যথাযথ নিয়ম মেনে হিজাব পরিধান না করায় ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি ইরানের নীতি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনদিন পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ পুলিশের হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর হতে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তাল।
ইরানের বিভিন্ন শহর, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালগুলিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। মানবাধিকার গ্রুপ গুলির মতে এসব ঘটনায় ইরানে এখন পর্যন্ত ৪৭ শিশু সহ ৩৭৮ জনের মারা গেছেন,আটক করা হয়েছে আরো অনেককে। নারী আন্দোলন ইরানে আগে এমনটা ঘটেনি।
সমস্যার কেন্দ্রে ইরানের পোশাক নীতি। এই নীতিগুলি (ড্রেসকোড)ইসলামী বিপ্লবের (১৯৭৯) পরে ১৯৮৩ সালে তৈরি করা হয়। নীতি পুলিশের কাজ বিধানগুলো মেনে চলা হচ্ছে কি না রাস্তাঘাটে ঘুরে তা দেখভাল করা। এই প্রক্রিয়ায় আটক হন মাসা আমিনি।
বিপ্লব পুর্ববর্তী সময়ে রেজা শাহ পাহলভীর শাসনকালে কয়েক দশক ধরে ইরানি জীবনধারা ব্যাপকভাবে পাশ্চাত্য রীতির অনুসারী ছিল। সে ধারা খোলা মেলা পোশাক সহ নানা বিকৃতিও (মদ জুয়া নাইট ক্লাব) উদযাপন করে।
বিপ্লবের পর গঠিত ইসলামী সরকার এই ধারায় আমুল পরিবর্তন আনেন তবে পুরোনো প্রথাকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়নি। নারীর জন্য চুল ঢেকে রাখা হিজাব পরিধান করা এবং পরিহিত কোট হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ও যথেষ্ঠ পরিমাণে ঢিলেঢালা হওয়ার -যেন শরীরের গঠন বোঝা না যায় -বিধান চালু করা হয়।
ইরানের নারী সমাজ শুরু হতে এতটা কঠোরতার বিরোধী ছিলেন। তারা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও করেন। কাজেই হিজাব বিরোধী নারী আন্দোলন এর একটা প্রাথমিক পরিবেশ সেখানে ছিল। এরপর মাসা আমিনীর মৃত্যু ব্যাপারটাকে উস্কে দেয়।
ইরানে নারীর পোশাক বিধির পেছনে ক্রিয়াশীল ধর্মীয় সংষ্কৃতি। এই সংষ্কৃতি নারী -কে প্রধানতঃ ভোগের বস্তু, দুর্বল ও পুরষের উপরে নির্ভরশীল বলে মনে করে। এই ধারণা থেকে উৎপত্তি ঘটে লম্বা ঢিলেঢালা ও আগামাথা মোড়ানো পোশাকের যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায় ।
দর্শনটা হল আমি যাকে দেখি, ভোগ বা ব্যবহার করি সে নিতান্তই আমার। স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে তাকে অন্যদের থেকে সর্বোতভাবে দুরে রাখতে হবে। অন্যথা হলে সম্মান অহমিকা ও স্বার্থের ভরাডুবি হয় যা সামন্তবাদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। এই মানসিকতা নারী -কে অন্য কোন পুরুষের দৃষ্টিতে পড়তে দিতে চায়না।
এসব এড়াতেই তার ঘরে থাকা আর বাইরে গেলে ঘেরাটোপের মধ্যে ঢোকা দরকার। চিন্তা ভাবনাগুলি রিপুভিত্তিক ও পুরুষতান্ত্রিক; এখনো অনেক সক্রিয় ,অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার জট সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে যে, প্রকৃতই পোশাকের জন্য কোন বিধান থাকা উচিৎ কি না। বিধি বিধান দরকার হলে কারা ও কীভাবে তা স্থির করবে, মাপকাঠি কী হবে। এসব স্থির করার ক্ষেত্রে পোশাকধারীর কোন ভুমিকা থাকবে কিনা। পোশাক বিধি তৈরির ক্ষেত্রে এসব মৌলিক প্রসংগ ইরান এড়িয়ে গেছে।
মোল্লা তন্ত্রের ধারণা ছিল একটি ‘দুর্বল’ ও আবদ্ধ জনগোষ্ঠীর পক্ষে খুব বেশী কিছু করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু যখন তা সম্ভব হওয়ার পথে তখন এর পেছনে তারা বিদেশী ইন্ধনের গন্ধ আবিষ্কার করেন। অবশ্য এতে কোন লাভ হয়নি। পোশাকের বিষয়ে সামজিক বিধান থাকা উচিৎ। পোশাক ব্যবহারকারীর ভুমিকাও গুরুত্বপুর্ণ। মানুষ পোশাক ব্যবহার করেন সাবলীল মুভমেন্ট ও পরিবেশগত সুবিধা বিবেচনায়। এ সুবিধাগুলি কীভাবে অর্জিত হবে তা ব্যবহাকারীরাই ভাল বলতে পারবেন। ধর্মীয় সংষ্কৃতি নারীর ক্ষেত্রে এসব বলাবলির ধারধারেনা; সবকিছু চাপিয়ে দেয়াই তার রীতি এবং এর মধ্যে এক ধরণের শ্রেষ্ঠত্বের বোধও ক্রিয়াশীল। সংগত কারণে বিষয়টা পরবর্তীতে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
মনে হয় ধর্মীয় সংষ্কৃতি সভ্যতার ইতিহাস পাঠ করেনা। না হলে কড়াকড়ি আরোপের পুর্বে পোশাকের উদ্ভবের কারণগুলি খতিয়ে দেখত। পোশাকের উদ্ভবের কারণ প্রথমতঃ শরীরকে আবৃত করা যেন বাইরের কোন কিছু যেমনঃ রোদ বৃষ্টি ঝড় শীত সহ অন্যান্য বিষয় তার ক্ষতি করতে না পারে।
লজ্জা নিবারণ শরীরকে ঢেকে রাখার ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ বিবেচনা। বাস্তব প্রয়োজন এবং চেতনার উন্মেষের সংগে সংগে মানুষ যখন তার আব্রু সম্পর্কে সচেতন হল লজ্জবোধ জন্ম নিল তখন এসে গেল শরীরকে ভালভাবে ঢেকে রাখার বিষয়টি, এল পোশাকের চিন্তা। লজ্জা এসেছে পরে, আগে এসেছে তুষার যুগের শীত নিবারণের তাগিদ অর্থ্যাৎ তীব্র প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই।
এই খাতে মানুষের প্রাথমিক অবলম্বন ছিল গাছের ছাল-বাকল লতাপাতা পশুর চামড়া ইত্যাদি। তখনও ধর্মের জন্ম হয়নি; তার বিধিবিধান আরও পরের ব্যাপার। তাই বলতে হয় ধর্ম নিয়ে যারা নারীর ওপরে চড়াও হন তাদের ধারণাগত সমস্যা আছে। ঈশ্বর আর যা কিছুই সৃষ্টি করেননা কেন পোশাক সৃষ্টির ব্যাপারে তার কোন ভুমিকা নাই। তাই খবরদারীরও সুযোগ নাই। এর স্রষ্টা মানুষ। পোশাকের বিষয়ে মানুষের অভিপ্রায় সবশেষ কথা।
নারীর পোশাক ও অন্যান্য বিষয়ে কট্টরবাদী সমাজের বিধান বন্য নিয়মের চেয়েও নিকৃষ্ট। বনের পশুদের মাঝেও নারী-পুরুষ আছে। সেখানকার নারী পশুরা পুরুষ পশুদের কাছ থেকে কোন হেনস্তার শিকার হয়না, কোন বিষয়ে আলাদা কোন বন্য আইনের অধীনেও তাদেরকে চলতে হয়না।
কট্টরপন্থার পুরুষ সমাজ কি পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট আর তাদের বাস আরো গহীন নিচ্ছিদ্র বনে যেখানে কোন আলো প্রবেশ করেনা? পৃথিবীর বন ধ্বংস হওয়া নিয়ে পরিবেশবাদীরা উদ্বিগ্ন। এসব বন ধ্বংস হয়ে কোথায় যাচ্ছে! অন্য কোথাও নয় ,জমা হচ্ছে নারীর চারপাশে আর নতুন নতুন বন ও হিংস্র প্রাণীকুলের জন্ম দিচ্ছে। নারীকে ঘিরে আছে অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি হাস্যকর প্রক্রিয়া।
বিশ্ব এখন সমানাধিকারের। আধুনিক সমাজের চাহিদার নিরিখে রাষ্ট্র ধর্ম বর্ণ বা নারী পুরুষে ভেদাভেদ করেনা। তবে কতক জনপদে এটা করা হয়। ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক। আধুনিক যুগে বাস করেও তারা প্রাচীনযুগের দাসপ্রভুদের ন্যায় আধিপত্য বজায় রাখতে চান, নারীকে উপনিবেশ বিবেচনা করেন। এজন্য তাদের নিজেদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ।
আর যদি তা না পান তবে আরও বিপদ। লজ্জা মানুষের সহজাত অপরিহার্য্য অনুসংগ। কেবল পশুতে তা অনুপস্থিত। এইসব পুরুষ ও তাদের সমাজ কুপমন্ডুকতার তলায় পিষ্ট হচ্ছেন আর ফলভোগ করতে হচ্ছে নারীকে। নারী হয়তঃ একদিন মুক্ত হবে কিন্তু এদের মুক্ত হবার কোন লক্ষণ নেই। পুরোপুরি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এরা নারীর পেছনে লেগেই থাকবে।
ধর্মীয় সংষ্কৃতি নারীর প্রতি এত কঠোর হল কেন তার জবাব পাওয়া কঠিন। মনে হয় এটা প্রাচীনকালের শক্তি ও সামন্ত যুগের সহজাত বিষয়, দুর অতীত থেকে অন্ধ অনুসরণের উপায়ে এপর্যন্ত চলে এসেছে। আলেকজান্ডার ভারত অভিযান শেষে ফিরে যাবার সময়ে ইরানে এক যুদ্ধে ভারতীয় এক সেনাপতি মারা গেলে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সহমরণে গমন করেন।
আলেকজান্ডারের এক সহচর দিওদোরাসের রচনায় এর বর্ণনা আছে। উইলয়াম বেন্টিংক ১৮২৯ সালে ভারতে প্রথাটি নিষিদ্ধ করার পরে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে তা পুনঃপ্রচলনের জন্য মামলা হয়, মামলা করেছিলেন এখানকার কতিপয় প্রভাবশালী ব্যাক্তি। এসব ইতিহাস পুরোনো। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
নারীকে আর সেভাবে পোড়ানো হয়না, সে সুযোগ নাই তবে অন্যভাবে পোড়ানোর নানা ব্যবস্থা চালু আছে; চাবুক মারা, পাথর ছোঁড়া, পোশাক সহ চলাফেরার নানা বিষয়ে বিধি নিষেধ আরোপ করে তার জীবনকে অতীষ্ঠ করে তোলার প্রক্রিয়া বিদ্যমান। আধুনিকতাকে পরাস্ত করে উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য নিয়ে এগুলি টিকে আছে ।
নারীর জন্য বিপ্রতীপ প্রথাগুলি ইরান ও আফগানিস্তানে প্রবল। তাই সেখানকার নারী সমাজে মুক্তির আকাংখাও তেমনই। অনেকদিন ধরে চলায় ইরানে নারীর বর্তমান আন্দোলন এখন বেশ শক্তিশালী। কিন্তু সেখানকার শাসক সমাজ এর চেয়ে অনেক বেশী শক্তিধর। তারা পিছু হঠার মত অবস্থায় নেই। গত ৫ ডিসেম্বর’ ২০২২ -এ টিভিতে শোনা গেল ইরান সরকার নীতি পুলিশ বিলুপ্ত করেছেন, এর সদস্যদেরকে তাদের পুরোনো বাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
কথা উঠেছে বিধিবিধান পরিবর্তনেরও। সরকারের পিছু হঠা আপাততঃ নারী আন্দোলনের একটি অর্জন। তবে এটি কৌশলগত পদক্ষেপ না নীতির পরিবর্তন তা পরিষ্কার নয়। নারীদের অনমনীয়তা ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এটা হতে পারে। দেখতে হবে এখানেই শেষ কিনা। এই সাফল্য সংগ্রামরত পক্ষকে উৎসাহিত করবে। তারা আরও এগিয়ে যাবার সাহস পাবেন।
ইরানে নারী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ঐ অঞ্চলের নারী সমাজ এই আন্দোলন এর প্রতি বিশেষভাবে মনযোগী, তারাও পথ খুঁজছেন। এই সাফল্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। এই চলায় অনেকের সহায়তা দরকার। তবে সেখানকার পরিবেশ অনুকুল নয় । সময় বলবে জল শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
মন্তব্য লিখুন