বলা হয়ে থাকে, আজকের ছাত্ররাই আগামির কান্ডারী। প্রশাসন নয়, পুলিশ নয়, সেনাবাহিনী নয়; ছাত্ররাই সর্বোত্তম শক্তি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যখন সবাই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে দিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখনো ছাত্ররা সকল ভয়কে উপেক্ষা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। জোর করে কখনোই শিক্ষার্থীদের উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ছাত্ররা রুখে দাড়িয়েছেন; লড়াই করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজকে আমরা ইতিহাসের এমন কয়েকটি ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে জানবো, যা ইতিহাস বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিলো।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ছাত্র আন্দোলন: মে ১৯৬৮: প্যারিসের রাস্তায় ব্যরিকেডের বিরুদ্ধে ছাত্ররা
আলজেরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের ‘ফোর্থ রিপাবলিক’ (১৯৪৬-১৯৫৮) এর পতন হলে ১৯৫৮ সালে অসাংবিধানিক উপায়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন চার্লস ডি গল। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ফরাসি সেনানায়ক।
এসময়ের ছাত্ররা সমাজ এবং শিক্ষায়তনের বাইরে গিয়ে জাতীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে শেখেন। ফ্রান্সের এই তরুণরা ডি গলের ক্ষমতাকে কখনোই পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেননি। তাদের চোখে ডি গল ছিলেন একজন ছদ্মবেশী একনায়ক, যার ক্ষমতাবলয়ে দেশে স্বৈরশাসন, অপশাসন আর সামাজিক অসঙ্গতি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সরকার তরুণদের মন বুঝতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
নানান অসঙ্গতিতে পূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র নিয়ে তরুণদের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। তারা ফ্রান্সের তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা অর্থোডক্স মার্ক্সিস্ট পার্টি, উভয়কেই বর্জন করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া মিসোফে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুইমিং পুল উদ্বোধন করতে আসেন।
অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পরই ছাত্রনেতা ড্যানিয়েল বেন্ডিট তার কাছে আসেন। তখন ফ্রান্সের ছাত্রাবাসগুলোতে নারী-পুরুষের একত্রে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ ছিলো। এই আইনের সমালোচনা করে বেন্ডিট জানান, তরুণদের যৌন হতাশা দূর করতে ব্যর্থ মিসোফে মন্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থ। এরপর বেন্ডিটের বক্তৃতার মাঝেই মিসোফে জবাব দেন, বেন্ডিট যেনো সুইমিং পুলে ডুব দিয়ে তার শরীরের জ্বালা মেটান! এর জবাবে বেন্ডিট বলেছিলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে এর বেশি আশা করিনি!” এ ঘটনার পর থেকে ফ্রান্সের ছাত্রসমাজের কাছে বেন্ডিট কিংবদন্তিতুল্য নেতা হয়ে ওঠেন।
এ ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে, প্যারিসে অবস্থিত ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার অফিসে একটা হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে একাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রমাণ ছাড়া এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মার্চ মাসেই আবারো ফুঁসে ওঠে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এবার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আরো কিছু শিক্ষার্থী গ্রেফতার হন, যাদের মধ্যে ছিলেন বেন্ডিটও।
ছাত্র আন্দোলন: মে ১৯৬৮: স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত প্যারিস
গুজব ছড়িয়ে যায় যে, বেন্ডিটকে দেশান্তরী করা হতে পারে। এমন গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মার্চ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন, যা ‘টুয়েন্টি সেকেন্ড মার্চ মুভমেন্ট’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন চলছিলো, তা মার্চ, এপ্রিল পেরিয়ে মে মাসে পৌঁছুলেও সরকার তাতে কোনো গুরুত্ব দেয় না। বরং, এই আন্দোলনের মাঝেই সরকার নিয়মিত শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করতে থাকে। এটাই সরকারের বড় ভুল ছিলো।
আন্দোলন দমাতে মে মাসের শুরুতেই প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নানতেরা ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকল প্রকার সমাবেশও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল উল্টোটা। নিজেদের ক্যাম্পাস বন্ধের ক্ষোভ মেটাতে শিক্ষার্থীরা ৩ মার্চ সরবোন ক্যাম্পাস ঘেরাও করেন।
এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসার। কিন্তু সরবোন কর্তৃপক্ষ সভা করে সিদ্ধান্ত নিল, পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেবে! তখন তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর উপর কাঁদুনে গ্যাস, ব্যাটন আর জলকামান নিয়ে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো রায়ট পুলিশ।
গণগ্রেফতার আর অসংখ্য হতাহতের মধ্য দিয়ে সেদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে পরিস্থিতি শান্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলো সরবোন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, তাদের এই পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে তাদেরই আঘাত করে। নানতেরার পর সরবোন ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণায় পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।
শিক্ষার্থীরা ১০ মে সর্বাত্মক প্রতিবাদের ডাক দেন। তাদের দাবি ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া এবং গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি। সাত দিনের ব্যবধানে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০ হাজারে এসে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং অথোরিটি’ তথা ও আরটিএফের দিকে এগোতে থাকলে শত শত রায়ট পুলিশ রাস্তা আটকে তাদের ঠেকাতে চায়। পুলিশদের সরাতে শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মতো পাথর ছুঁড়তে থাকেন।
কিছুক্ষণ পরই পাল্টা আক্রমণ চালায় পুলিশ। মুহুর্মুহু টিয়ার শেল ছোঁড়ার পাশাপাশি জলকামান আর লাঠিচার্জ করে। পুলিশের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্যারিসের প্রশস্ত রাস্তাগুলোয় শত শত ব্যারিকেড তৈরি করেন শিক্ষার্থীরা। সে রাতে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয় আর আহত হন কয়েক হাজারের মতন।
১০ মে রাতে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের এই তাণ্ডবে পুরো ফ্রান্স হতবাক হয়ে যায়। পুরো ফ্রান্সে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন তুঙ্গে উঠে যায়। ১০ই মে পর্যন্ত যে আন্দোলন কেবল ছাত্র আন্দোলন ছিলো, ছিলো শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনের জন্য, ১১ই মে থেকে সে আন্দোলন পরিণত হয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে সমগ্র ফ্রান্সের সর্বাত্মক আন্দোলনে।
ফ্রান্সের ইতিহাসে শ্রমিকরা বৃহত্তম ধর্মঘট ডাকেন, রাস্তায় নেমে আসেন লাখ লাখ শ্রমিক, বন্ধ হয়ে যায় গাড়ির চাকা আর কারখানার মেশিন। এই আন্দোলনে পুরো ফ্রান্স থমকে যায়।
৬৮’র ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়গুলোতে ছাত্রদের চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি ছিলো। তবু এ আন্দোলন সর্বোত্র ছাত্র আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। কেননা এই আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্ররাই পরবর্তীকালে ফ্রান্সের সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন।
এই ছাত্রদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিল পরবর্তীকালের কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তাব্যক্তিরা, যারা নিজেদের ছাত্রজীবনে করে আসা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
ছাত্র আন্দোলন: হোয়াইট রোজ ১৯৪২, Hans Scholl, Sophie Scholl and Christoph Probst (বাম থেকে) নাৎসিদের হাতে বন্দী সিক্রেট স্টুডেন্ট গ্রুপের সদস্য
সময়টা ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে আর নাৎসি শাসনের শাসন তখন। এই শাসনের বিরুদ্ধে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি আন্দোলনের সূচনা করেন। তারা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ গ্রুপ গঠন করেন। এর নাম রাখা হয় হোয়াইট রোজ বা শ্বেত গোলাপ। নাৎসি বাহিনীর নির্মমতা সম্পর্কে জার্মানির সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এবং জনগণকে নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিরোধ গড়ে তোলায় উৎসাহী করে তুলতে তারা একটি লিফলেট ক্যাম্পেইন শুরু করেন।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় হিটলার ও নাৎসি বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে হোয়াইট রোজ আন্দোলন ৬টি লিফলেট প্রকাশ করে। এর মধ্যে চতুর্থ লিফলেটটিতে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা চুপ করে বসে থাকব না। আমরা তোমার মন্দ বিবেক। হোয়াইট রোজ তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।’
এইসব লিফলেটের কপি তৈরি করতে আন্দোলনকারীরা হস্তচালিত ছাপযন্ত্র ব্যবহার করতেন। এই লিফলেটগুলো তারা অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক এবং ফোনবুকের ঠিকানা ধরে ধরে ডাকে পাঠাতেন। সুটকেসে বহন করে এইসব লিফলেট তারা জার্মানির অন্যান্য শহরেও বিতরণ করতেন। ফোনের বুথে বুথে রেখে আসতেন, যেনো এগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। আর তা পৌছেও যাচ্ছিলো সর্বসাধারণের হাতে।
১৯৪৩ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট রোজের দুই সদস্য জার্মান গুপ্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর একে একে ধরা পড়েন হোয়াইট রোজ গ্রুপের অন্য সদস্যরাও। অবশেষে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় সদস্যকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নাৎসি শাসনে এই আন্দোলন বড় কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও ছাত্রদের এই সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিনে কিছুটা হলেও ফাটল তৈরি করতে পেরেছিলো যা পরবর্তীতে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
ছাত্র আন্দোলন: জুন ১৯৮৯ঃ তিয়েন আনমেন স্কয়ারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী
বর্তমান পৃথিবী শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে চীন অন্যতম। সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক কৌশলে চীন এখন সারা পৃথিবীতে রাজ্যত্ত্ব করছে। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরে চীনা সরকারের যে আগ্রাসন তা বাইরে থেকে ঠিকঠাক বোঝা যায় না। কারণ দেশের মিডিয়া, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরও চীনা সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ।
পূর্বের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন ছিলো। তিয়েন আনমেন স্কয়ার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্র। শহরের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত এই চত্বরের উত্তরে তিয়েন আনমেন নামক একটি ফটক রয়েছে। তিয়েন আনমেন অর্থ ‘স্বর্গের দরজা’। এই ফটকের সাথে মিলিয়ে চত্বরের নামকরণ করা হয় তিয়েন আনমেন।
১৯৭৬ সালে চীনের জনক মাও সেতুং মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সাথে চীনা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূর্য অস্তমিত হয়। এসময় চীনের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে গিয়েছে। দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অস্থিতিশীল অর্থনীতি, বেকারত্ব ইত্যাদির কারণে চীনে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঘটে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের। চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। এমন অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৮৬ এর দিকে চীন জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়।
আন্দোলনে অংশ নেয় চীনের ছাত্রসমাজ। মাওবিরোধী সংস্কারপন্থীদের আন্দোলনে প্রেরণা প্রদান করেন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হু ইয়াওবেং। ফলে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে তাকে দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তিনি ১৯৮৬ সালে ছাত্রদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে উস্কানি প্রদান করেন। তাকে দলের পক্ষ থেকে অপমান করা হয়। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। এই নেতাকে ঘিরে চীনে বড় আকারের সংস্কারপন্থী ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে।
১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন হু। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নেতা হওয়ার পরেও সরকারপক্ষ থেকে হু-কে কোনো ধরনের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়নি। সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার থেকে তেমন ফলাও করে ঘোষণা করা হয়নি তার মৃত্যুসংবাদ।
এই আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। বিভিন্ন দিক থেকে সরকারকে চাপ দিতে থাকেন ছাত্ররা। ছাত্র নেতারা সরকারপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলার জন্য গ্রেট হলে সমাবেশের আয়োজন করেন। কিন্তু সরকারপক্ষের কোনো নেতা ছাত্রদের সমাবেশে অংশ নেননি। ফলে ছাত্ররা ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েন।
কিন্তু সরকার থেকে হু ইয়াওবেংকে সংবর্ধনা প্রদান করার দাবি মেনে নেওয়া হয়। প্রায় ১ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় হু ইয়াওবেংকে। এদিন ছাত্ররা সরকারের নিকট তাদের আন্দোলনের দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি পিটিশন পেশ করেন। কিন্তু নতুন মহাসচিব ঝাও ঝিয়াং ছাত্রদের পিটিশন আমলে নিলেন না।
তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে উত্তর কোরিয়া চলে গেলেন। এই ঘটনায় ছাত্ররা চরমভাবে অপমানিত হয়। এই অপমানে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা একটা সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন। দেশের মুদ্রাস্ফীতি, চাকুরীর সীমিত সুযোগ ও পার্টির অভ্যন্তরে দূর্নীতিসহ নানান অনিয়ম নিয়ে ছাত্ররা কথা বলতে শুরু করেন। এসবের বিরুদ্ধে হু- ওবসোচ্চার ছিলেন।
দানাবেধে ওঠা এই আন্দোলনের বিক্ষোভকারীরা সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের বিষয়েও দাবী তোলেন। বিক্ষোভকারীরা মাওসেতুং এর ছবির সামনে গণতন্ত্রের দেবীর মূর্তি স্থাপন করে দেন। বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রায় এক মিলিয়ন লোক সমবেত হয়েছিলেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন বেইজিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
শুরুতে সরকার বিক্ষোভকারীদের প্রতি নমনীয় ভূমিকায় ছিল। ক্রমান্বয়ে আন্দোলন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ছাত্ররা অনশনের ডাক দেন। অনশন বিক্ষোভের মাধ্যমে এই আন্দোলন বিশ্ববাসীর নিকট সমর্থন আদায় করে। ছাত্রদের এই পদক্ষেপ ছিল সময়োচিত। দেশের বিভিন্ন অংশে তাদের সমর্থনে প্রতিবাদ সভা চলতে থাকে।
মে মাসের মাঝামাঝিতে চার শতাধিক শহরের বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯ মে সকালে ঝিও ঝিয়াং তিয়েন আনমেনে ছাত্রদের সাথে কথা বলার জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু তার এই উপস্থিতির কথা চীন সরকার জানতেন না। তিনি সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “Students, we came too late. We are sorry. You talk about us, criticize us, it is all necessary.” কিন্তু এই সরিতে ছাত্ররা ঘরে ফিরে যান না। তারা আমূল পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। স্বৈরাচারী সরকার ঝাও ঝিয়াংকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। তাকে গৃহবন্দী করা হয়। এরপর আর জনসম্মুখে কখনো দেখা যায়নি ঝিয়াংকে।
ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা এই আন্দোলন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবর্গ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন বেইজিংয়ে সামরিক শাসন জারি করেন ডেং ঝিয়াওপিং। অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাসদস্যরা বেইজিংয়ের রাজপথে নেমে আসেন। কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা বেইজিং প্রবেশের সকল রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। ফলে সামরিক বাহিনীর বেইজিং প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সামরিক শাসন জারি করায় ছাত্ররা ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়।
তারা গণতন্ত্রের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। বেইজিং পরিণত হয় বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্রে। আন্দোল ঠেকাতে ২০ মে, দলীয় কর্তৃপক্ষ সামরিক আইন জারী করে ও বেইজিংয়ে ৩০০,০০০ সৈনিক মোতায়েন করেন। বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্র তিয়েন আনমেন স্কয়ারে ছিলো আন্দোলনকারীদের অবস্থান। সৈন্যরা সেই দিকে ট্যাঙ্কসহ এগোতে থাকে। সেনাবাহিনীর আক্রমণকে রুখতে অস্ত্রহীন সাধারণ নাগরিকগণ বাঁধা দেবার চেষ্টা চালান।
ছাত্র আন্দোলন: ৩ জুন ১৯৮৯ঃ অভিযানের জন্য জড়ো হওয়া সৈন্যদের ফিরে যেতে স্লোগান দিচ্ছেন একজন ছাত্র
ছাত্রদের আক্রমণে কয়েকজন সৈন্য নিহত হন। এর পরে সৈন্যরা এবং সরকার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে প্রতিশোধের নেশায় সৈন্যরা তিয়েন আনমেনের দিকে এগোতে থাকে। ঐ স্কয়ারেই ছাত্রসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারীরা সাত সপ্তাহ অবস্থান করছিলেন। তারা ট্যাংক দিয়ে সাধারণ জনতার উপর গোলাবর্ষণ করে। পদাতিক বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। ধারনা করা হয় এই অভিযানে কয়েকশত থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত নাগরিককে হত্যা করা হয়। ৪ জুন সন্ধ্যার দিকে তিয়েন আনমেন স্কোয়ার সম্পূর্ণভাবে দখলে নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী।
চীন সরকার এই অভিযানকে সফল ঘোষণা করেন এবং ন্যায়ের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে বিদ্রোহে নিহতদের সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য গোপন করা হয়। কিন্তু এই নৃশংস অভিযান বিদেশি কয়েকজন সংবাদকর্মী এবং কিছু সাধারণ মানুষ ভিডিও করেন যা নির্মমতার প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেছে। বর্তমান চীনে এঘটনার বিষয়ে কোনোরূপ আলোচনা ও স্মরণ করা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ।
ছাত্র আন্দোলন: ১০ জুলাই ৯৯৯৮ঃ জ্বালিয়ে দেওয়া তেহরান ইউনিভার্সিটির একটি ছাত্রাবাস কক্ষ
সরকার ইরানের সংস্কারপন্থী সংবাদপত্র সালাম বন্ধ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ করেন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তখন সামাজিক অস্থিরতা ছিলো তুঙ্গে। ঘটনা খারাপ হতে খারাপ তর দিকে ধাবিত হচ্ছিলো। সরকার আন্দোলনে ভীত হয়ে পড়ে। যেকোনো মূল্যে তারা এটা থামাতে চায়।
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর ৮ জুলাই মাঝ রাতের পর ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে অভিযান চালায় দেশটির পুলিশ বাহিনী। সেদিন ঘুমন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর এক নৃশংস হামলা চালায় তারা।
ছাত্র আন্দোলন: ১০ জুলাই ১৯৯৯; পুলিশি অভিযানে আহত একজন শিক্ষার্থী (AFP)
এতে বেশ কয়েকজন আহত ও এক বহিরাগত শিক্ষার্থী নিহত হলে জনসাধারণের মাঝেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ১২৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ইরানের রাজপথে নেমে আসেন। এই ছোট্ট বিক্ষোভ গণজোয়ারে পরিণত হয়।
তাই স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুলিশি অভিযানের সমালোচনা করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। এসময় আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুলিশকে সংযমের পরামর্শ দেন। এমনকি তার ছবি কেউ যদি পুড়িয়েও ফেলে তবুও যেনো সংযম দেখানো হয় এমনটাই নির্দেশ দেন তিনি।
এই আন্দোলনের ফলে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসে ইরানে। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ১৯৯৯ সালে আবারও দেশটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।
ইরান এখনো সরকারি নানা বিধি নিষেধ রয়েছে। সাধারণ মানুষ সরকারি এসব বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে নীরবে জীবন অতিবাহিত করলেও দেশটির শিক্ষার্থীরা এখনো যে কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদী অবস্থান নেন; যার পেছনে এই আন্দোলন প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
চিত্রঃ ছাতা ছাত্র আন্দোলন ২০১৪: পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের মধ্যে ছাত্রা হাতে একজন শিক্ষার্থী
হংকং একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৯৯৭ সালে হংকংকে ‘ ব্রিটিশরা এক রাষ্ট্র, দুই নীতি’ কাঠামোর প্রেক্ষিতে চীনের নিকট হস্তান্তর করে। এই নীতির মানে হচ্ছে, যদিও হংকং চীন দেশেরই অংশ, তবুও শহরটির নিজস্ব কিছু স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য থাকবে।
চীনের রাজধানী বেইজিং শহরটির প্রতিরক্ষা এবং বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তবে অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে চাইলেই চীন নাক গলাতে পারবে না। হংকংয়ের নিজস্ব কিন্তু সীমিত অধিকারসম্পন্ন সরকার ব্যবস্থা, নাগরিকদের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং গণযোগাযোগ মাধ্যমের উপর কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা আরোপ করার অধিকার চীনের থাকবে না।
সচারাচর যেমন দেখা যায় তেমনি প্রথম কয়েক বছর বেশ ভালোভাবেই এই নীতিতে সবকিছু চললেও সমস্যা বাঁধে যখন চীন হংকংকে পুরোপুরি নিজেদের আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা শুরু করে। ২০০৩ থেকে আজ অবধি নিরাপত্তা, শিক্ষা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং এরকম নানা বিষয়ে চীন নিজেদের মতো করে শহরটিকে গড়ে তুলতে চায়। তবে হংকংবাসী বারবারই এসব কিছুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২০১৪ সালের আন্দোলনের পরই মূলত হংকংয়ের এসব আন্দোলন ‘ছাতা বিপ্লব’ বা ‘ছাতা আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে বিধায় প্রায়ই ২০০৩ সাল থেকে বর্তমানের সব আন্দোলনকে একত্রে এই নাম দুটি দিয়েই প্রকাশ করা হয়।
হংকংয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে এবং একটি সুষ্ঠু ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উদ্দেশ্য আদায়ে রাস্তায় নামেন। তখন তাদের থামানোর উদ্দেশ্যে সরকার অনেক চেষ্টাই করে। ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হংকংয়ে সরকারের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আসা শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ মরিচের গুঁড়ো, কাঁদানে গ্যাস এবং জলকামান দিয়ে আক্রমণ করে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলো অগ্রাহ্য করে তাদের আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া।
তবে ফলাফল হলো ঠিক এর বিপরীত। সাধারণ জনগণেরাও দলে দলে ছাত্রদের এই আন্দোলনে যোগদান করা শুরু করলো। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের কাছে এই জ্বালাময় হামলা থেকে বাঁচার হাতিয়ার হিসেবে ছিলো ছাতা এবং ভেজা তোয়ালে। পুলিশের আক্রমণের সময় পুরো জনসমুদ্র হাজার হাজার ছাতার রঙে রঙিন হয়ে উঠে। সাধারণ ছাতাই যেন আন্দোলনটির মূল প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। আর এজন্যই সংবাদমাধ্যমে এটি ‘ছাতা বিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
চিত্রঃ ছাতা ছাত্র আন্দোলন ২০১৪ঃ হংকং এর রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা
অবশ্য আন্দোলনের নেতাদের মতে এটা কোনো বিপ্লব নয়, বরং নিজেদের অধিকার রক্ষা এবং ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন। চীনের কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে তা পুনরায় আদায় করার উদ্দেশ্যেই শুরু করা হয় এই আন্দোলন।
বিদেশি গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বারবার ‘ছাতা বিপ্লব’ বলতে শুরু করলে ‘হংকং ডেমোক্রসি নাউ’ ফেসবুক পেজ এই অভিধার সংশোধনী আনে। পেজটি মূলত আন্দোলনের মূল নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে খোলা হয়। সেখানে তারা ‘বিপ্লব’ এর পরিবর্তে ‘আন্দোলন’ শব্দটি ব্যবহার করার অনুরোধ জানান।
তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো, একে আন্দোলন বললেই তাদের কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। কারণ তাদের একমাত্র হাতিয়ার হলো ছাতা। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য যেমন ছাতা দরকার তেমনি এই বিপদের সময়ও ছাতা তাদেরকে সকল অরাজকতা থেকে রক্ষা করবে। এই আন্দোলনের স্বার্থে অনেকে ছবি এবং লোগোও ডিজাইন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সানি ইয়েন, ক্যারোল চ্যান, অ্যান্ড্রিয়ু ওং, লিলি চিয়ুং, চুন মান এবং অ্যাঙ্গ্যালো কস্টাডিমাসের লোগো বা ছবি।
দূরদর্শী নেতারা এই আন্দোলনে সমর্থন জানালে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। বেসামরিক জনতা হংকংয়ের মূল বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোর রাস্তাঘাট ৭৯ দিনের জন্য বন্ধ করে দেন। খুব শান্তভাবেই তারা তাদের কর্মসূচি পালন করছিলেন। কোনো ধরনের সহিংসতা তাতে ছিলো না।
তবে এতে হংকংয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের জলকামান নিয়ে আক্রমণ করে বসলে ছাতা হয়ে যায় আমজনতার মূল হাতিয়ার। অবশ্য এসব কিছুর পেছনে জনগণের স্বার্থ লুকিয়ে থাকা সত্ত্বেও শহরের কিছু বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ী তাদের সাময়িক সমস্যার কারণে এই আন্দোলনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
ছাত্র আন্দোলন: ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে আমতলায় ছাত্রদের সমাবেশ
শুরুটা হয় ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রেক্ষিতে বাঙালিরা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি না তুলে যোগ দেয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে। শুরু থেকেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সংকট ঘনীভূত হতে শুরু করে। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে, এ অঞ্চলের মানুষের বড় অংশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ছিল।
কিন্তু পশ্চিমা শাসকদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে একপেশে মনোভাবের ফলে বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হলেও এ আন্দোলন মার্চের মধ্যেই ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলন শুধু শিক্ষিত শ্রেণী নয়, বরং গোটা বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। ১৯৪৮ ও ১৯৫২- এ দুই পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঢাকার বাইরের জেলা ও মহকুমা শহর অতিক্রম করে প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে তা ছড়িয়ে পড়ে।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে। এই পুস্তিকায় তিনজন লেখকের রচনা স্থান লাভ করে। এই তিনজন লেখক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সেসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং খ্যাতনামা সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ।
তাদের রচনায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার পাশাপাশি বাংলাকে অবমূল্যায়ণ করার ক্ষতিকর দিকও তুলে ধরা হয় বিভিন্নভাবে। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিতে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর করে, প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছাত্র কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নামের একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্মলগ্ন থেকেই এই ছাত্র সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। এ সময়ে তমুদ্দন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। প্রায় একই সময়ে, পাকিস্তান গণপরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিতে দাবী উত্থাপন করলে সে দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে হরতাল ডাকা হয়।
এটাই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। এই হরতালের প্রতি রেল শ্রমিক কর্মচারীদের পূর্ণ সমর্থন থাকায় ঐদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে কোন ট্রেন রওনা হতেই পারেনি। এটা ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর বাঙালিদের দৃশ্যমান অনাস্থার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। সেদিন ঢাকায় ভোর থেকেই সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পিকেটিং শুরু হয়। ফলে খুব কম সংখ্যক সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা সেদিন সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে সে সময় কাঁটা তারের বেড়া ছিলো। অনেক পিকেটার কাঁটা তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে সেক্রেটারিয়েটের ভেতরে ঢুকে পড়ে উপস্থিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিতির জন্য নিন্দা জানান। পিকেটারদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে যাতে অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ অনেকে আহত হন।
পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করায় শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ-সহ অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারের এসব খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে শহরের বিভিন্ন দিক থেকে আসা বিক্ষুব্ধ জনগণের মাধ্যমে গোটা সেক্রেটারিয়েট এলাকা অচিরেই বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এর ফলে সমগ্র শহরে একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
১১ মার্চের এ অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এতে তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন অত্যন্ত ভয় পেয়ে যান। কারণ ১৯শে মার্চ তারিখে গর্ভনর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা।
তিনি ঢাকা এসে যদি এই অরাজক পরিস্থিতি দেখতে পান, খাজা নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তাঁর ধারণা খারাপ হবে। তাই তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সকল দাবী-দাওয়া মেনে নিয়ে সাত-দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত অনুসারে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে যাদের আটক করা হয়েছিলো তাদের সবাইকে মুক্তি দেয়া হলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে।
এর পর যথা সময়ে কায়েদে আজম পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। প্রাদেশিক রাজধানীতে অবস্থানকালে তিনি রমনা রেসকোর্স ময়দানে একটি বিরাট জনসভায় এবং কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দান করেন। উভয় স্থানেই তিনি ইংরেজীতে ভাষণ দেন, এবং রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। উভয় স্থানেই তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়।
রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় কোনো দিকে থেকে কে বা কারা তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়, তা তিনি খেয়াল না করলেও সমাবর্তনে সীমিত সংখ্যক উপস্থিতিতে তাঁর মুখের সামনে উপস্থিত ছাত্রদের নো-নো প্রতিবাদ ওঠায় তিনি বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভাষণ বন্ধ রাখেন। কারণ এই ছাত্র তরুণরাই মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর আহ্বানে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেছেন। অত:পর তিনি ভাষণ সংক্ষেপ করে কার্জন হল ত্যাগ করেন।
চিত্রঃ শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল (১৯৬৩)
এরপর তিনি ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে তাদের বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তুু উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকাতে আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঐ বছরের (১৯৪৮) ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম ইন্তেকাল করেন। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ছিলো। ঐ বছর ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আর কোন প্রকাশ্য বিবৃতি দেননি। বরং বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ বইতে জানা যায়, মৃত্যু শয্যায় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্ণেল এলাহী বখশের কাছে এই বলে একাধিকবার দু:খ প্রকাশ করেন যে, অন্যের কথায় বিশ্বাস করে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বক্তব্য দিয়ে তিনি বিরাট ভুল করেছেন। ব্যাপারটি গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়াই তাঁর উচিৎ ছিলো।
আগেই বলা হয়েছে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদ আজম ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিনকে তার স্থানে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিনকে তার স্থানে প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা সফরে এসে তিনি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা কালে ঘোষণা করে বসেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে শুধু উর্দু। খাজা নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষণায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন পুনরায় জীবন্ত করে তোলে।
বিশেষ করে যে নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তার এই ঘোষণা ভাষা সংগ্রামীদের কাছে চরম বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজ বলে বিবেচিত হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের ডাক দেওয়া হয়। এই প্রতিবাদ দিবস পালন করতে গিয়েই সালাম, বরকত প্রমুখ ভাষা শহীদরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ইতিহাস সৃষ্টি করে ভাষা আন্দোলকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যার ফলে আজ সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে।
শাসকের সকল অন্যায় আর জুলুম যখন সবাই মাথা পেতে নিয়ে মুখ বুজে সহ্য করে যায়; ছাত্রদের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই, তারা প্রতিবারই তার বিরুদ্ধাচারণ করেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেন। সারা পৃথিবীর ছাত্রদেরই প্রতিরোধের এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে যা সবার কাছে অসম্ভব মনে হয়, ছাত্র সমাজ জেগে উঠলে তা ধুলোর মতো উড়ে যায়। তাইতো যুগে যুগে ছাত্রদের আন্দোলনগুলো প্রতিবাদী জনতার অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থেকে গেছে এবং থেকে যাবে।
References:
1. https://yourstory.com/
2. https://biswabanglasangbad.com/
3. https://m.daily-bangladesh.com/
4. https://m.dailyinqilab.com/
5. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/
মন্তব্য লিখুন