“বর্তমানে সমাজে দুটো পক্ষ বেশ শক্তিশালী -একটি চাটার দল, আপন মনে চেটে চলেছেন ক্লান্তিহীন; অন্যটি পাতার (হাত) দল তাঁদের হাতগুলি যেন সব সময় সবখানে পাতা। দু’দলই নিষ্ঠার সংগে নিজেদের ‘দায়িত্ব’ পালন করে চলেছেন। মানুষ মেনে নিয়েছে যে, কিছু দিতে হবে তাতে সম্পন্ন করা কাজে পাতা-হাতের তেমন কোন ভুমিকা থাকুক বা না থাকুক। এটা এখন সৌজন্যতা।”
মেয়াদ পুর্ণ হওয়ায় একটি প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা অর্থ তুলতে গিয়েছিলেন একজন আত্মীয়। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর কাজবাবুটি (যিনি কাজটি সমাধা করেছেন; অতঃপর এই শব্দটিই আমরা ব্যবহার করবো) বললেন, আমাদেরকে “খুশী করে কিছু দেন”। এই চাওয়া আচানক নয়, রেওয়াজ।
সবাই জানেন কাজ শেষে বাবুদেরকে কিছু দিতে হয়। এই ‘ভদ্রতাটুকু’ আপনি রক্ষা করলে ভাল, না করলে কাজবাবু আপনাকে সেটা মনে করিয়ে দেবেন, হাতও বাড়িয়ে দিতে পারেন। ইদানীং অনেক দপ্তরে এইরকম উচ্চারণের দেখা মেলে। হাত পাতার এই প্রবণতা ছোঁয়াচে রোগের মত, ক্রম বর্ধমান।
অফিস পাড়ার কাজবাবুরা হাত পাতেন। এর বাইরেও অনেকের মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে এই সংক্রমণ। ভেবে দেখলে মনে হয় চারদিকে অনেকেই কিছু পাওয়ার আশায় যেন হাত পেতে আছেন।
বর্তমানে সমাজে দুটো পক্ষ বেশ শক্তিশালী -একটি চাটার দল, আপন মনে চেটে চলেছেন ক্লান্তিহীন; অন্যটি পাতার (হাত) দল তাঁদের হাতগুলি যেন সব সময় সবখানে পাতা। দু’দলই নিষ্ঠার সংগে নিজেদের ‘দায়িত্ব’ পালন করে চলেছেন। মানুষ মেনে নিয়েছে যে, কিছু দিতে হবে তাতে সম্পন্ন করা কাজে পাতা-হাতের তেমন কোন ভুমিকা থাকুক বা না থাকুক। এটা এখন সৌজন্যতা।
একেবারে বিনে পয়সায় কিছু নিতেও আজকাল মানুষের বাধে, অসমীচিন ঠেকে। পরিস্থিতিতে পরে সাদাসিধে মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে দিয়ে দেন। অন্যরা প্রশ্ন করেন, কত লাগবে বা কত দেব। উত্তরদাতাও প্রস্তুত তার খুব বিনয় মাখানো জবাব নিয়ে- খুশী করে যা দেন। বলা অপেক্ষা রাখেনা এখানে খুশী হওয়ার অবকাশ নাই। এভাবে একটি অসভ্য প্রথা সমাজের মুখ মন্ডলে দন্ডায়মান। সবাই অসন্তুষ্ট, বিরক্ত।
‘কিছু দেন’ শব্দটি ‘ঘুষের’ বিকল্প। তবে এর আরও নাম আছে- ‘খুশী করা’ ‘খরচ দেয়া’ ‘মিষ্টি খাওয়ানো’ ইত্যাদি। কেউ কেউ ‘পাওনা’ বলেও অভিহিত করেন। আরও একটি নাম কখনও শোনা যায় ‘স্পীড মানি’। কাজের গতি বাড়ায় বলে এরুপ নামকরণ। বহুল প্রচলিত নামের তালিকায় আরো যুক্ত ‘কামাই’ ‘ইনকাম’ প্রভৃতি শব্দগুলো।
অনেক আগে আমার অফিসের একজন অন্য অফিসের একজনের কথা বলতে গিয়ে উচ্চারণ করল,স্যার ওতো বেতনের পয়সায় চলেনা,কামাই করে সংসার চালায়। বেতনের পয়সায় হাত দেয়না। এ যেন এক বিরাট কৃতিত্ব। ‘খুশী করা’ ‘খরচ দেয়া’ ‘ইনকাম’ ‘কামাই’ ‘পাওনা’ শব্দগুলি অনেকটা সামাজিকীকৃত। সততঃ ব্যবহার হয় এবং কাজও হয়।
কেন কিছু দিতে হয় -তার কোন সরল জবাব নাই। তবে বিদ্যমান বাস্তবতার ভেতরে এর কারণ খোঁজা যেতে পারে। যুগটা কম্পিউটার-ইন্টারনেটের, কাগজ-কলমের দরকার কম। এই পরিস্থিতি কাজ বাবুদের ভুমিকা খর্ব করেছে।
আগে কাজ সম্পাদন করে কোথাও পাঠাতে হলে ডাকযোগে বা বাহক মারফতে প্রেরণ করা হত। প্রয়োজন হত তদবির তোষামোদ ও খরচের। এখন কম্পিউটারে ক্লিক করলেই হয়। এটাও কমিয়ে দিয়েছে কাজবাবুদের সাবেকী ভুমিকা। আগে তারা ছিলেন কাজ-কারবারের মাঝখানে,দখলী স্বত্তে¡।
এখন অবস্থান অনেকটা প্রান্তিক। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির প্রচলন সময় ও ব্যয় কমাল তবে অন্য সমস্যাগুলি তেমন গেলনা। কারণ বিগত কয়েক দশক ব্যাপী জলঘোলা করার যে সংষ্কৃতি কাজবাবুদের মাঝে গড়ে উঠেছে, যে জটিলতা ধীর গতি ও অজুহাত ছিল ‘কিছু নেয়ার’ প্রধান হাতিয়ার তাকে বদলানোর কোন ব্যবস্থা কম্পিউটারে নাই। এর ফলে কাজের অবস্থা আর কাজবাবুদের অবস্থার মধ্যে তৈরি হয় বড় ব্যবধান; তৈরি হয় অনলাইনের সংগে বাবুদের মন লাইনের দ্ব›দ্ব। ‘রস’হীন কাজে তারা অভ্যস্ত নন। এর একটা বিহিত দরকার।
তথ্যপ্রযুক্তি কাগজ-কলমের মত তাঁদের ওপরে নির্ভরশীল নয়। বিপাকে পড়ে আবিষ্কার করা হল এই নতুন পন্থাটি যার প্রধান উপাদান লজ্জাহীনতা হাত পাতা ও খুশী করা। এই তিন গুণী আগের তিনটির(তদবির তোষামোদ ও খরচ) স্থলাভিসিক্ত হলেন। এখন এরাই চালিয়ে নিচ্ছেন। ঘুষের বিষয়টা সেবা দাতাদের কাছে আগে ছিল ‘অধিকার’, সবকিছুর মাঝখানে বসে তার চর্চা চলত।
এখন বদলে গিয়ে হল অনুদান, প্রান্তে সরে যাওয়ায় হাত পাততে হয়। এতে মান কমল, কমল সম্মানও। মান-সম্মান না থাকলে আর লজ্জা রেখে লাভ কি। তাই উচ্চারণটা দাঁড়াল ‘খুশী করে কিছু দেন’। দ্রæতগতির তথ্যপ্রযুক্তি দ্রুত গতিতেই সমাজকে এই পরিবর্তনটা এনে দেয়। এখন সবাই সব কাজে অনিচ্ছা ভরে কতকটা নির্বিবাদে ‘কিছু দেন’ ও ‘খুশী করেন’।
এটা গেল সমস্যার বাহিরের দিক। হাতপাতার ভেতরের রসায়নটা কী! প্রায়শঃ শোনা যায় দেশে টাকার অভাব নাই। কথাটা সত্য। ইদানীং রাষ্ট্র প্রচুর অর্থ উৎপাদন ও বিতরণ করে। প্রকল্পগুলো এই সত্যের স্মারক। কিন্তু সবাই আশানুরুপভাবে বা প্রয়োজন অনুযায়ী পায়না।এতে বৈষম্য বাড়ছে, অর্থনীতিবিদেরা উদ্বিগ্ন।
‘বৈষম্য বাড়ছে’ কথাটা ছোট কিন্তু এর অর্থ অনেক; একটি হল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সম্পদগত ব্যবধানের বৃদ্ধি। কিছু মানুষের হাতে আসছে বিপুল অর্থসম্পদ অন্যদিকে অধিকাংশের হাতে যাচ্ছে সামান্যই; বাড়ছে বৈষম্য। একই পরিসরে সবার বাস, চলাফেরা, হাট-বাজার করা। সবার প্রয়োজন-প্রত্যাশা কমবেশী একই, অবশ্য শ্রেণীভেদে তারতম্য আছে।
বিশেষ কতক ক্ষেত্রে (যেমনঃ চিকিৎসা, শিক্ষা) কোন ফারাক নাই, সবাইকে সমান কড়ি গুণতে হয়। তাই লভ্যতার সংকট দ্বিতীয় শ্রেণীটির মাঝে প্রাপ্তির আকাংখার পাশাপাশি তৈরি করেছে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ।
অতি সম্পদের কারণে একদল চলেন হেলে দুলে, জাঁক-জমক ও অতি আয়েশে; বিপরীতে অন্যদেরকে চলতে হয় টেনে টুনে ,হাঁটাহাটি খাটাখটি করে। বিষয়টা দৃষ্টিকটু ও নিপীড়নমুলক। মানুষের স্বভাব আয়েশে চলার। তাই কম-পাওয়াদের মাঝে বিকল্প চেষ্টার প্রচলন স্বাভাবিক। এই পথ ধরে আসে পরবর্তীর ব্যবস্থাটি -দুর্নীতি ও অনিয়ম। সমাজ ভরে গেছে দ্বিতীয়টির বিস্তারে। নতুন সব কৌশল দেখে সবাই হতাশ।
হাত পাতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের কারণে নয়। বিপুলাংশের কারণ বিকৃত সংষ্কৃতি -আধুনিক হওয়া,বাজারে-সামাজিকতার হাল ধরা, উপরে ওঠা-এসব। বাজার অনুক্ষণ পেছনে উস্কানী দিচ্ছে, সর্বদা বলছে, এটা নয় ওটা। এসবের চাপে হাতপাতার ব্যাপারটা যেন স্বাভাবিকে পরিণত, কেউ লজ্জা পায়না। পুঁজিবাদের চরম বিকাশের যুগ ,টাকাই মুখ্য নির্ধারক তাই যেভাবেই হোক সেটা হাতে পেলেই হল। লজ্জা আবশ্যিক নয় বরং তাতে ক্ষতি। এতে দাতারাই লজ্জিত হন,কম দিলে বা দিতে না পারলে কাঁচুমাচু করেন।
ব্যক্তির কথা হল, এবার রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। রাষ্ট্র বিপদ আরও বেশী। তার উপরে সবার চাপ , বিশেষ করে নিম্ন বর্গের মানুষের। বিভিন্ন কোম্পানীর মাধ্যমে অনেককে নিয়োগ করা হয়েছে; বেতনের পয়সায় এদের চলেনা।
সম্প্রতি পণ্য মুল্য বেড়ে যাওয়ায় দশা আরও বেহাল। এদের জন্য হাত পাতার একটা বিকল্প দেখানতো। এরা প্রতিষ্ঠানের কর্মী নন, নেয়া হয়েছে কোম্পানী থেকে, বেতনও দেয় কোম্পানীই। তবে সেবা দেন রাষ্ট্রকে। এরা অনেকটা দল ছাড়া বানরের মত। একটা সভ্য নামও আছে- আউট সোর্সিং, মানে বাইরে থেকে আনা।
আউট সোর্সিং করা হল কেন! বিধিবদ্ধভাবে নিলে বেতন-ভাতা খাতে খরচ হয় অনেক বেশি, রাজনৈতিক নষ্টামি ও ট্রেড ইউনিয়ন নামক বিশংখলা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। এরকম এক অবস্থার কারণে ৮০র দশকের গোঁড়ায় প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রের ৮০ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছিলেন কলমের এক খোঁচায়।
সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয় একটি সরকারী ব্যাংকের এক শীর্ষ ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে যিনি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি জেলেই মারা যান। বাইরে থেকে সবটা বোঝা যায়নি তবে ভেতরে তুষের আগুন ছিলই। ক্রমে বিশৃংখলা বিস্তৃত হয়, নিয়মিত কর্মী নিয়োগে ঝামেলা ও খরচ অটুট, দীর্ঘ হতে থাকে বেকারত্ব ও ভুখা মুখের মিছিল তাই প্রয়োজন হয় একটা বিকল্পের।
অতঃপর ধনন্তরির মত আবির্ভুত হয় আউট সোর্সিং। এতে কাজ মোটামুটি হল; অনেককে থামানো গেল, কর্মী পাওয়া গেল সস্তায় আর কোন দায়ও মাথায় চাপল না ;দায় রইল সরবরাহকারী কোম্পানীর কাঁধে। প্রকৃতপক্ষে আউট সোর্সিং হল দায় এড়ানো ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করার একটি কৌশল।
রাষ্ট্রের করণীয় ছিল সকল কর্মক্ষম মানুষের জন্য উপযুক্ত কর্ম ও মজুরীর ব্যবস্থা করা এবং সেই সংগে মান সম্মত জীবনের বিহিত করা ; সম্ভব হয়নি। এখনকার আউট সোর্সিং সেই ব্যর্থতার আড়াল। এরা হাত পাতবে না তো কে পাতবে। সমস্যা তাই একদিকে কমল আরেকদিকে বাড়ল। কয়েকদিন আগে একটি সেবা দাতা প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মী এলেন বাসার একটা জরুরী কাজ করতে। কাজ শেষে বললেন,আমাদের পাওনাটা দিয়ে দেন। আমরাতো কর্মচারী না, এমনিতে কাজ করি। কে যে বৈষম্যের স্রষ্টা আর কে যে নিরসনকারী তার মিমাংসা দুরহ। ব্যবস্থাটা যদি হাত-পাতা মানুষের সরবরাহকারী হয় তবেতো সমাজে এদেরই চাপ বেশী হওয়ার কথা।
আগেকার দিনে পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিলনা। গ্রামের বাড়ীতে কিছু না কিছু জমিজমা থাকত,উৎপাদন ব্যবস্থা সরল ছিল,ফসলের বাজার ছিল। সাদামাটা জীবন, টু বাই টু কাপড়ের কফ শার্ট আর লংক্লথ কাপড়ের পাজামা -সবমিলিয়ে চলে যেত একজন কর্মীর জীবন। এখন সব উল্টো -সবকিছু কঠিন, সবই প্রতিযোগীতাপুর্ণ। বাজারের নিয়মে সাদামাটা জীবন খেই পায়না। তাল সামলাতে কর্মীরা ঢুকে পড়লেন অনিয়ম-দুর্নীতির অন্ধকার গলিতে। চর্চা ক্রমে বিস্তৃত হয়েছে ; থামানো যায়নি, কমানোও যায়নি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় হুংকার কাজে আসেনি; আসবে কীভাবে আসল জায়গায়তো কেউ হাত দেননা। বেতন ভাতা বেড়েছে তার চেয়ে বেশী বেড়েছে পণ্যমুল্য। টাকা আগে যেখানে যেত এখনও সেখানেই যায়, কর্মীদের হাতে শুধু বর্ধিত হিসাব। হুংকারের প্রাপকদের দিকে হাত বাড়ানোর লোক দেশে নাই।
২০১৫ সালে এসে বেতন ভাতা অনেকটা বাড়লে সবাই খুশী হলেন -এতে স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন সম্ভব। কিন্তু এখন দশা কী? বাজারকে নিয়ন্ত্রণ না করা পর্যন্ত সবচেষ্টা ষোল আনাই মিছে। রাষ্ট্র এটা করতে ব্যর্থ বলেই দুর্নীতি কমেনা, আবির্ভুত হয় নতুন কৌশল। সেসব কৌশল দমনেও রাষ্ট্র ব্যর্থ। তাই কাজবাবুদের হাতপাতা বন্ধ হয়না।
অরিজিনাল ইমেইজ সোর্স – Dhakpost.com
মন্তব্য লিখুন