হাজরে আসওয়াদ নামটি হয়তো সবাই অবশ্যই শুনেছেন। যদিও একে হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) বলা হয়ে থাকে। আমরা অনেকেই ইন্টারনেটে হাজরে আসওয়াদ পাথরের অনেক ছবিই দেখছি। কিন্তু হাজরে আসওয়াদের প্রকৃত ছবি বা রং কেমন ছিল? সে সম্পর্কে আমরা শুধুমাত্র ইসলামি ইতিহাস ও হাদিস থেকেই জানতে পারি৷ তবে নতুন তথ্য হচ্ছে, এবার প্রথম বারের মতো হাজরে আসওয়াদের একটি নতুন ছবি উন্মোচন করেছে সৌদি আরব।
সৌদি আরবের দুই পবিত্র মসজিদের ( মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববী) ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মতো একটি হাজরে আসওয়াদের ছবি উন্মোচন করেছে বলে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। আর মক্কার হারাম শরীফের এই কালো পাথরের ছবি উন্মোচন করায় মুসলিম বিশ্বের ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান রেসাহ আল-হরামাইনের বা দু’পবিত্র মসজিদের প্রকৌশল গবেষণা ও শিক্ষা বিভাগ হাজরে আসওয়াদের হাই রেজুলেশনের ছবিগুলো তুলেছে। আর এই ছবিগুলো তোলায় তারা ‘ফোকাস স্ট্যাক প্যানোরামা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
দুই পবিত্র মসজিদের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে কয়েকটি টুইটে বলেছে, ‘ফোকাস স্ট্যাক প্যানোরামা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেকগুলো স্পষ্ট ছবি তোলা হয়েছে। আর এই ছবিগুলোকে একত্রিত করে তারা একটি ছবিতে পরিণত করেছেন। যাতে করে হাজরে আসওয়াদ পাথরের একটি সুস্পষ্ট প্রতিচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়।
সৌদি কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, ‘প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে তাদের এই ছবি তোলার কার্যক্রম চলে। ‘ফোকাস স্ট্যাক প্যানোরামা’ প্রযুক্তিতে মোট ১ হাজার ৫০টি ছবি তোলা হয়। ফলে ছবিগুলোর মোট ইমেজ রেজুলেশনের পরিমান দাঁড়ায় ৪৯ হাজার মেগা-পিক্সেলে। আর এই ছবিটি তৈরি করতে তাদের মোট ৫০ ঘণ্টা সময় লেগেছে বলে জানা যায়। [ সূত্র : দ্যা সিয়াসাত ডেইলি এবং নয়া দিগন্ত ]
মক্কা পবিত্র কাবা শরিফের দক্ষিণ কোণে, জমিন থেকে ১.১০ মিটার উচ্চতায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত। হাজরে আসওয়াদ দীর্ঘে ২৫ সে.মি. এবং প্রস্থে ১৭ সে.মি.। শুরুতে এই হাজরে আসওয়াদ একটুকরো ছিল। কারামিতা সম্প্রদায় ৩১৯ হিজরীতে পাথরটিকে উঠিয়ে তাদের নিজেদের অঞ্চলে নিয়ে যায়। আর সে সময় পাথরটি ভেঙে ৮ টুকরায় পরিণত হয়।
পাথটির টুকরোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়োটি মাত্র একটি খেজুরের মতো। তাই এর সব টুকরোগুলো কে বর্তমানে অন্য আরেকটি পাথরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আর এর চার পাশে রুপার বর্ডার দিয়ে মুরে দেওয়া হয়েছে। যা আমরা বর্তমান হাজরে আসওয়াদের ছবি থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
তবে রুপার বর্ডার বিশিষ্ট পাথরটি চুম্বনের অংশ নয় বরং তাতে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদের টুকরোগুলো চুম্বন বা স্পর্শ করতে পারলে তবেই কেবল হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করা হয়েছে বলে ধরা হবে।
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে “হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে নেমে-আসা একটি পাথর।”(সুনানে নাসায়ি)
ইসলামি ইতিহাস ও হাদিস থেকে জানা যায় পাথরটির রং একদম শুরুর দিকে ছিল সাদা। পরে তা মানুষের পাপ চুষে নিয়ে কালো রং ধারন করেছে। অর্থাৎ তখন হাজরে আসওয়াদের ছবি তুলে রাখা সম্ভব হলে আমরা আজ দেখতে পেতাম তা ছিল স্বচ্ছ বা দুধের মত সাদা। পাথরটির রং সম্পর্কে একটি হাদিসে বলা হয়েছে-
“হাজরে আসওয়াদের রং শুরুতে ছিল দুধের বা বরফের চেয়েও সাদা ছিল। পরে আদম-সন্তানের পাপ তাকে কালো করে দেয়।“(তিরমিজি, সহিহ ইবনে খুজায়মা)
হজ্জ করার সমায় প্রত্যেক হাজিকে কাবা ঘর তাওয়াফ করতে হয়। প্রত্যেক তাওয়াফের শুরু করতে হয় কাবা ঘরের দক্ষিণ কোনের হাজরে আসওয়াদের প্রান্ত থেকে। আর এক একটি তাওয়াফ সম্পন্ন হয় হাজরে আসওয়াদ বরাবর পুনরায় ঘুরে আসলে। প্রত্যেক তাওয়াফের পরেই এই পাথরে চুৃম্বন বা স্পর্শ করতে হয়। এর ফলে বান্দার সমস্ত গুনায় বা পাপ এই পাথর চুষে নেয়। যেমনটি হাদিস শরিফে বলা হয়েছে-
“হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়। হাজরে আসওয়াদের একটি জিহবা ও দুটি ঠোঁট রয়েছে, যে ব্যক্তি তাকে চুম্বন-স্পর্শ করল, তার পক্ষে সে কিয়ামতের দিন সাক্ষী দেবে।”(নসায়ি, ইবনে মাজাহ, আহমদ)
তবে একটি কথা, হাজরে আসওয়াদ শুদু মাত্র একটি পাথর। এর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই৷ বরং আল্লাহ তায়া’লা একে চুম্বন ও স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হবে এমন ক্ষমতা পাথরটিতে দিয়েছেন। তাই আল্লাহ কে উদ্দেশ্য করে পাপের জন্য ক্ষমা ও মাফ চাইতে হবে। কেননা পাথরের নিজস্ব কোন ক্ষমা বা শক্তি নেই। সহিহ বুখারির একটি হাদিস থেকে সম্পর্কে জানা যায়।
হযরত ওমর (রা.) বলেছেন,“আমি নিশ্চয়ই জানি তুমি কল্যাণ অকল্যান কোনোটাই করতে পার না।রাসূল (সা.) তোমায় চুম্বন করেছেন। তাই আমিও করি। অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ কেবলই একটি পাথর যা কারও কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনোটাই করতে পারে না।” (বুখারি)
আমরা হাজরে আসওয়াদের ছবি দেখে ধন্য হয়েছি। বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যের তোলা ছবিটিতে লালছে বা হালাকা খয়েরী রঙের পাথরের মাঝে হাজরে আসওয়াদের টুকরো গুলোর প্রতিস্থাপন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সৌদি আরবের তোলা এই ছবিটি এবং গবেষণা মুসলিম উম্মাহকে মুগ্ধ করেছে। প্রত্যেক মুসলিমের মাঝে এনে দিয়ে নতুন এক উদ্দীপনা। কেননা আমরা নতুন করে আরও ক্লিয়ার একটি হাজরে আসওয়াদে ছবি দেখতে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। যদি এতো দূর থেকে অথবা কাছ থেকে একে চুম্বন করার সৌভাগ্য পাওয়া যেত। নিঃসন্দেহে প্রত্যেক মুমিন মুত্তাকী বান্দার জন্য তা হতো জীবনের অনেক বড় পুরস্কার ও সৌভাগ্য৷
হে আমার রব আমাদের প্রত্যেকে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ ও চুম্বন করার সৌভাগ্য দান করুন, আমিন।
মন্তব্য লিখুন