টান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হল যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন । টানা চার দিন ধরে কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে জাহির করবে তার সমীকরণ মিলাতে পারছিলেন না বিশেষজ্ঞরা । অবশেষে ২৯০ টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন হার না মানা জো বাইডেন । কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি নির্বাচনের আকর্ষিকতা , ভারতীয় বংশ উদ্ভুত কমলা হ্যারিস কে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিলেন জো বাইডেন । চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক কমলা হ্যারিস এর সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
কমলা হ্যারিস, পুরো নাম কমলা ডেভি হ্যারিস। ১৯৬৪ সালে ২০ অক্টোবর ওকল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহন করেন । তার কৃষ্ণাঙ্গ বাবা ডনাল্ড হ্যারিস একজন জ্যামাইকান ( জ্যামাইকা ক্যারাবীয়ান সাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপদেশ )। তিনি স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন । তার মা শ্যামলা গোপালান ছিলেন ভারতীয় এক কূটনীতিবীদের কন্যা । পেশায় ছিলেন একজন ক্যান্সার গবেষক এবং একজন মানবাধিকার কর্মী । তার ছোট বোন মায়া একজন অ্যাডভোকেট।
চিত্রঃ কমলা এবং তার মা-বাবা
কমলার বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তার পাঁচ বছর বয়সেই । সে তারপর তার মায়ের আদর্শেই লালিত পালিত হতে থাকে । সে বড় হতে থাকে ভারতীয় ঐতিহ্য কে লালন করে । কিন্তু কমলা হারিস মতে তার মা ওকল্যান্ডের ব্ল্যাক কালচার কে আপন করে দুই মেয়ে কমলা ও মায়া কে সাথে নিয়ে বড় করে তুলেছেন ।
এ বিষয়ে কমলা হ্যারিস তার বায়োগ্রাফি “দ্যা ট্রুথ উই হোল্ড ” এ লিখেন “ আমার মা ভালোভাবে বুঝেছিলেন যে সে তার দুই কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে বড় করে তুলছেন । সে জানত তার আশ্রিত জন্মভূমি আমাকে এবং মায়াকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই দেখবে । সে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন আমরা যেন আত্মবিশ্বাসের সাথে বড় হই এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে গর্ব বোধ করি। ”
চিত্রঃ কমলা , ছোট বোন মায়া এবং তারদের মা শ্যামলা
কমলা সর্বপ্রথম Thousand Oaks Elementary School এ তার স্কুল জীবন শুরু করেন । যখন তার বয়স ১২, তখন সে তার মায়ের সাথে পরিবার সমেত কানাডায় বসবাস শুরু করেন ।
কমলা ও তার ছোট বোন মায়া পাঁচ বছর মন্ট্রিলে অবস্থিত স্কুলে পড়াশুনা করেন। তার মা মন্ট্রিলে Notre Dame des Neiges স্কুলে তাদের ভর্তি করান কারন তার মা চেয়েছিলেন সে আর তার বোন যেন ফরাসি ভাষা রপ্ত করে। এরপর কমলা হ্যারিস ওয়েস্টমাউন্ট হই স্কুল এ পড়াশুনা শুরু করেন যেখান থেকে তিনি ১৯৮১ সালে গ্রাজুয়েট হন ।
পরে তিনি হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করেন । হেস্টিংস কলেজ থেকে তার আইনবিদ্যার ওপর একটি ডিগ্রীও রয়েছে।
তিনি ২২ শে আগস্ট ২০১৪ সালে আইনজীবী ডগলাস এমহফ কে বিবাহ করেন এবং এমহফের দুটি সন্তান কে স্টেপ চাইল্ড হিসেবে গ্রহন করেন। প্রাক্তন স্ত্রী কার্স্টিনের সাথে এমহফের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় । এমহফের পুত্র “কোল” কলোরাডো কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছে । এবং তার ছোট কন্যা “এলা” পারসন স্কুল থেকে ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা করছে । এলা এবং কোল সৎমা কমলা কে আদর করে ‘Momala’ বলে ডাকে ।
কমলা ওকল্যান্ডে সহকারী আইনজীবী হিসেবে তার কর্ম জীবন শুরু করেন। তিনি আইনজীবী হিসেবে মাদাক , যৌন হয়রানি এবং বিভিন্ন সহিংস্রতার বিরুদ্ধে অটল থাকায় খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মূলত শিশু যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে জোর দেন ।
২০০৩ সালে তিনি সান ফ্রান্সিস্কতে জেলা অ্যাটর্নি হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনিই সর্বপ্রথম নারী এবং সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হন । বলাবাহুল্য তিনি তার এই অবস্থান ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধরে রাখেন। ২০১০ এবং ২০১৪ সালে তিনি পরপর দুইবার ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হন।
২০১৭ সালে কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ায় ইউনাইটেড স্টেট্স সেনেটর হিসেবে শপথ গ্রহন করেন। এখানেও তিনিই ছিলেন ইতিহাসের প্রথম সাউথ এশিয়ান – আমেরিকান এবং দ্বিতীয় আফ্রিকান – আমেরিকান নারী । কমলা নিজেকে হোম ল্যান্ড সিকিউরিটি এবং সরকারী বিভিন্ন বিষয়ক কমিটিতে নিজেকে নিযুক্ত করেন।
কমলা একদম নিচ থেকে ধাপে ধাপে উপরে উঠে আসেন । তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছা সমাদৃত হয় সবখানেই। আইনজীবী হিসেবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি কখন। সবসময় তার মায়ের আদর্শ মাথায় নিয়ে কাজ করে গেছেন কৃষ্ণাঙ্গ নিপীড়নের বিরুদ্ধে ।
তার লেখা দুটি বই ২০১৯ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় । একটি তার পার্সোনাল রিলেশনশিপ নিয়ে লেখা The Truths We Hold এবং অন্যটি ছোটদের জন্য লেখা Superheroes Are Everywhere ।
২০০৯ সালে প্রকাশ পাওয়া Smart on Crime বইটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে অপরাধ মুক্ত করতে কমলা হ্যারিসের লেখা বই । বইটিতে তার তত্ত ও ধারনা প্রকাশ করে কিভাবে দেশকে অপরাধ মুক্ত করা যায় তার একটা সমাধান দিয়েছেন ।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদীতার দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে নতুন নয়। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনা সারা আমেরিকাকে আন্দোলিত করছে । রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন এর প্রভাব নির্বাচনে পরতে চলেছে ।
ট্রাম্পের বিভিন্ন বর্ণবাদী কর্মকাণ্ড এবং এক ঘেয়েমিতা অ্যামেরিকা বাসীদের মধ্যে জন্ম দিয়েছিল হতাশা । মহামারী করোনার মধ্যে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক মনেভাব, লাখো মানুষের প্রান হারানো এবং বেকারত্ব মানুষকে ট্রাম্প বিমুখী করে তুলে ।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করতেন কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশীয়দের ভোট বাইডেন-কমলার পকেটে যাবে । এবং হল ও তাই জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন। সাথে সাথে অ্যামেরিকার ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন কমলা হ্যারিস ।
কমলা সবসময় ছিলেন নারীর এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে । তার মা-ই তাকে এই আদর্শে বড় করে তোলেন । তিনি ছিলেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন সফল আইনজীবী । বাইডেন কে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ ভোট পাইয়ে দিতে সহয়তা করেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই মহীয়সী নারী । উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে অ্যামেরিকাকে কতটা সহিংসতা মুক্ত করতে পারবেন সেটিই এখন আলোচ্য বিষয় । তার দেয়া বক্তবেই এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ।
‘I may be the first, but won’t be the last’ – Kamala Harris
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ bbc.com, britannica.com, oneindia.com
মন্তব্য লিখুন