আমরা অনেকেই ঘুমের মাঝে ভারী কিংবা অশরীরী কিছুর অস্তিত্বে জেগে উঠি। প্রচলিত ভাষায় একে বোবায় ধরা বলা হয়। এর স্বীকৃত নাম স্লিপ প্যারালাইসিস । এটি মূলত শারীরিক একটি অবস্থা।
ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের পেশিসমূহ যখন কাজ করা বন্ধ করে দেয় কিংবা প্রয়োজনীয় সাড়া দিতে অসমর্থ হয় তখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই স্লিপ প্যারালাইসিস বলা হয়।
American Academy of Sleep Medicine এর মতে, “স্লিপ প্যারালাইসিস একটি সাধারণ সমস্যা যা প্রায় সব বয়সের মানুষের সাথেই ঘটতে পারে। একজন মানুষ সাধারণত ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সের মাঝে প্রথমবার এর প্রভাব প্রত্যক্ষ করে থাকে। একজন জীবনে একাধিক বার অথবা মাত্র একবার স্লিপ প্যারালাইসিসের মুখোমুখি হতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিসের একেকটি এপিসোড কয়েক সেকেন্ড থেকে দুই বা তিন মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে স্লিপ প্যারালাইসিস দীর্ঘস্থায়ী কিংবা গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় নি।”
আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন অনেকসময় আমাদের শরীর ও মন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি। সব মানুষই স্বপ্ন দেখে। বেশিরভাগ স্বপ্ন মনে না থাকায় আমরা অনেকেই মনে করি যে সব মানুষ হয়তো সবসময় স্বপ্ন দেখেনা।
এই স্বপ্ন দেখার সময় আমাদের শরীরে REM (rapid eye movements) সাইকেল চলতে থাকে। এই সাইকেলের চলমান অবস্থায় আমাদের মন ও শরীরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তখন আমাদের পেশিসমূহ শিথিল হয়ে যায়। REM চলাকালীন কোন কারণে আমরা যখন হঠাৎ জেগে উঠি তখন শরীর হঠাৎ করে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনা।
এতে করে আমাদের পেশি প্রয়োজনীয় উদ্দীপনায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় শ্বাস প্রশ্বাসেও সমস্যা হয় যাকে আমরা স্লিপ প্যারালাইসিস বলে থাকি।
স্লিপ প্যারালাইসিসের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাস জনিত কারণে হঠাৎ ঘুমের মাঝে জেগে ওঠা। বুকের উপর ভারী কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া বা গলায় কেউ চাপ দিচ্ছে এমন অনুভূতি হতে পারে।
এছাড়াও ঘরের মাঝে অশরীরী কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া ও ভীতি সঞ্চার হওয়াও স্লিপ প্যারালাইসিসের লক্ষণ। এ ধরনের এপিসোড চলাকালীন অনেকের মাঝে মৃত্যুভীতিও উপস্থিত হতে পারে।
অনেকের ক্ষেত্রে পেশি ও মাথা ব্যথা হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। কি ঘটছে বুঝতে পারলেও আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলার ও নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
যেকোন বয়সের মানুষ এক বা একাধিক বার স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা একে ত্বরান্বিত করতে পারে। ইনসমনিয়া ও ক্রনিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে স্লিপ প্যারালাইসিসের আশঙ্কা অধিক।
পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের অভাব এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ এর ঝুঁকি বাড়ায়। দুঃচিন্তাগ্রস্থ কিংবা PTSD (post traumatic stress disorder) তে আক্রান্ত এবং মাদকাসক্ত মানুষ একাধিক বার স্লিপ প্যারালাইসিসের শিকার হতে পারে।
কিছু মেডিকেল কন্ডিশন আছে যা একে ত্বরান্বিত করে। বাইপোলার ডিজঅর্ডার তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও যারা নার্কোলেপসিতে ( দীর্ঘ সময় ধরে যেকোন সময় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস) আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে স্লিপ প্যারালাইসিসের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুনঃ আমরা স্বপ্ন কেন দেখি এবং বোবায় ধরা আসলে কি?
তবে কোন কোন চিকিৎসক মনে করেন হ্যালোসিনেশন থেকেও স্লিপ প্যারালাইসিস ঘটতে পারে। অনেক সময় ধারণা করা হয় পারিবারিক ইতিহাসে এর আধিক্য থাকলে উত্তরসূরীদের মাঝেও এটি বহাল থাকে। যদিও এর কোন সঠিক ও নির্ভুল প্রমাণ নেই।
স্লিপ প্যারালাইসিসের প্রতিকার হিসেবে সেরকম ভাবে কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয়না। একজন মানুষ পরিপূর্ণভাবে ঘুমিয়ে ও দুঃশ্চিন্তা না করে থাকতে পারলেই এর আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘন্টার নিরবচ্ছিন্ন ঘুম স্লিপ প্যারালাইসিস রোধে সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলা, একটানা দীর্ঘ সময় পরিশ্রম না করে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করা ও প্রফুল্ল থাকা এই সমস্যা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে পারে।
নার্কোলেপসিতে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। কয়েকজন চিকিৎসকের মতে যারা প্রায়ই স্লিপ প্যারালাইসিসের শিকার হন তাদের ঘুমানোর সময় নীল আলো পরিহার করতে হবে এবং ঘরের তাপমাত্রা যাতে অনেক বেশি না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমরা জানি আল্লাহ তায়া’লা পৃথিবীতে মানুষ ও জ্বিন সৃষ্টি করেছেন। ইসলামী মতাদর্শ মতে মানুষকে ঘুমের মাঝে এক শ্রেণির জ্বিন যখন আক্রান্ত করে তখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটিই স্লিপ প্যারালাইসিস যাকে প্রচলিত ভাষায় বোবায় ধরা বলা হয়।
এক্ষেত্রে বলা হয় কেউ যদি ইসলামে ঘুমানোর আগে যেসব আচার আচরণ নির্ধারণ করা হয়েছে তা না মেনে ঘুমায় তাহলে তার স্লিপ প্যারালাইসিসের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইসলাম ধর্মে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ঘুমানোর আগে অযু করা, আয়তুল কুরসি ও ঘুমের দোয়া পাঠ করা, ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়।
কলম্বিয়ায় স্লিপ প্যারালাইসিসকে কোন জীবিত ব্যক্তিকে মৃতের আত্নার আক্রমণ করার ঘটনা মনে করা হয়।
ইতালিতে স্লিপ প্যারালাইসিসের প্রতিকার হিসেবে একটি অদ্ভুত প্রচলিত আছে। আক্রান্তের বিছানায় বালির স্তুপ করে তাতে মাথা দিয়ে শুইয়ে রাখা হয় এবং উক্ত ঘরের দরজায় ঝাড়ু বেধে রাখা হয়। তাদের ধারণা এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর কোন অশরীরীর প্রভাব থাকলে তা কেটে যায়।
চীনের কিছু মানুষের ধারণা স্লিপ প্যারালাইসিস একটি রোগ বা অশুভ শক্তির প্রভাব। তারা এর থেকে পরিত্রাণ পেতে ওঝার শরণাপন্ন হয়।
স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই-
Sleep Paralysis : Historical, Psychological, and Medical Perspective – Brian A. Sharpless and Karl Doghramji
Sleep Paralysis : Nightmares, Nocebos, and the Mind-body connection – Shelley R. Adler
Sleep Paralysis : A Guide to Hypnagogic Visions and Visitors of the Night – Ryan Hurd
মন্তব্য লিখুন