নিজেদেরকে সভ্যতার ঝান্ডাধারী দাবি করা মানুষের রয়েছে বেইমানী এবং নৃশংসতার অসংখ্য কলঙ্কিত ইতিহাস। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বতা অন্যতম। রাজনৈতিক পৃথিবীতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। আজকে আমরা এমন দশটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এর কথা জানবো যা সারা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছিলো।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড:সিজারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে Vincenzo Camuccini’র আঁকা ছবি
ভিনি ভিসি ভিডি– শব্দগুচ্ছের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমরা এর অর্থ করি, “এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন“। এই বাক্যটি যাকে নিয়ে লেখা তিনি ইতিহাসে অনন্য এক সমরনায়ক এবং রাজনৈতিক নেতা জুলিয়াস সিজার। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ‘জুলাই’ মাসের নামটি তাঁরই স্মরণে।
সাধারণ মানুষ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া এবং ক্লিওপেট্রার সঙ্গে প্রণয় ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ইতিহাসের এই সমর নায়কের বিজয়ের ইতিহাসই শুধু নয়; তাঁর মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসের আলোচিত বিষয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে, নির্মম হত্যাকার শিকার হন সিজার যেটা ছিল পৃথিবীর জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এর মধ্যে একটি। অন্তত ৬০ জন রোমান সিনেটর তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। সিনেটর গেইয়াস ক্যাসিয়াস লঙ্গিনাস এবং মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাসের নেতৃত্বে রোমের পম্পেই থিয়েটার সংলগ্ন একটি স্থানে ৩৫ বার ছুরিকাঘাত করে সিজারকে হত্যা করা হয়। রোমে ফিরে আসার পর বিভিন্ন সংস্কার কাজে হাত দিয়েছিলেন সিজার।
এর মধ্যে অন্যতম ছিলো দরিদ্রদের ভূমি পুনর্বণ্টন, পুলিশ বাহিনী তৈরি, ঐতিহাসিক কারথ্যাজ নগরী পুনর্নির্মাণ এবং ট্যাক্স সিস্টেম তুলে দেওয়া। তিনি প্রায়ই সিনেটদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই আইন প্রয়োগ বা পরিবর্তন করে ফেলতেন। এভাবে ধীরে ধীরে তার শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে।
ফলে সিনেট এবং বিরোধীদলীয়রা আশঙ্কা করতে থাকেন যে, এভাবে চলতে থাকলে সিজার একসময় সিনেট বাতিল করে নিজেই সম্রাট বা রাজা হিসেবে এককভাবে শাসন করতে শুরু করবেন। তাই শুরু হয় সিজারকে হত্যার ষড়যন্ত্র। হত্যার বিষয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বেশির ভাগের অভিমত ছিল তাকে সিনেটে হত্যা করা। কারণ সিনেট অধিবেশনের দিন শুধু সিনেটরদেরাই ভেতরে যেতে পারেন।
তাই সিনেটররা তাদের ধারালো ড্যাগার আলখেল্লার ভেতর লুকিয়ে ঢুকে পড়তে পারবেন সহজেই। সিজারকে যেদিন খুন করা হয় সেদিন তার চিকিৎসক ছাড়াও স্ত্রী ক্যালপুর্নিয়া নানা কারণে তাকে সিনেটে যেতে মানা করেছিলেন। আগের রাতে ক্যালপুর্নিয়া একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন।
তিনি দেখেছিলেন, সিজারকে কারা যেনো হত্যা করেছে। আর তার লাশের পাশে প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এমন আশঙ্কার কথা তিনি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরিবারের অনুরোধকে উপেক্ষা করে, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রুটাসের কথায় তিনি সিনেটের দিকে রওনা দেন।
৪৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের ১৫ মার্চ। এই দিনটি ছিলো রোম সাম্রাজ্যের বিশেষ একটি দিন। রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনে নববর্ষ পালন করা হতো। সাধারণ প্রজা থেকে শুরু করে অভিজাত শ্রেণি সবাই এইদিনে উৎসবে মেতে উঠতেন। বিশেষ ওই দিনটিতে সিজার যখন সিনেটে প্রবেশ করেন, তাকে দেখে সিনেটররা সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ান। যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা দাঁড়িয়েছিলেন সিজারের কাছাকাছি।
তার ঠিক ডান পাশে এসে দাঁড়ান সিনেটর টিলিয়াস কিম্বার। কিম্বারের ভাইকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন সিজার। কিম্বার তার ভাইয়ের একটি পিটিশন নিয়ে সিজারের কাছে দেন। এ সময় অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী তার পাশে এসে দাঁড়ান কিম্বারের সমর্থনে। এ সময় হঠাৎ করে কিম্বার সিজারের ঘাড় ধরে ফেলেন এবং সিজারের জ্যাকেট টেনে খুলে ফেলেন।
সিজার তখন চিৎকার করে কিম্বারের উদ্দেশে বলেন, ‘কেন এই সন্ত্রাস?’ এ সময়ে বাকিরা সবাই তাদের ড্যাগার বের করে ফেলেন এবং সিজারের ওপর হামলে পড়েন।
প্রথমেই সার্ভিলিয়াস কাসকা সিজারের বাম কাঁধে কলার-বোনের ওপরের দিকটায় ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার এই আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সিজার দাঁড়িয়ে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কাসকা তখন চিৎকার করে নাম ধরে তার ভাইকে সাহায্যের জন্য ডাকেন।
তার ভাই ডাক শুনে এসে তার তরবারি সিজারের পাঁজরে ঢুকিয়ে দেন। এক মুহূর্ত পর ক্যাসিয়াস সিজারের মুখ ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকেন। এতে তার মুখ ফালি ফালি হয়ে কেটে যায়। ব্রুটাস সিজারের শরীরের এক পাশে ছুরি ঢুকিয়ে দেন।
মিনিউকাসও সিজারকে আঘাত করেন। সিনেটরদের এই সংঘবদ্ধ আক্রমণের ফলে আঘাতের পর আঘাতে এক সময় সিজার পড়ে গেলেন পম্পেইয়ের মূর্তির পায়ের নিচে। মনে হচ্ছে, সবাই যেন চেয়েছিলেন এই খুনে অংশ নিতে। ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের এমন কেউ বাকি ছিলেন না, যারা তাকে আঘাত করেননি।
ছুরির ৩৫টি আঘাতের পর সিজার মারা যান। ঘটনাস্থলে সিজারের মৃতদেহ পড়েছিল প্রায় ৩ ঘণ্টা। এরপর অন্য কর্মকর্তারা এসে তার লাশ সরিয়ে নেন। সিজারের মৃত্যু রোম প্রজাতন্ত্রের দ্রুত অবসান ঘটার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কেন্টাকি প্রদেশের হার্ডিং কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হবার আগে তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা ও স্বশিক্ষিত আইন ব্যবসায়ী।
১৮৬০ সালে লিংকন রিপাবলিকানদের প্রেসিন্ডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৮৬১ সালে বিপুল ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। লিংকন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দাসপ্রথা নিধনে কাজ করেন। কিন্তু সাদা চামড়ার মার্কিনরা কৃষ্ণাঙ্গদেরকে দাস থেকে মুক্তি দিতে রাজি ছিলো না।
বিশেষত দক্ষিণের প্রদেশগুলো একজন উত্তরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে এমন কাজ মেনে নিতে পারছিল না। তাই দক্ষিণের ৭টি প্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন ত্যাগ করে কনফেডারেট স্টেট অফ আমেরিকা গঠন করে।
পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন নৌবহরে কনফেডারেটদের আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। লিংকন দক্ষতার সঙ্গে কনফেডারেটদের পরাজিত করেন এবং ১১ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে ৪ বছরব্যাপী চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেও লিংকন এর বিপদের ইতি ঘটেনি। যুদ্ধ সমাপ্তির মাত্র ৩ দিন পরে ১৪ এপ্রিল, ১৮৬৫ সালে লিংকন তার স্ত্রী’র সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন সফল এবং জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট এভাবে নিহত হবেন, পৃথিবী তখনো তা জানে না। সেই থিয়েটার হলেই উইলকেস বোথ নামে একজন অভিনেতা তার পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবার পিস্তল থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে লিংকনের মাথায় গুলি করে। পরের দিন প্রথম প্রহরে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ওই সময় উইলকেস বোথ এর সঙ্গে আরও তিন জন আততায়ী ছিল।
এর মধ্যে লিউইস পাওয়াল ও ডেভিড হেরোল্ডের দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিউয়ার্ডকে হত্যা করা। জর্জ এডজার্ডের দায়িত্ব ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনকে হত্যা করার। তবে তাদের সেই হত্যা প্রচেষ্টা সফল হয়নি। লিংকন হত্যাকারীর জন উইকিলিস বুথ জন্মগতভাবেই কনফেডারেটদের সমর্থক ছিলেন। তাই শেষ দিকে যুদ্ধের মোড় ঘুরাতে জন এবং তার ৬ জন সহযোগী প্রেসিডেন্টকে অপহরণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
এর জন্য তারা ২০ মার্চ ১৮৬৫ সাল ঠিক করেন। কিন্তু তারা যেখান থেকে লিংকনকে অপহরণ করবেন বলে ঠিক করেন লিংকন সেখানে উপস্থিত হন না। ফলে তাদের সেই পরিকল্পনা সফল হয় না। তবে তারা তাদের পরিকল্পনা থেকে না-সরে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যান এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে জন লিংকনকে হত্যা করেন।
ফোর্ড থিয়েটারে নিজে খুন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস তৈরির জন্য আইন প্রণয়ন করেন যারা বর্তমানে আমেরিকান রাষ্ট্র প্রধানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ
১৯১৪ সালের ২৮ জুন, অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো সফরে যান। বসনিয়ার জাতীয়তাবাদী ‘’মাদা বস্না” গ্রুপের ৬ জন ঘাতক (Cvjetko Popović, Gavrilo Princip, Muhamed Mehmedbašić, Nedeljko Čabrinović, Trifko Grabež, Vaso Čubrilović) তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গাড়ী বহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রথমে কাব্রিনভিক, গাড়িতে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং আশেপাশের লোকজন আহত হয়। ফার্দিনান্দের গাড়িবহর চলতে থাকে। গাড়ির গতি বেশি থাকায় দ্বিতীয় ঘাতকও ব্যর্থ হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ, সারায়েভো হাসপাতাল থেকে ফেরত আসার সময় গাড়িবহর ভুল করে ভিন্ন রাস্তায় প্রবেশ করে যেখানে কাকতালীয়ভাবে ঘাতক প্রিন্সিব দাঁড়িয়ে ছিলেন।
প্রিন্সিব পিস্তল দিয়ে ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রী সোফি-কে গুলি করে ও তারা মারা যায়। অস্ট্রিয়াতে এর কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। ইতিহাসবিদ Zbyněk Zeman এর ভাষায় ‘’এই ঘটনার কোন প্রভাব অস্ট্রিয়াতে পরেনি। পরের দুইদিন (২৮ ও ২৯ জুন) ভিয়েনার জনতা গান শুনে আর মদ খেয়েছে যেন কিছু ঘটেনি।”
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি মহাত্মা গান্ধী
মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নতুন দিল্লির একটি সুবৃহৎ প্রাসাদ বিড়লা হাউসের প্রাঙ্গনে (এখন গান্ধী স্মৃতি) হত্যা করা হয়েছিলো। তাঁর ঘাতক ছিলেন নাথুরাম গডসে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভার সদস্য এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) একজন প্রাক্তন সদস্য।
গডসে মনে করেছিলেন, এর আগের বছর, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় গান্ধীজী মুসলমানদের পক্ষে খুব বেশি সহায়তা করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সন্ধ্যা ৫টার কিছু পরে, গান্ধী, বিড়লা হাউজের পিছনের দিকে লনে যাওয়ার সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সর্ব ধর্মের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করছিলেন।
যেইমাত্র গান্ধী বেদির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, গডসে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীর পথের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ (অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি ব্যক্তিকে সরাসরি আঘাত করতে পারে) থেকে গান্ধীর বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি ছুঁড়েছিলেন।
গান্ধী মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিড়লা হাউসে তাঁর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে একজন প্রতিনিধি এসে তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে। জনতা গডসেকে ধরে ফেলেন এবং পুলিশের হাতে সমর্পন করেন। গান্ধী হত্যার বিচার ১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় শুরু হয়েছিল।
প্রধান আসামী ছিলেন গডসে এবং তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তে। একই সঙ্গে সহ-আসামি হিসাবে আরও ছয় জনের বিচার শুরু হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ৮ই নভেম্বর গডসে এবং আপ্তেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর আম্বালা কারাগারে তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো।
দিল্লির লাল কেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দেশভাগের জন্য মি. গান্ধীকেই দায়ী বলে মনে করতেন। নাথুরাম আদালতকে বলেন, গান্ধীজী দেশের জন্য যা করেছেন, আমি তাকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নীচু করে তাঁকে প্রণামও করেছিলাম।
কিন্তু সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে ভাগ করার অধিকার কারও নেই, তিনি যতবড়ই মহাত্মা হোন না কেনো। আর এর বিচার করবে, এমন কোনও আইন-আদালত নেই, সেজন্যই আমি গান্ধীকে গুলি করেছিলাম। নাথুরাম গডসে আর নারায়ন আপ্তে’র ফাঁসির সাজা শোনালেও নাথুরামের ভাই গোপাল গডসেসহ পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছিল আদালত। পরে দুজন ছাড়া পেয়ে যান।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি জন এফ কেনেডি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আলোচিত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির প্রাণ যায় আততায়ীর হাতে। আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যা আজও বড় এক রহস্য হয়ে রয়েছে। সম্প্রতি কেনেডি হত্যার কিছু নথি প্রকাশ করা হয়েছে।
ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা চরিত্রগুলোর অন্যতম একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি বা জন এফ কেনেডি। তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
কেনেডিই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রোমান ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট। অনেকের কাছে তিনি অনুসরণীয় আদর্শ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কমসংখ্যক প্রেসিডেন্টকেই মানুষ মনে রেখেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে একাধিক বই, বানানো হয়েছে চলচ্চিত্র।
তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের কট্টর বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত এই কমিউনিস্ট–বিরোধিতার জায়গা থেকেই কিউবায় কাস্ত্রোকে ক্ষমতা থেকে হটানোর সিআইএ’র ছকে গোড়ায় সায় দিয়ে ফেলেছিলেন কেনেডি।
তিনি যে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হচ্ছেন, সেই ১৯৬০-এই কিউবায় মার্কিন মালিকানাধীন সমস্ত তেল আর চিনি কোম্পানি সরকারি দখলে নিচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো। সিআইএ–র বন্দোবস্তে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া এক দল কিউবানকে তালিম দিয়ে, জোড়াতালি দেওয়া এক আধাসেনা বাহিনী বানিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল কিউবায়।
আমেরিকার কুখ্যাত বি–ফিফটি টু বম্বার গিয়ে এক প্রস্থ বোমাও ফেলে এল কিউবার সামরিক বিমানঘাঁটিতে। কিন্তু তার পরই মত বদলালেন কেনেডি। আর বিমান হামলার অনুমতি দিলেন না। ব্যর্থ হল ১৯৬১-র এপ্রিলে সিআইএ–র সেই ‘বে অব পিগ্স’ অভিযান।
কাস্ত্রোর রেভোলিউশনারি আর্মি মাত্র তিন দিনের লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করল দেশোদ্ধার করতে আসা সেই ভাড়াটে সেনাদের। আহত, ক্ষিপ্ত সিআইএ আরও ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র করল। ঠিক হল, আমেরিকার মাটিতে মার্কিন নাগরিকদের ওপর কিউবার সাজানো হামলা ঘটিয়ে, সেই অজুহাতে কিউবার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যাবে মার্কিন বাহিনী।
কেনেডি এ বার রাজি হলেন না। আমেরিকার দ্বিতীয় কোনও প্রেসিডেন্ট এ ভাবে সিআইএ-র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন বলে জানা নেই। মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগেই কেনেডি সীমিতাকারে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধে একটি চুক্তি করেন যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার সঙ্গে। এরই ভিত্তিতে পরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধের উদ্যোগ নেয়।
একজন নেতা হিসেবে মার্কিন শিল্প সংস্কৃতিতে কেনেডির ভূমিকা ও অবদান আজও অতুলনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে পরিচিত কেনেডি সেন্টার শিল্পকর্মে তার অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ যুদ্ধে লিপ্ত থাকার সময় ১৯৬১ সালে কেনেডি এক দশকের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন রাখেন জাতির সামনে। পরে ৫ মে, ১৯৬১ সালে এলেন শেপার্ড প্রথম মার্কিনী হিসেবে মহাশূন্যে ভ্রমণ করেন।
১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করতে কেনেডি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি ‘পিস কোর’। যার গুরুত্ব এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আফ্রিকান আমেরিকানদের আইনগত অধিকারের পক্ষে কেনেডি ছিলেন সোচ্চার। তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে কেনেডির তৈরি করা একটি বিলই পরে নাগরিক অধিকার আইন হিসাবে অনুমোদন পায়।
১৯৬৩ সালের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তার রাজনৈতিক উপদেষ্টাগণ তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রচারণার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যদিও তিনি সরাসরি নিজের প্রার্থিতার ঘোষণা দেননি, তবুও পরবর্তী নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
ফলে গণসংযোগের জন্য তিনি দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভ্রমণ শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে দুই দিনের সফরে জন এফ কেনেডি সস্ত্রীক টেক্সাসে আসেন। টেক্সাস সফরের দ্বিতীয় দিন, ২২শে নভেম্বর শুক্রবারে প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডি ও গভর্নর জন কনালি ও তার স্ত্রী সহ একটি ছাঁদ খোলা গাড়িতে ১০ মাইল দীর্ঘ একটি মোটর শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
শোভাযাত্রাটি ডালাস শহরের ডিলে প্লাজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানাতে এ সময় রাস্তার দু-পাশে ছিল জনতার ভিড়। ছাঁদ খোলা গাড়িতে বসে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি প্যারেড রুট এর দু পাশের জনসমুদ্রের দিকে হাত নাড়ছিলেন।
বেলা ১২ঃ৩০ এর দিকে তাদের গাড়ি বহর যখন টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি নামক একটি বহুতল দালানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তখন ঐ দালান এর ষষ্ঠ তলার জানালা থেকেই প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
লী হার্ভি অসওয়াল্ড ঐ ভবনের জানালা দিয়ে প্রেসিডেন্ট কে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি ছুঁড়ে যার দুইটি এসে লাগে প্রেসিডেন্ট কেনেডির গলায় ও মাথায়। এর ৩০ মিনিট পর ডালাস এর পার্কল্যান্ড হাসপাতালে কেনেডি কে মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কে গুলি করার এক ঘণ্টার মাঝেই লী হার্ভি একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। ঐ অফিসার কে হত্যার ৩০ মিনিট পরেই সন্দেহ ভাজন হিসেবে একটি মুভি থিয়েটার থেকে লী হার্ভিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তারপর ২৩ শে নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ও একজন পুলিশ অফিসার কে হত্যার দায়ে লী হার্ভি কে আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২৪শে নভেম্বর লী হার্ভিকে ডালাস পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয় অধিক সুরক্ষিত জেলে স্থানান্তর করার জন্য। সাংবাদিকরা এই সময় পুলিশি কার্যক্রম গুলো সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন।
হঠাৎ করে পুলিশ ও সাংবাদিকদের সামনেই জ্যাক রুবি নামক এক নৈশ ক্লাবের মালিক লী হার্ভিকে গুলি করেন। তৎক্ষণাৎ জ্যাক রুবিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন যে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি লী হার্ভিকে গুলি করেছেন। তবে তার এই কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন নি।
অনেকের মতে, লী হার্ভিকে হত্যা প্রেসিডেন্ট কেনেডি কে হত্যার ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মৃত্যুর মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন, যিনি মোটর শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্ট কেনেডির গাড়ি থেকে মাত্র তিন গাড়ি পেছনে ছিল, বেলা ২ঃ৩৯ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সদ্য বিধবা জ্যাকুলিন কেনেডি সহ ৩০ জনের মত লোক উপস্থিত ছিলেন।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি মার্টিন লুথার কিং
১৯২৯ সালে জন্মগ্রহন করা এই কিংবদন্তি মার্টিন লুথার কিং পৃথিবী জুড়ে তার বিখ্যাত ভাষন, ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ এর জন্য বেশি জনপ্রিয়। কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সবচে বেশি কাজ করেছেন আমেরিকান সিভিল রাইট মুভমেন্টের এই নেতা।
সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ নোবেল বিজয়ীও তিনি। কিন্তু এতো পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, এমনকি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও নিহত হয়েছেন আততায়ীর হাতে। সময়টা ছিল ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার।
মেমফিসে অবস্থিত লরাইন মোটেলে অবস্থান করছিল মার্টিন লুথার কিং। সেখানকার সিটি স্যানিটেশন কর্মীদের ধর্মঘটকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বায়োগ্রাফার টেইলর ব্রাঞ্চের লেখা মার্টিন লুথারের জীবনী থেকে জানা যায়, সেদিন লুথার সর্বশেষ কথা বলেন বেন ব্রাঞ্চ নামক একজন গায়কের সাথে।
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইভেন্টটাতে বেন যাতে “Take my hand, precious lord” গানটা গেয়ে শোনান সেই অনুরোধই করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তখন সন্ধ্যা ছয়টা এক মিনিট। লুথার কিং মোটেলের ৩০৬ নাম্বার কামরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় জেমস আর্ল রে নামক শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী এক যুবক তাকে গুলি করে।
হত্যার পাঁচদিন আগে সে ছদ্মনামে হত্যায় ব্যবহৃত জেমস রেমিংটন ৩০-০৬ রাইফেল কিনেছিল। গুলি করার পর বুলেটটি লুথারের ডান গাল ভেদ করে, স্পাইনাল কর্ড হয়ে ঘাড়ের শিরা ছিড়ে ফেলে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় পড়ে যান। ঐদিনই রাত সাতটা পাঁচ মিনিটে সেন্ট জোসেফ হসপিটালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ রাস্তার পাশে অবস্থিত ক্যানিপ’স অ্যামিউজমেন্ট ষ্টোরের বাইরের একটি বাক্স থেকে কাগজে পেঁচিয়ে ফেলে রাখা রাইফেল, অব্যবহৃত কিছু বুলেট এবং একটি দূরবীন আবিষ্কার করে, যাতে পরবর্তীতে জেমস আর্ল রে এর হাতের ছাপ পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শী এবং ষ্টোরের মালিকের ভাষ্য অনুযায়ী, কেউ একজন কাগজের মোড়ানো প্যাকেটটা রেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
খুনি সফলভাবে পালিয়ে থাকতে পেরেছিল বেশ কিছু দিন। এই ঘটনার প্রায় দুই মাস পরে, জুন মাসের আট তারিখে লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে জেমস ধরা পড়ে। হত্যাকান্ডের দায়ে তার ৯৯ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং কারাগারেই ১৯৯৮ সালে ৭০ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা বাঙালি জাতীয় জীবনের এক কলঙ্কিত ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে। পরে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। এদের একদল ছিল মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা যারা মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার “মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা” বইয়ে লিখেছেন, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময় রহস্যে ঘনীভূত থাকবে।
মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে নি। মুজিবের পুত্র, শেখ কামালকে নিচতলার অভ্যর্থনা এলাকায় গুলি করা হয়। মুজিবকে পদত্যাগ করা ও তাকে এ বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান।
জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (উপরের তলায় হত্যা করা হয়), মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের, দুইজন চাকর (শৌচাগারে হত্যা করা হয়); শেখ জামাল, ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল এবং মুজিবের দুই পুত্রবধুকে হত্যা করা হয়।
সেসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। পরে তারা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতে চলে আসেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন করেন।
দুটি সৈনিক দল মুজিবের ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হককে (মনি) তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীর সাথে ১৩/১, ধানমন্ডিতে এবং মুজিবের ভগ্নিপতি ও সরকারের একজন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যসহ মিন্টু রোডে হত্যা করে।
চতুর্থ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দলটিকে সাভারে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত প্রত্যাশিত বিরোধী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাঠানো হয়। একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর এগারজনের মৃত্যু হলে সরকারের অনুগতরা আত্মসমর্পণ করে।
আওয়ামী লীগের চারজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আ হ ম কামারুজ্জামানকে আটক করা হয়। তিন মাস পরে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বরে তাদের সকলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি ইন্দিরা গান্ধী
৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভের সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার। একটি আইরিশ টেলিভিশনের জন্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন উস্তিনভ, তার জন্যই ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার দিতে সম্মতি দেন।
সকাল ৯টা ১০ এর দিকে নয়াদিল্লীর ১ নম্বর সফদারজং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের বাগানে হাটছিলেন তিনি। সেই সময় তার দুই দেহরক্ষী যাদের তিনি খুব বিশ্বাস করতেন সত্যবন্ত সিং ও বিন্ত সিং সরাসরি গুলি করেন ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে। এই হত্যার কারণ সম্পর্কিত আলোচনায় চলে আসে ‘অপারেশন ব্লু ’স্টার’ এর নাম।
অপারেশন ব্লু স্টার হলো ১৯৮৪ সালের ১ থেকে ৮ জুন পাঞ্জাবের অমৃতসরে পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান যা ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছিল। মূলত সহিংস ধর্মীয় নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার অনুসারীদের হরমন্দির সাহিব কমপ্লেক্স থেকে উচ্ছেদ ও আটকের জন্যই এই অভিযান চালানো হয়।
শিখদের এই নেতাকে আটক করা হতে পারে, এমন গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল অনেক দিন আগে থেকেই। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে শিখ রাজনৈতিক দল আকালি দলের সভাপতি হরচাঁদ সিং লংওয়াল তাই ভিন্দ্রানওয়ালেকে পরামর্শ দেন শিখদের বিখ্যাত মন্দির স্বর্ণমন্দিরের কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিতে, যাতে করে সরকার তাকে গ্রেফতার করতে না পারে।
হরচাঁদের পরামর্শক্রমেই মন্দিরের কমপ্লেক্সকে নিজের অস্ত্রাগার ও হেডকোয়ার্টার বানিয়ে তোলেন ভিন্দ্রানওয়ালে। এতে অমৃতসর বলতে গেলে পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সেখানে সহিংসতায় মোট ৪১০ জন মানুষ নিহত হন, এমনকি ভিন্দ্রানওয়ালের বিরোধিতা করায় ৩৯ জন শিখ নাগরিককেও হত্যা করে ভিন্দ্রানওয়ালের বাহিনী।
হাজারেরও বেশি লোক আহত হয় এই সহিংসতায়। দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া ভিন্দ্রানওয়ালেকে আটক করার জন্য তাই বিশেষ এই অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন ইন্দিরা গান্ধী। অভিযানে নিহত হন ভিন্দ্রানওয়ালে। কিন্তু তাকে আটক করতে গিয়ে শিখদের পুণ্যস্থান স্বর্ণমন্দিরের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয় যার জন্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন বিশ্বজুড়ে শিখ সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ।
শিখদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন প্রধানমন্ত্রী, এমন দাবি তোলেন শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে। প্রতিবাদ জানিয়ে অনেক শিখ সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন, অনেকে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন, আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ হিসেবে সরকার থেকে পাওয়া সম্মাননা ও পুরষ্কারও ফিরিয়ে দেন।
তাকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া ৩৩ টি বুলেটের ৩০ টিই আঘাত হানে তার শরীরে। এর মধ্যে ২৩ টি বুলেট শরীরে ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বের হয়ে যায়, আর ৭ টি বুলেট আটকে ছিল শরীরের ভেতরেই। ডা. তিরথ দাস ডোগরা বুলেটগুলোকে বের করে ব্যালিস্টিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেন। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেই প্রধানমন্ত্রীর উপর আকস্মিক গুলিবর্ষণের ছয় মিনিটের মধ্যে দুই আসামীকে আটক করে ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রীর অন্য দেহরক্ষীদেরও আটক করা হয়। ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশের হাতে আটক হওয়া বিন্ত সিংকে আটক করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বিন্ত সিংই প্রথম গোলাগুলি শুরু করেন, তারপর তাকে বাধ্য হয়ে হত্যা করা হয়। অপর আসামী সত্যবন্ত সিংকে আটক করা হয় ও বিচারের আওতায় আনা হয়।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি রাজীব গান্ধীর
১৯৯১ সালের ২১ মে, চেন্নাই (তদনীন্তন মাদ্রাজ) শহর থেকে ৩০ মাইল দূরে শ্রীপেরামবুদুর শহরে রাজীব গান্ধীর শেষ জনসভাটির আয়োজন করা হয়েছিল। এই জনসভায় তিনি তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী শ্রীমতী মারাগতাম চন্দ্রশেখরের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানেই এলটিটিই জঙ্গী তেনমোঝি রাজারত্নমের আত্মঘাতী বোমার হামলায় রাজীব নিহত হন।
তেনমোজি রাজারত্নমের অপর নাম ছিল ধানু। পরবর্তীকালে আত্মঘাতী বোমারুর প্রকৃত নাম জানা যায় গায়ত্রী। হত্যার দুই ঘণ্টা পূর্বে রাজীব চেন্নাই শহরে উপস্থিত হন। একটি সাদা অ্যাম্বাস্যাডারের কনভয়ে তিনি যাত্রা করেন শ্রীপেরামবুদুরের উদ্দেশ্যে।
মাঝে কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারস্থলে তার কনভয় থেমেছিল। শ্রীপেরামবুদুরে যাওয়ার সময়ে তার গাড়িতে এক বিদেশি সাংবাদিক তার যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি রাজীবের একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। শ্রীপেরামবুদুরে তিনি গাড়ি থেকে নেমে সভামঞ্চের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন।
সেখানে তার বক্তৃতাদানের কথা ছিল। এই সময় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, কংগ্রেস দলীয় সমর্থক ও স্কুল ছাত্রছাত্রী তাকে মালা পরিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। রাত দশটা দশ মিনিটে হত্যাকারী তানু তার দিকে এগিয়ে যায়। সে রাজীবকে অভিবাদন জানায়। তারপর তার পা স্পর্শ করার আছিলায় পোষাকের নিচে বাঁধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেন।
পরমুহুর্তেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন। হত্যার দৃশ্যটি এক স্থানীয় সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। এই ক্যামেরা ও তার ফিল্ম ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায়। সেই ক্যামেরাম্যান নিজেও সেই বিস্ফোরণে মারা যান। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেন তেনমোঝি রাজারত্নম নামে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম বা এলটিটিই-এর এক সদস্যা। উল্লেখ্য, এই সময় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে বিজড়িত ছিল।
আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড: ছবি বেনজির ভুট্টো
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির এক নির্বাচনী সমাবেশ শেষে সভাস্থল ত্যাগ করার পর গাড়ীতে আরোহণের পর মুহূর্তে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন বেনজির ভুট্টো।
আত্মঘাতী হামলাকারী প্রথমে তার ঘাড়ে গুলি করে এবং পরবর্তীকালে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সভা শেষে বেনজীর তার এসইউভিতে চড়ে গন্তব্যে যাত্রা করবেন এমন সময় তার গাড়িতে এক বা একাধিক আততায়ী গুলিবর্ষণ করে।
যখন অন্য কেউ মনে করছিল বেনজীরকে গুলি করে হত্যার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয়নি, তখন এসইউভি’র আশেপাশে কোথাও থেকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ঘাড়ে গুলি লাগার কারণে বেনজীরের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছিল, যে আততায়ী গুলি করেছিল সে-ই নিরাপত্তা রক্ষীদের হাত থেকে বাঁচতে বোমা বিস্ফোরণটি ঘটায়।
দলের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছিলেন, আততায়ী নিজের শরীরে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর পূর্বে বেনজীরের ঘাড়ে ও বুকে গুলি করেছিল। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে দলের কর্মীসহ মোট ২৩/২৪ জন নিহত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, এই ঘটনার দুই মাস আগেও একবার বেনজীর হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল। কে বা কারা এই হামলা চালিয়েছে সে বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।
ঘটনার পর আল কায়েদার বরাত দিয়ে একটি টিভিতে জানানো হয়, আল কায়েদাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর তারিখে আল কায়েদার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বলা হয়, আল কায়েদা এই হামলা চালায় নি। অর্থাৎ আল কায়েদা এই হামলার দায় অস্বীকার করেছিল।
আধুনিক যুগের রাজনীতি যতটা না সেবামূলক তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রিক। আর এই ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই মূলত এসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে। যদিও এই সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলাপ হয়ে থাকে, তবে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কখনোই সঠিক পথ হতে পারে না বলে আমি মনে করি।
ছবিঃ সংগৃহীত
References:
1. www.britannica.com
2. m.economictimes.com
3. www.businessinsider.com
4. bn.m.wikipedia.org
5. www.bbc.com
মন্তব্য লিখুন