সারাবিশ্ব আজ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে ভাবছে, আলোচনা-সমালোচনার পসার জমছে চায়ের দোকান, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা গণমাধ্যমে। এর কারণটাও সুস্পষ্ট, ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর মতামত ও ভাবনা বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
আমেরিকান নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগ্রহ থাকলেও মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই বিস্তারিত অজানা। আসুন এ সম্পর্কিত স্বচ্ছ কিছু ধারণা অর্জন করা যাক যাতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার জানার পরিধি আরও সমৃদ্ধ হয় । সেই সাথে বিসিএস এর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর কিছুটা প্রিপারেশন নেয়াও হয় -ঠিক যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তো চলুন শুরু করা যাক-
প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যার প্রথম পর্ব শুরু হয় ভোটগ্রহণের মাধ্যমে। আর এ পর্বের সূত্রপাত ঘটে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবারে। এ বছর নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার তেসরা নভেম্বর হওয়ার কারণে সেদিনই ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হয়।
আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাই যে, আওয়ামী লীগ বা বি.এন.পি সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দল যেখান থেকেই মূলত বেশিরভাগ সময়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেও এমনটা পরিলক্ষিত হয়; সে দেশের প্রেসিডেন্ট বেশিরভাগই নির্বাচিত হয়েছে প্রভাববিস্তারকারী প্রধান দুটি দল ড্যামোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টি থেকে।
ড্যামোক্র্যাটিক পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল (১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়) যারা উদারনীতি অবলম্বন করে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। নাগরিক অধিকার (সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সাশ্রয়ী শিক্ষা ব্যবস্থা, সমান অধিকার)পরিবেশ রক্ষা কিংবা অভিবাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের প্রশংসিত অবস্থান লক্ষণীয়।
সাধারণত ক্যালিফোর্নিয়াসহ বেশিরভাগ শহুরে এরিয়াগুলো ডেমোক্র্যাটিক। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, জিমি কার্টার, জন.এ.ফ কেনেডি সবাই ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ছিলেন। এই বছর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজয়ী জো বাইডেন (বারাক ওবামার সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট) হলেন ড্যামোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী।
গেটিসবার্গ ভাষণের প্রবক্তা বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা আব্রাহাম লিংকন এর কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু এই মহান রাজনীতিবিদ যে একজন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ছিলেন তা প্রায় মানুষেরই জানা নেই। প্রথমদিকের রিপাবলিকানদের দাশ প্রথার বিলোপসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ইস্যুতে অবদান অনস্বীকার্য হলেও একুশ শতকের আদর্শ কিছুটা ভিন্ন।
অভিবাসনে নিষেধাজ্ঞা,মুক্তবাজার পুঁজিবাদ, অস্ত্র অধিকার, গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপে রিপাবলিকানদের রক্ষণশীলতা প্রকাশ পায়। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, রিচার্ড নিক্সন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পও এ দলেরই প্রার্থী ছিলেন যিনি কিছুদিন আগে জো বাইডেন এর সাথে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থা পরোক্ষ ধরনের যেখানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের দু’ধরনের ভোট পেতে হয়। প্রথমটি হলো ‘পপুলার ভোট’ যা উপযুক্ত ভোটারগণ বা সাধারণ জনগণ প্রদান করে থাকে। অপরটি হলো ‘ইলেকটোরাল ভোট’ যাতে নির্বাচিত কর্মকর্তারা অংশ নিয়ে থাকেন।
সমগ্র জনগণের মোট ভোটকে বিবেচনা করেই বেশিরভাগ দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী ‘ইলেকটোরাল কলেজই’ নির্বাচনের তাসের তুরুপ। এই বিধান অনুসারে, কোন প্রার্থী যদি মোট ভোট বেশিও পেয়ে থাকেন কিন্তু ইলেকটোরাল ভোট কম পান তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। আর একারণেই ২০০০ সালে অ্যাল গোর জর্জ ডাব্লিউ বুশের চেয়ে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ও ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ট ট্রাম্প হতে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন নি।
কিছু ইলেকটোর বা নির্বাচকমন্ডলী যারা তাদের ভোট দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, তারাই ইলেকটোরাল কলেজ।
সেক্ষেত্রে যে রাজ্যের জনসংখ্যা যত বেশি, সে রাজ্যের ইলেকটোরদের সংখ্যাও তত বেশি। ৫৩৮ টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়াতে ৫৫, টেক্সাসে ৩৮, ফ্লোরিডায় ২৯, নিউইয়র্কে ২৯,ওয়াইওমিং, নর্থ ড্যাকোটা ও আলাস্কার হাতে ৩ টি করে ভোট রয়েছে।
একটি রাজ্যে যে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পপুলার ভোট’ লাভ করে, তাকে ঐ রাজ্যের ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ এর সবগুলো ভোট প্রদান করা হয় (ব্যতিক্রম: মাইন ও নেব্রাসকা রাজ্য)।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, যদি ফ্লোরিডায় ড্যামোক্র্যাটিক প্রার্থী ৫০.১% বা তার বেশি ‘পপুলার ভোট’ পায় তবে ফ্লোরিডার ২৯ টি ইলেকটোরাল ভোটই ঐ ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী পাবেন।
মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হতে হলে ৫৩৮ টি ইলেকটোরাল ভোটের কমপক্ষে ২৭০ টি জিততে হবেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইতিহাস বলে, বেশিরভাগ রাজ্যই নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটিক হিসেবে।
কিন্তু কিছু স্টেট আছে যেগুলোতে কোন দলের নির্দিষ্ট প্রাধান্য নেই, এসব স্টেটই ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ হিসেবে অধিক পরিচিত। টেক্সাস, ফ্লোরিডা, পেনসিলভেনিয়া, ওহাইও, মিশিগান, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, ভার্জিনিয়া, নিউক্যারোলাইনা, নিউহ্যাম্পশায়ার, নেভাডা, আইওয়া, মিনেসোটা, উইসকনসিন নামক অঙ্গরাজ্যগুলোই মূলত ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ যা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন -এ কেবল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই নয় বরং কংগ্রেসের সদস্যরাও (সিনেট ও লোয়ার হাউজের সদস্যরা) নির্বাচিত হন। ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্বের মার্কিন নাগরিকেরা ভোট দিতে পারে কিন্তু কিছু রাজ্যে পরিচয়পত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছুটা জটিল ও নিজস্ব পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার জন্যই প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়া পৃথিবীর অন্যান্য যেকোন দেশ হতে ভিন্ন। ২০২১ সালের ২০ শে জানুয়ারি দুপুর বারোটায় আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ বাক্য পাঠ করে জমকালো ‘অভিষেক’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিগত প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
মন্তব্য লিখুন