি তাদেরকে এই ধারণা সরবরাহ করে। তবে এর সুত্রটা তেমন পরিচিত নয়। এই সুত্রটা হল ব্যাংক। তাই ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণে রাখা ‘অবশ্য কর্তব্য’। এর জন্য হাত দিতে হবে গোঁড়ায় -বাংলাদেশ ব্যাংকে।
পাঠক খেয়াল করে থাকবেন বর্তমানে খেলাপী ঋণ প্রচুর, বিশেষ করে বড় খেলাপীদের কাছে এসব স্তুপ হয়ে আছে, কিন্তু পরিশোধের জন্য কোন চাপ বা তাড়া নাই, কেবল দীর্ঘ হচ্ছে পরিশোধের মেয়াদ। দীর্ঘসুত্রিতা ঋণের অর্থ লোপাটের পুর্বভাগ বলে অনেকে মনে করেন।
শেষ পর্যন্ত জনগণের অর্থ ফেরৎ আসবে কিনা বর্ধিত সময়-সুযোগের নীচে সে প্রশ্নটি চাপা পড়ে। এসব নানান বাহানার মধ্যে দেশে বিস্তৃত হচ্ছে একটি মজবুত ধনীক শ্রেণী। ভবিষ্যতে এরা দেশটাকে পুরোপুরি কব্জায় নিবেন। কর্পোরেট নামধারী এই শ্রেণীটির কারণে মানুষের দুর্ভোগ অন্তহীন, ভবিষ্যত পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
অর্থনীতিকে বাঁচাতে তাই ব্যাপক সংষ্কার সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পুর্ণাংগ স্বশাসন অতিদ্রুত নিশ্চিত করা দরকার। গণপরিষদ ব্যতীত অন্যেরা এই কাজ কেউ করবেন না। যে ব্যবস্থা ক্ষমতাবানদের ব্যাপক সুবিধা দেয় জনগণ ব্যতীত তা বদলানোর লোক কোথায়।
দুদকের গতিও সাবলীল নয়। এর একটি বড় কাজ প্রশাসনের কর্মচারীদের দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা। বর্তমানে প্রশাসনের অনেকে দুদকে, বিশেষ করে বড় বড় পদগুলিতে কর্মরত, কে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন। আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে (২০/০৩/২০২০) বলেন, দুদক যেন স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় এটা ষ্পষ্টতঃ আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্ত।
দেশের তথ্য ব্যবস্থা প্রায় কোন বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেনা। সুবিধামত বা ইচ্ছানুযায়ী তথ্য প্রদানের প্রবণতা লক্ষ্যণীয়।একেক বিভাগ একে রকম তথ্য দেয়, দিন শেষে সবার নির্ভরতা আন্তর্জাতিক সুত্রগুলি। উদ্ধৃতির বহর দেখে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দেয়া তথ্য সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।
প্রকৃত তথ্য ছাড়া সমস্যার প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়না ফলে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়না,মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। একটা স্বাধীন দেশের জন্য এটা অত্যন্ত বিব্রতকর। বহু ক্ষেত্রে এমন নিরন্তর অসংগতি দুটো বড় ভুমিকা পালন করে -জনগণকে শান্ত ও ক্ষমতাসীন মহল কে নিরাপদ রাখে। এসবের সমাধান দরকার।
সকল বিচ্যুতি নিরসন না হলে ছাড়া রাষ্ট্রের পথচলা সাবলীল হবেনা, রাষ্ট্র ভাল কিছু করতেও পারবেনা। এর একমাত্র সমাধান গণপরিষদ যার পক্ষে সকল সংস্থার সঠিক ও নিরাপদ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া স্বাধীন সংস্থাগুলিকে অধিক কার্যকর করতে রাষ্ট্রের একটি পৃথক বিভাগের অধীনে আনা যেতে পারে। এরা সাকুল্যে গণপরিষদের কাজে জবাবাদিহি করবেন।
সবশেষে বলা যায় রাষ্ট্রের সংষ্কার করে সকল এককেন্দ্রীকতার অবসান, রাষ্ট্রকে বেশ কয়েকটি স্বাধীন ও স্বয়ং সম্পুর্ণ ভাগে বিভক্ত করা (যেমনঃ রাষ্ট্রপতি গণপরিষদ সংসদ বিচারবিভাগ প্রশাসন পরিচালন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তথ্য নিরাপত্তা প্রভৃতি), বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা, স্বাধীন সংস্থা সমুহের ক্ষমতা ও স্বশাসন নিশ্চিতকরা, রাষ্ট্রপতিকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান। সর্বোপরি গণপরিষদের সর্বোচ্চ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের উপায়। তখন রাষ্ট্রের পথ চলা স্বচ্ছন্দ হবে, জনগণ করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিবেন। আজকের বহুল উচ্চারিত রাজনৈতিক হাদিসগুলির ঠাঁই হবে ইতিহাসের পাতায়।
মন্তব্য লিখুন