বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি লাভ করতে গেলেই সাধারণত ন্যুনতম অনার্স পাশ করতে হয়। একমাত্র সামরিক বাহিনীতে এইচ.এস.সি পাশের পর অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করা হয়। বন্ধুমহলের মধ্যে সবচেয়ে আগে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সৌভাগ্য একমাত্র তাদেরই হয়। ধারাবাহিকভাবে ২ পর্বের মাধ্যমে কথা বলবো সামরিক বাহিনীতে যোগদান এর একদম খুঁটি-নাটি নিয়ে।শুরু করছি প্রথম পর্ব।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
সামরিক বাহিনী বলতে মূলত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে বোঝায়। একটি দেশের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীই সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সামরিক বাহিনী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং বর্তমান সময়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সচেষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।
ইন্টারমিডিয়েট বা এইচ.এস.সি পাশ করার পর সামরিক বাহিনীত অর্থাৎ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মজার ব্যপার হলো, সামরিক বাহিনীতে চাকরি এর নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব স্বচ্ছ, কঠিন, গুণগত মানসম্পন্ন এবং ফলপ্রসূ। অন্য সব সরকারি চাকরিতে যেমন আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়, সামরিক বাহিনীতে চাকরি -তে সেরকম কিছু নেই। সবগুলো পরীক্ষা পাশ করতে পারলে যত জন যোগ্য প্রার্থী টিকবে, সবাইকেই তাঁরা নিবে। আবার, তাঁদের মানদন্ডের পরীক্ষায় যদি শেষ পর্যন্ত কেউ না টিকে তাহলে তারা কাওকেই নিবেনা। ব্যপারটা এরকম।
সামরিক বাহিনীর পরীক্ষাগুলো মূলত ৪ টি ধাপে হয়ে থাকে-
এছাড়া শুধুমাত্র নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে আরেকটি অতিরিক্ত ধাপ “CNS Viva” নেওয়া হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বয়ং মাননীয় নৌবাহিনী প্রধান এই ভাইবা নিয়ে থাকেন। সাধারণত উপরের ৪ টি ধাপ অতিক্রম করলে এই ধাপে খুব সহজে কেউ বাদ পড়েনা।
৪ টি ধাপের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন, দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ৩ নম্বর ধাপ ISSB (Inter Service Selection Board). অফিসার ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, না হওয়ার বড় একটি ফ্যাক্টর হিসেবে এই ISSB কাজ করে। আজকের পর্বে ১, ২ ও ৪ নম্বর ধাপ নিয়ে আলোচনা করবো। ৩ নম্বর ধাপের বিস্তারিত আলোচনা পরের পর্বে করা হবে।
সেনা, নৌ, বিমান প্রত্যেকটি বাহিনীতেই মোটামোটি একই প্যাটার্ন ফলো করে এই ধাপটি সম্পন্ন করা হয়। সার্কুলার প্রকাশ করা হলে একটা নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়।
আবেদনকারীদের নির্দিষ্ট দিনে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সহ উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই ফর্মাল ড্রেসে যাওয়া বাধ্যতামূলক।সাথে চুল ছোট রাখতে হবে।দাড়ি না রাখলে ক্লিন শেভ বাধ্যতামূলক। মনে রাখতে হবে, আপনি একটি সরকারি প্রথম শ্রেণির চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। আপনার আচরণের মধ্যে দিয়ে সেটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
প্রাথমিক মৌখিক পরীক্ষা ও মেডিকেল টেস্ট একই দিনে হবে। সাধারণত মেডিকেল টেস্ট চলতে থাকা অবস্থায় ভাইবা শুরু হয়ে যায়।আমি ২০১৯-এ ব্যাচে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে আবেদন করেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতাটা হুবহু শেয়ার করছি।
মেডিকেল টেস্টের জন্য বড় হলঘরে একত্রিত করা হবে। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। সবাইকে লাইন দিয়ে দাড়াতে হবে। সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক মেডিকেল টেস্ট সাধারণত বেশি ডিপ হয়না। Knock knee (Search at google for details), কালার ব্লাইন্ড, হাইট সার্কুলারে উল্লেখ করা স্বাভাবিকের থেকে কম, ওজন অতিরিক্ত বেশি বা কম, নাকে, কানে সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি দেখা হয়।
আরও পড়ুনঃ যে ১৪ টি বিষয় আপনাকে চাকরীর বাজার -এ এগিয়ে রাখবে
চেক করার সময় মেডিকেল এসিসট্যান্টরা সাধারণত ডাক্তারের সাথে থাকবে। “নক নি” এর ব্যপারটা খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে। ইন্টারনেট, ইউটিউবে বিস্তারিত জানতে পারবেন। নক নি এর সমস্যা থাকলে কোলবালিশ ব্যবহার করে ঠিক করা যাবে।
আমার মেডিকেল টেস্টের সময় আন্ডারওয়্যার বাদে সম্পূর্ণ বস্ত্র খুলে ফেলতে হয়েছিলো।এজন্য সাজেশন থাকবে শরীরের অবাঞ্চিত স্থানের লোম পরিস্কার করে যাওয়ার। মেডিকেল টেস্টের সময় একজন আন্ডারওয়্যার পড়ে না যাওয়াতে তাকে তিরস্কার করা হয়েছিলো। মাথায় রাখতে হবে বিষয়টা।
প্রাথমিক মেডিকেল শেষ হলে সবাইকে ওয়েট করতে বলা হবে। সাধারণত নাবিক পদে পরীক্ষা দিতে গেলে মাঠেই রোদের ভিতর অপেক্ষায় রাখা হয়। অন্যান্য বাহিনীতে কি করে জানি না তবে নৌবাহিনীতে মিরপুর ১৪ তে অবস্থিত নেভি কলেজের শহীদ মোয়াজ্জেম অডিটোরিয়ামের এসি রুমের ভিতর অপেক্ষা করতে দেয় অফিসার ক্যাডেটে আবেদনকারীদের। আপনি মেডিকেল টেস্টে ফিট না আনফিট সাথে সাথেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত বেয়াদপি না করলে, মেজর কোনো সমস্যা না থাকলে প্রাইমারি মেডিকেল টেস্ট থেকে কেউ বাদ পড়েনা বললেই চলে।
এরপর আসবে ভাইবা। এই ধাপটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনি লাইনে দাড়িয়ে বা বসে অপেক্ষা করতে থাকবেন, আপনার সামনে দিয়ে অনেক ক্যান্ডিডেট হেঁটে বের হবে। কেউ হাসি মুখে, কেউ বা মলিন মুখে! কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, এটা জানতে চাইবেন না কখনো কম্পাউন্ডারের কাছে। আপনি একজন হবু অফিসার ক্যাডেট। ধৈর্য্য আপনার প্রথম গুণ হওয়া চাই। আমি রোজা রেখে সকাল ৯ টা থেকে ইফতারির ৪৫ মিনিট আগে পর্যন্ত লাইনে ছিলাম, কারণ আমার ভাইবা একদম লাস্ট স্টেজে হয়েছিলো, আমার পর মাত্র ২ জন ভাইবা দিয়েছিলো আর।
ভাইবা বোর্ডে সাধারণত সেনাবহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদমর্যাদার অফিসার থাকে। আমার নৌবাহিনীর ভাইবার সময় লেফটেন্যান্ট কমান্ডার স্যার ছিলেন।আপনার ভাইবা একজন অফিসার ও নিতে পারে, কয়েকজন মিলেও নিতে পারে। বোর্ডের উপর ডিপেন্ড করবে পুরাটা। আমাদের সময় আলাদা আলাদা টেবিলে ৩ জন স্যার ছিলেন,৩ জন আলাদা আলাদাভাবে ভাইবা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
ভাইবার জন্য আলাদা প্রস্তুতি রাখা উচিত।ভাইবায় মূলত আপনার Attitude, আপনার বাচনভঙ্গি,দেশ ও বিশ্ব সম্পর্কে আপনার ধারণা, আপনি কেনো সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে চান, আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন, ৩ বাহিনী প্রধানের নাম, অফিসার ক্যাডেট হিসেবে জয়েনের পর অধঃক্রম থেকে উর্ধ্বক্রমে পদমর্যাদা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হয়।
আপনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হলে সে সম্পর্কে এবং আপনার বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারে। গুছিয়ে উত্তর দিন। আই কন্টাক্ট ঠিক রাখুন। কথা বলার সময় আমতা আমতা করা যাবেনা। কোনো কিছু না পারলে “সরি স্যার” সোজাসোজি বলতে হবে।
ভাইবায় ইংরেজি দক্ষতা যাচাই করা হয়। এজন্য “Introduce yourself” টপিকটা ভালোমত আয়ত্ত্ব করে যেতে হবে। অবশ্যই সার্কুলারে বলা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট গুলো স্বচ্ছ ফাইলে গুছিয়ে নিতে হবে। আর পরিপাটি হয়ে, চুল ছোট করে, ক্লিন শেভ করে ফর্মাল লুক নিয়ে ভাইবা ফেস করতে হবে। চেয়ারে বসা অবস্থায় হাত কখনোই টেবিলে রাখা যাবেনা। আর হ্যাঁ, বোর্ডে প্রবেশের সময় অবশ্যই সালাম দিয়ে ঢুকতে হবে।
আমার ভাইবা শেষ দিকে হওয়াতে বেশি বড় হয়নি। ১০ মিনিটের মত ভাইবা হয়েছিলো। আমাকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন স্যার-
এরপর স্যার কি একটা সিল মেরে দিয়েছিলেন ডকুমেন্টস এ। সম্ভবত Approved বা এরকম কিছু লেখা ছিল। আমার পরের জন কোয়ালিফাই করতে পারেনি। তার ভাষ্য ছিল তার অনার্সের সাবজেক্ট বাংলা শুনে নাকি তাকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, আমি তার সাথে একমত হতে পারেনি।
সাবজেক্ট সম্পর্কে অফিসাররা আপনাকে বিব্রত করতেই পারে।আপনি কতটা গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছেন, আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কে তাঁদের মনে কতটা পজিটিভিটি সৃষ্টি করতে পারছেন এটাই মুখ্য। আবারও বলছি, আপনার প্রাথমিক ব্যবহার, কথা বলার স্টাইল এসব ই দেখে থাকে ভাইবা বোর্ডে। আর হ্যাঁ, বের হওয়ার সময় মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে, সালাম দিয়ে বের হবেন।
ভাইবার পর সম্ভবত ১ সপ্তাহ পর ই লিখিত পরীক্ষা হয়েছিলো। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই চলবে আপনাকে। এক এক বাহিনীর লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস এক এক রকম। কোনো একটা পুরাতন গাইড কিনে সিলেবাস সম্পর্কে ধারণা নিলেই হবে।বর্তমানে “ফাইটার্স” গাইডটা বেশ প্রচলিত।তবে,সবচেয়ে বেশি ইনফরমেটিভ গাইড আমার মতে “প্রিজম”। দোকানে যেয়ে কেনার সময় আইএসএসবি গাইড বললেই হবে। অনেক কোম্পানির লিখিত এর জন্য আলাদা গাইড পাওয়া যায়। অযথা এসব কিনে টাকা নষ্ট করতে যাবেননা দয়া করে।
সাধারণত আইকিউ, জেনারেল নলেজ এসব একদম কমন আইটেম লিখিত পরীক্ষার। বাসায় বসে আইকিউ গুলা সলভ করে গেলে এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ে গেলে পাশ করা একদম সহজ। নৌবাহিনীর লিখিত পরীক্ষায় সাধারণত সাধারণ জ্ঞান, ইংরেজি, আইকিউ এসব ই থাকে। (আর কিছু ছিল বলে আপাতত মনে পড়ছে না)। MCQ, Written দুই ধরণের ই প্রশ্ন আসে।বিমানবাহিনীতে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত উভয় বিষয় থেকে প্রশ্ন আসে। সেনাবাহিনীতেও সম্ভবত সেইম।
একটা পুরাতন গাইড কিনে নিলেই, ৫-৬ দিন ঘাটাঘাটি করলেই পাশ করা যাবে রিটেন পরীক্ষা। তবে অবহেলা করলে, প্রিপারেশন না নিলে বাদ পরার সম্ভাবনা আছে। রিটেন পরীক্ষার সময় ফর্মাল ড্রেসে যাওয়া বাধ্যতামূলক না তবে এটা কমন সেন্স যে একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন, ফর্মাল ড্রেস কোড মেইনটেইন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পরীক্ষার সময় অফিসার সুলভ আচরণ বজায় রাখুন।কারো টা দেখবেন না কিংবা দেখানোর চেষ্টাও করবেন না। ইনভিজিলেটর আপনার পরীক্ষা বাতিলের ক্ষমতা রাখেন- এটা মাথায় রাখতে হবে। পরীক্ষার পর নির্দিষ্ট দিনে ওয়েবসাইটে রেজাল্ট পাবলিশ করা হবে। আপনার রোল নম্বর অনুসারে খুঁজে নিতে হবে আপনি উত্তীর্ণ হতে পেরছেন কি না।
(ধাপ-৩ নিয়ে পরের পর্বে বিস্তারিত আলোচনা হবে)।
ধাপ-৩ অর্থ্যাৎ ISSB তে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা এই ধাপে আসার সুযোগ পান। হাতে গোণা কয়েকজন এই ধাপের সম্মুখীন হতে পারেন। যারা এই ধাপে আসতে পারবেন,তাঁরা যথেষ্ট যোগ্য এবং মেধাবি নিঃসন্দেহে। এই ধাপে আপনার শরীরের প্রত্যেকটি অংশ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হবে। মেজর কিছু টেস্ট করা হবে। সাধারণত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (CMH) করা হয়ে থাকে টেস্ট গুলো।
এই ধাপে বেশ কয়েকজন বাদ পড়তে পারেন।যদি ছোট খাটো সমস্যা থাকে, তাহলে বাদ দিবেনা। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনি অফিসার হিসেবে যোগদানের জন্য শারীরিকভাবে কতটা ফিট,এই ধাপেই সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। সাধারণত খুব কম মানুষই এই ধাপে বাদ পরে।
আজকের পর্বে আপাতত এই পর্যন্তই। কোনো কনফিউশন থাকলে কমেন্ট করতে পারেন, নজরে আসা মাত্র রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করবো। সামনের তথা শেষ পর্বে আসছি সামরিক বাহিনীতে চাকরি এর গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অর্থাৎ অফিসার ক্যাডেট পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন ধাপ ISSB এর বিস্তারিত আলোচনা নিয়ে।
আরও পড়ুনঃ এইচ.এস.সি পাশে সামরিক বাহিনীতে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির সুযোগ (পর্ব-২)
ছবি:সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন