জল্পনা কল্পনা এবং মাসব্যাপী নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে ২৭শে অক্টোবর, ২০২২ টুইটারের মালিকানা গ্রহণ করলেন ইলন মাস্ক। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠার অন্ত নেই নেট পাড়ায়। টুইটারের লাগাম ধরার সাথে সাথে গণমাধ্যমগুলোতে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ” ভবিষ্যতে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটির সাথে কী করার পরিকল্পনা করছেন মিঃ মাস্ক?”
টুইটার নিয়ে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন তবে কীভাবে সেগুলি সম্পাদন করার পরিকল্পনা করছেন তার বিশদ বিবরণ কমই দিয়েছেন।
ইলন মাস্ক টুইটার -কে প্রাইভেট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেছেন। যার ফলে তাকে নিয়মিত শেয়ারহোল্ডারদের উত্তর দেয়ার মত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রশ্নই আসে না। তিনি কীভাবে কাজ করছেন তা প্রকাশ না করেই টুইটার রিমেক করবেন এবং জনসাধারণের চোখের আড়ালেই পরিষেবাতে পরিবর্তন আনবেন।
গত এপ্রিলে মিঃ মাস্ক বিবৃতি প্রদান করেন “টুইটারের অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে, আমি সেটিকে আনলক করার জন্য কোম্পানি এবং ব্যবহারকারী সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করার জন্য উন্মুখ।” তখন তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কেনার চুক্তিও করেন।
তিনি টুইটারের কন্টেন্টে সংযমতার নীতিগুলি তুলে নেয়া, স্প্যাম দূর করা, নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা এবং পন্য সামগ্রী প্রচারের জন্য ব্যবহৃত অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
কয়েক সপ্তাহ পরেই তিনি এই চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। তিরস্কার করেন টুইটারের আধিকারিকদের। এছাড়াও প্ল্যাটফর্মের স্প্যাম অ্যাকাউন্টগুলোর সঠিকভাবে গণনা করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনেন। তবে টুইটারের চিফ এক্সিকিউটিভ পরাগ আগারওয়াল বিষয়টিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন।
তখন মিঃ মাস্ক একটি পপ ইমোজি টুইট করে প্রতিক্রিয়া জানান। জুলাইয়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন এবং ঘোষণা করেন তিনি আর টুইটারের মালিক হতে চান না।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় টুইটার মিঃ মাস্কের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি ডেলাওয়্যার চ্যান্সারি আদালতে তোলা হয়, যেখানে অনেক কর্পোরেট মামলার শুনানি হয়ে থাকে। আদালত মামলার শুনানির জন্য অক্টোবরের মাঝামাঝি পাঁচ দিন ধার্য করেন।
৪ অক্টোবর জবানবন্দির দিন মিঃ মাস্ক পুনর্বিবেচনার আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ নেন। তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির ছাড় নিয়ে আলোচনা করেন এবং 33 বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রস্তাব করেন। যেটা গ্রহণ করা হয়নি।
অগত্যা মিঃ মাস্ক জানান, যদি টুইটার তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই বন্ধ করে তবে তিনি আসল মূল্যে অধিগ্রহণ করবেন।
ফলস্বরূপ মামলার তত্ত্বাবধানকারী বিচারক ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটি স্থগিত রাখতে রাজি হন।
নেট জগতের বাসিন্দাদের আশ্চর্য করে ইলন মাস্ক ২৭ অক্টোবর, ২০২২ সম্পূর্ণ ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেন টুইটার।
চুক্তিটি সম্পন্ন করতে পারাটা টুইটারের বোর্ডের জন্য একপ্রকার বিজয়স্বরূপ। এপ্রিল মাসে ইলন মাস্ক কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি ৫৪.২০ ডলার দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এত কম দামের জন্য তখন টুইটার সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতির পতন এবং টুইটারের স্টক কমে যাওয়ায় চুক্তির মূল্য শেয়ারহোল্ডারদের জন্য পর্যাপ্ত বলে মনে হয়। একারনে তারা মিঃ মাস্কের নিকট শেয়ার বিক্রির চুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। ৮ নভেম্বর, ২০২২ থেকে টুইটার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বহির্ভূত বলে গন্য হবে।
পূর্বে টুইটারে প্রায় ৭,৫০০ কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিলো। কিন্তু ইলন মাস্ক টুইটারের মালিকানা গ্রহণ করার পর কর্মী কমানো এবং টুইটার থেকে অর্থ উপার্জনের নতুন উপায় অনুসন্ধান সহ অন্যান্য ব্যাপক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই টুইটারের প্রধান নির্বাহী “পরাগ আগারওয়াল”, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা “নেড সেগাল” এবং শীর্ষ আইনি ও নীতি নির্বাহী “বিজয়া গাড্ডে”কে বহিষ্কার করা হয়েছে।
CNN এর তথ্যানুসারে তিন নির্বাহীকে বহিষ্কার করার জন্য ইলন মাস্ককে গুনতে হতে পারে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।
সিবিএস নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ৪ নভেম্বর, শুক্রবার, টুইটারের প্রায় ৩৭০০ কর্মীকে ছাটাই করা হয়েছে। কারন হিসেবে জানানো হয়েছে টুইটার অতিরিক্ত ব্যয় করছে কর্মীদের পেছনে।
টুইটার অধিগ্রহণের জন্য মাস্কের অর্থায়নে ১২.৫ বিলিয়ন ব্যাঙ্ক ঋণ রয়েছে যা টুইটারের ব্যালেন্স শীটে বসানো হয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে টুইটারে প্রায় ১২৪ মিলিয়ন ডলারের নেতিবাচক ফ্রি ক্যাশফ্লো তৈরি করেছে।
কর্মীছাটাই প্রসংগে মিঃ মাস্ক ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলেছেন তার এবং বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন সেজন্য আরো কাঠ কাটা বাকি আছে।
টুইটারে আইডি ভেরিফাই সিস্টেম চালু হয় ২০০৯ সালে। মূলত এর দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির আইডির প্রমান বা সত্যতা যাচাই করার জন্যই ” ব্লু চেক” এর উৎপত্তি হয়েছিলো। ইলন মাস্ক টুইটার অধিগ্রহণের পর “ব্লু চেক ” সিস্টেমে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন।
“ব্লু চেক” ধারী একাউন্টগুলোকে হয়তোবা মাস শেষে গুনতে হতে পারে $৮ ডলার। বিনিময়ে ব্যবহারকারী পাবেন বিশেষ কিছু সুবিধা। যেমনঃ তাদের টুইটগুলো বুস্ট হয়ে অধিক ব্যবহারকারীদের নিকট পৌছে যাবে। থাকবে দীর্ঘ ভিডিও এবং অডিও শেয়ার করার অপশন। পরবর্তীতে আরো পরিসেবা যুক্ত হতে পারে।
মিঃ মাস্ক টুইটারের জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যও স্থির করেছেন বলে জানিয়েছেন। টুইটারকে তিনি একটি সুপার অ্যাপে রুপান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যেটা হবে ” Everything App” এবং নাম হতে পারে “X”। জুন মাসে টুইটার কর্মীদের সাথে হওয়া একটি বৈঠকে মাস্ক বলেছিলেন টুইটার চাইনিজ ওয়েচ্যাটের মতো হওয়া উচিত। প্লাটফর্মটি এমন হবে যা তাৎক্ষণিক বার্তাপ্রেরণ করবে, সোশ্যাল মিডিয়ার কাজ করবে এবং মোবাইল পেমেন্ট করতে সক্ষম হবে।
টুইটার অধিগ্রহণের আগে মিঃ মাস্ক ইচ্ছা প্রকাশ করেন ২০২৮ সালের মধ্যে টুইটারের বার্ষিক আয় ২৬.৪ বিলিয়ন করতে চান। যার ৯০% আসবে বিজ্ঞাপনের অ্যাকাউন্ট থেকে। এছাড়াও রয়েছে বহুমুখী পরিকল্পনা। যেমনঃ
১. টুইটারের প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন পরিষেবাটিকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা।
২. টুইটারে পেমেন্ট ব্যবসা।
৩. বাণিজ্যিক এবং সরকারী ব্যবহারকারীদের জন্য সামান্য ফি চার্জ করা।
৪. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধারণ করা বা ভাইরাল হওয়া টুইটগুলি থেকে অর্থোপার্জনের উপায় খুঁজে বের করা।
মিঃ মাস্ক বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন বিবৃতিতে জানান তিনি
“বাক স্বাধীনতা নিরঙ্কুশবাদী”
“মানবতার জন্য টুইটার কিনছেন”
“টুইটারকে সবার জন্য উন্মুক্ত করবেন”
“টুইটার হবে সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য একটি সাধারণ ডিজিটাল টাউন স্কোয়ার, যেখানে সহিংসতার অবলম্বন না করেই স্বাস্থ্যকর উপায়ে বিস্তৃত বিশ্বাস নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে”
“নিষিদ্ধ একাউন্টগুলোর উপর থেকে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারেন”
তার সকল বিবৃতি অনুযায়ী নেটিজেনরা আশঙ্কা করছেন হয়তো সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাউন্টও পুনরুদ্ধার হতে পারে।
সবার জন্য মুক্ত হওয়ায় টুইটারের পরিবেশ নেতিবাচক বা বিতর্কিত হতে পারে। ডানপন্থী এবং বামপন্থী রাজনৈতিকতার শিকার হতে পারে প্লাটফর্মটি। যার ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের বিনিয়োগ বিবেচনায় অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
মন্তব্যঃ
মিঃ মাস্ক টুইটার নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। তিনি টুইটারের এলগরিদম পরিবর্তন এবং বট একাউন্টগুলো বন্ধকরনে প্রাধান্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে শুরুতে যেমনটা মানবিকতার প্রকাশ করেছেন এবং বর্তমানে কর্মীদের সাথে যে অমানবিকতা করছেন অনেকটাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কর্পোরেট জগতের ভবিষ্যৎ পূর্বানুমান করাটা জটিল।
টুইটার সময়োপযোগী সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম হোক সেটাই কাম্য।
মন্তব্য লিখুন