বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর নাম আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি শুনে থাকব। বিজ্ঞানের এই যুগে এখানকার অস্বাভাবিক ঘটনাগুলোর বর্ণনা পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা কষ্টসাধ্য। প্রচলিত বেশকিছু ঘটনা চমকপ্রদ হলেও এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেয়াও সম্ভব। কিছুক্ষেত্রে মূল ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করার দরুন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আজ ভয়ানক জায়গা হিসেবে পরিচিত।
মূলত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটা ত্রিভুজাকৃতির এলাকা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত যা ফ্লোরিডা, বারমুডা এবং পুয়ের্তো রিকোর অভ্যন্তরীণ জলভাগ নিয়ে গঠিত। একে ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল বা হারিকেন অ্যালিও বলা হয়।
ধারণা করা হয় এই ত্রিভুজাকৃতি এলাকায় নৌপথ কিংবা আকাশপথে যেকোন যান চলাচলই অনিরাপদ । কারণ হিসেবে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তিকে দায়ী করা হয়। কয়েকজন লেখকের মতে এ জায়গাকে কেন্দ্র করে চলে কোন গোপন ও নিষিদ্ধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। আর একারণেই উধাও হয়ে যায় এ অঞ্চল অতিক্রম করা যানবাহন।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ফ্লাইট ১৯ এর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর আমেরিকান নেভি পরিচালিত TBM Avenger Torpedo Bombers এর ৫টি ট্রেইনিং বিমান ফ্লোরিডা থেকে যাত্রা করার পর ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় নিখোঁজ হয়ে যায়। ফ্লাইটের ১৪ জন অফিসার এবং ১৩ জন ক্রু মেম্বারদের সবাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কিছু লেখকের মতে ফ্লাইট ১৯ এর দলনেতার বলা শেষ কথা ছিল “আমরা কোথায় আছি জানিনা। এখানকার পানি সবুজ, সাদা নয়। আমরা সাদা ধোঁয়া কিংবা কুয়াশার দিকে যাচ্ছি।” যদিও তদন্তকারী দলের মতে ফ্লাইটটির জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ায় বিমানগুলো আকাশেই বিস্ফোরিত হয়ে যায়।
তবে অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাই অধিক প্রচলিত। এছাড়াও বেশ কয়েকটি জলযানের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ জনসাধারণের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিল। কেবল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাই নয়, কম্পাসের ভুল দিক নির্দেশের কথাও শোনা যায়।
আরও পড়ুনঃ নতুন গ্রহাণু আবিষ্কার করলো ভারতের দুই কিশোরী
এবার আসি কিছু বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এমন একটি ভৌগোলিক সীমানায় অবস্থিত যা ভয়াবহ হারিকেনের ও সাইক্লোনের জন্য আদর্শ স্থান। এখানকার জলবায়ু প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অনূকূল। এক্ষেত্রে জলযানগুলোর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে জলবায়ুকে দায়ী করা যায়।
আবার কম্পাসের ভুল দিকনির্দেশের ঘটনা ঘটে শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ডের জন্য। উত্তর আটলান্টিকে প্রবাহিত হচ্ছে গালফ্ স্ট্রিম যা মূলত একটি বৃহৎ বিদ্যুতায়িত পৃষ্ঠতল। একারণে আকারে ছোট বিমান কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌযান বিদ্যুৎ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এধরনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলো খুব একটা প্রচলিত না হওয়ায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির আধার বলে ধারণা করা হয়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুখ্যাতির জন্য মানুষের অতিরঞ্জিত বর্ণনার ভূমিকাই অধিক। মূল ঘটনাকে বাড়িয়ে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা হয় যা সাধারণ মানুষ বেশি পছন্দ করে। এমনকি কিছু কিছু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বাস্তবে ঘটেইনি। নির্ধারিত সময়ে এই নির্দিষ্ট সমুদ্রসীমায় যাওয়া কোন জাহাজ বন্দরে পৌঁছাতে না পারলেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল দায়ী করা হত।
অথচ দেরিতে হলেও সেসব জাহাজ বন্দরে পৌঁছাতে পেরেছিল। ১৯৩৭ সালের একটি বিমান দুর্ঘটনায় ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল এর অতিপ্রাকৃত ব্যাপারকে দায়ী করা হয় যা কখনোই প্রমাণিত হয়নি।
এছাড়াও ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর ন্যাচার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পৃথিবীর বিপদজনক ১০টি সমুদ্রসীমার সে তালিকায় বারমুডা ট্রায়াংগেলের নাম ছিল না।
পৃথিবীতে হয়তো ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে। কিংবা হয়তো আমরা নিজেরাই সাধারণ ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করি। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। আমরা বিজ্ঞানসম্মত সম্ভাবনাগুলোকে আমলে না নিয়ে অতিপ্রাকৃত বর্ণনাকেই প্রাধান্য দেই।
কারণ মানুষ অসাধারণ ও অস্বাভাবিক বিষয়গুলো জানতেই বেশি আগ্রহী। তবে ফ্লাইট ১৯ এর দলনেতার বলা শেষ কথাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সেটি ভাবনার বিষয়। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর ব্যাপারে আমরা পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবো।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, The Bermuda Triangle mystery: Solved (1975)
সুন্দর হইছে!