বিখ্যাত হতে কে না চায় বলুন? আপনি যদি বিখ্যাত হয়ে যান তাহলে লোকে আপনাকে বাহবা দেবে, আপনার প্রশংসা করবে। লোকের মুখে নিজের প্রশংসা শুনলে গর্ব তো হবেই। তাই বিখ্যাত হবার জন্য লোকে কত অদ্ভুত কাজই না করে থাকে। আবার কখনো কখনো মানুষ নিজের অজান্তেই এমন অনেক ব্যতিক্রমী কাজ করে ফেলে যে শুধু আশেপাশের লোকেরাই নয় পুরো বিশ্বই তাকে বাহবা দেয়। পেয়ে যায় বিশ্বরেকর্ড গড়ার সুযোগ। আর শুধু মানুষ নয় কখনো কখনো প্রকৃতিও এমন অনেক অদ্ভুত কাজ করে ফেলে যা নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে।
বিশ্বরেকর্ড এর কথা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। আর তার সাথে ‘গিনেস বুক’ নামটিও শুনেছেন নিশ্চয়। গিনেস বুক হলো একটি বার্ষিক প্রকাশনা বিশেষ।️ যেখানে মানুষের কৃত সকল ব্যতিক্রমী কাজের রেকর্ড উল্লেখ থাকে। এছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম, দীর্ঘতম, ক্ষুদ্রতম, সর্বোচ্চ, সর্বনিম্ন ইত্যাদি সকল কিছু তালিকাবদ্ধ রাখে গিনেস বুক কর্তৃপক্ষ। তারা যখন স্বীকৃতি দেয়, তখনই কেবল কোনো বিশ্বরেকর্ড পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়।
চলুন আজ এই গিনেস বুকের উদ্ভাবনের ইতিহাস ও বাংলাদেশের কয়েকটি গিনেস বিশ্ব রেকর্ড সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
১৯৫৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এই বইটি। ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি “দ্য গিনেস বুক অব রেকর্ডস” নামে পরিচিত ছিল। ২০০০ সালের পর থেকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস নামে পরিচিতি পায়।
১৯৫১ সালে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে ইউরোপের দ্রুততম শিকারি পাখি কোনটি, এ নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন গিনেস ব্রেওয়ারিজের তৎকালীন পরিচালক হিউজ বিভের। তখন তিনি ভাবতে শুরু করেন যে, এমন হাজারো অমিমাংশিত প্রশ্ন আছে যার পরিষ্কার উত্তর নেই। এ বিষয়ে বাজারে কোনো বইও নেই যে লোকে এ বিষয়ে জানতে পারবে।
তিনি তখন চিন্তা শুরু করলেন, যদি এমন একটা বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের রেকর্ডের সম্পূর্ণ তথ্য থাকবে, তবে তা বেশ জনপ্রিয়তা পাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ হিউজ বিভের তার বন্ধু নরিস এবং রস হুটিয়ান এর সাথে যোগাযোগ করেন যারা সে সময় একটি এজেন্সি চালাতেন।
এজেন্সির কাজ ছিল নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহে রাখা।তারা তিন জন মিলে️ ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট ১৯৮ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও রেকর্ড সংকলিত হয়েছিল।
এটিই ছিলো গিনেস বুকের প্রথম প্রকাশিত বই। প্রকাশের পর এই বইটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে এই বইটি বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের রেকর্ড গড়ে। এ ছাড়া বইটি যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরিগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি চুরি যাওয়া বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে প্রতিবছর ইংরেজি, আরবি, পর্তুগিজসহ ২৮ টি ভাষায় প্রকাশিত হয় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইটি।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সকল ব্যতিক্রমী কাজের রেকর্ড প্রতি বছর সংকলিত হয় এই বইয়ে। আমাদের বাংলাদেশর এমন বেশ কিছু রেকর্ড গড়ে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গিনেস বিশ্বরেকর্ড -টি হলো বঙ্গবন্ধুর শস্যচিত্র। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বগুড়ার শেরপুরের বালেন্দা গ্রামে ধানের খেতে তৈরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে, সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র (লার্জেস্ট ক্রপ ফিল্ড মোজাইক) ক্যাটাগরিতে। ১০০ বিঘা জমিতে দুই জাতের ধান (সবুজ ও বেগুনি ) লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় এই প্রতিকৃতি।বেগুনি ধানের চারাগুলো চীন থেকে আনা এবং সবুজ ধানের চারাগুলো আমাদের দেশি প্রজাতির।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা দিবসে রাজধানীর তেজগাঁও জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে, জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। সেদিন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষ অংশগ্রহণ করে একসঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সেদিন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের আকাশ-বাতাস ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এই সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
একত্রে এত মানুষের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের এই কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচার করা হয় যার ফলে বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পরে এই সুরের ছোয়া।
সেদিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন,রাজনৈতিক সংগঠন, পোশাক ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের কর্মীসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্যারেড মাঠে একত্রিত হয়ে জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলান। ওই দিনের কর্মসূচির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
২০১৭ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একত্রিত হন ১ হাজার ১৮৬ সাইক্লিস্ট। তাদের লক্ষ্য সাইকেল চালিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া, বিজয় দিবসে দেশের জন্য আরেকটি সন্মান অর্জন করা। সাইকেলিস্টরা জড়ো হয়ে ৩০০ ফিটের একটি লাইন তৈরি করেন।
ফলে ‘লংগেস্ট সিংগেল লাইন অব বাইসাইকেল মুভিং’ ক্যাটাগরিতে যুক্ত হয় আরেকটি “বাংলাদেশর গিনেস বিশ্ব রেকর্ড“। দুই হাজারের বেশি সাইক্লিস্টের তালিকা থেকে গিনেস বুক কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ১৮৬ সাইক্লিস্টকে নির্বাচন করেন, যারা এই রেকর্ড তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন।এই বিশ্ব রেকর্ড গড়ার সার্বিক আয়োজনে ছিলো বাংলাদেশের সুপরিচিত সাইকেল সংগঠন বিডি সাইকেলিস্ট।
গিনেস রেকর্ড বুকে ‘লংগেস্ট সিংগেল লাইন অব বাইসাইকেল মুভিং’ ক্যাটাগরিতে নাম লেখাবার জন্য কমপক্ষে এক হাজার সাইক্লিস্টকে এক লাইনে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালাতে হয়। এই নিয়ম মেনে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় বিডি সাইকেলিস্টরা। বাংলাদেশের আগে এই রেকর্ডটি ছিল বসনিয়ার দখলে। ২০১৫ সালে বসনিয়ান সাইকেলিং ফেডারেশন ২০টি দেশের সাইকেলিস্টদের নিয়ে এই রেকর্ড গড়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে ১৬ বার জিতে সবচেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন টেবিল টেনিস খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু।
জোবেরা রহমান লিনু’র হাত ধরেই প্রথমবারের মত গিনেস বুকে নাম ওঠে বাংলাদেশের।২০০২ সালের ২৪ মে লিনুকে এই সম্মান প্রদান করা হয়। লিনুই প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে গিনেস বুকে জায়গা করে নেন।জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় ১৯৭৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে এ সন্মাননা অর্জন করেন তিনি।এজন্য তিনি টেবিল টেনিসের সম্রাজ্ঞী হিসেবেও পরিচিত।
জোবেরা রহমান লিনু’র জন্ম ১৯৬৫ সালের ৯ জুন চট্টগ্রামের কাপ্তাইতে।তার বড় বোনও একজন টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। বোন ও বাবার কাছেই টেবিল টেনিসে তার হাতেখড়ি হয়।
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০১০ এর মতে, তখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ঘনত্বের দেশ ছিলো বাংলাদেশ। তাই সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ঘনত্বের দেশ হিসেবে বিশ্বরেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ।
২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার। দেশটির আয়তন ৫৫ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার। সেই হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করতেন ২,৯১৮ জন যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বাস করে না।
২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে যুক্ত হয় বাংলাদেশের আরও একটি গিনেস বিশ্ব রেকর্ড। হাত ধুয়ে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। হাত ধোয়ার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউনিসেফ, লাইফবয় ও ব্র্যাকের সম্মিলিত উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়েছিল।সেদিন ৫২৯৭০ জন মানুষ একসঙ্গে হাত ধুয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে ছিলেন।
একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো বাংলাদেশ। আর সেজন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশ।
মরিচের নাম ভুতজ্বলকিয়া বা নাগা মরিচ।জন্মস্থান বাংলাদেশ, ভারতের আসাম,মিজুরাম ও নাগাল্যান্ড।তবে বর্তমানে মরিচটি তার রেকর্ড হারিয়েছ। অস্ট্রেলিয়ার ত্রিনেদাদ স্কোরপিয়ন বুজটি মরিচ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ।
আমাদের দেশের পুরুষদের গড় ওজন প্রতি মিটার স্কয়ারে ২০.৫ কেজি এবং নারীদের ক্ষেত্রে এটি ২০.৪ কেজি। বি এম আই সুচক অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশিরাই বিশ্বের সবচেয়ে কম ওজনের জাতি এবং সবচেয়ে মোটা জাতি হলো দ্বিপ দেশ নাউরুর জনগণ।
১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল গোপালগঞ্জে এক ভয়ংকর শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। সেই সময় যে শিল পড়েছিল তার কোনো কোনোটির ওজন ছিল প্রায় এক কেজি। বিশ্বের কোথাও এত বেশি ওজনের শিলাপাত হয়নি। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিলার গিনেস বিশ্ব রেকর্ড বাংলাদেশের। ওই দিন ৯২ জন নিহত হয়েছিলেন।
২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা’ প্রকাশের জন্য এক কর্মসূচির আয়োজন করে। এই কর্মসূচিতে ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ একজন আরেকজনের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব শিকলের মর্যাদা পায়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এই মানব শিকলের দৈর্ঘ্য ছিল ১,০৫০ কিলোমিটার।
২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর ওয়াল্টনের ব্যানারে মাথায় ফুটবল নিয়ে দ্রুততম সময়ে রোলার স্কেটের উপর দাঁড়িয়ে ১০০ মিটার দূরত্ব অতিক্রমের বিশ্বরেকর্ড করেন আব্দুল হালিম। এতে তার সময় লাগে মাত্র ২৭.৬৬ সেকেন্ড। তিনি ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এই নৈপুণ্য দেখান। ২০১৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাকে এই সম্মাননা প্রদান করে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাটের দৈর্ঘ্য ১১১ ফুট ও প্রস্থ ১২.৫ ফুট। আর সবচেয়ে বড় ব্যাট তৈরির মাধ্যমে তৈরি বাংলাদেশের আরও একটি “গিনেস বিশ্ব রেকর্ড”। বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহনেওয়াজ হলের ৬৭ জন ছাত্র মিলে ১৫ দিনে তৈরি করেছিল সবচেয়ে বড় এই ব্যাটটি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগরের গিনেস বিশ্ব রেকর্ডও বাংলাদেশের। গিনেস বুক মতে, বঙ্গোপসাগরের আয়তন ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার। যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর।
খন্দকার শিহাব আহম্মেদের মাধ্যেমে আসে বাংলাদেশের আরেকটি “গিনেস বিশ্ব রেকর্ড”। খন্দকার শিহাব আহম্মেদে নামের এক ছাত্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ট্যাপলার পিনের চেইন তৈরি করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে। তার তৈরিকৃত চেইনটির দৈর্ঘ ৪২০ ফুট। শিহাব ২৭০০০ টি পিন ব্যবহার করে তৈরি করেছেন এই চেইন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ২৭০ টাকা।
বগুড়ার মোহম্মদ রজব আলী গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন “সুপার গ্র্যান্ড ফাদার” হিসেবে।১১৫ বছর বয়সে মারা যাওয়া রজব আলীর নাতি-নাতনীর সংখ্যা প্রায় ৫০০ এরও বেশি।
এই ছিলো বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ব রেকর্ড যা গিনেস বুকে জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও আরো বেশ কিছু রেকর্ড আছে যেগুলো হয়তো অন্য কোনোদিন লিখবো।
মন্তব্য লিখুন