মানবিকতা শব্দটি যত প্রকট এর চেয়ে মানবিকতার সন্ধান পাওয়া এখন ঠিক ততটাই দূর্লভ । মানবিকতা বলতে আমরা সাধারনত কিছু দান বা কিছু ত্যাগ করে অন্যের উপকারে আসাকে বুঝি । ঠিক সেরকমি একটি বিষয় হলো রক্তদান ।
রক্তদানকে সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা বা মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায় । নিসঃন্দেহে এটি একটি মহৎ কাজ । কারন আমার আপনার রক্তদানের মাধ্যমে বেচেঁ যেতে পারে একটি প্রান । চলুন তাহলে আজকে আমরা জেনে নেই রক্তদান সম্পর্কে বিস্তারিত-
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
রক্ত এক ধরনের যোজক কলা এবং দেহের অভ্যন্তরে পরিবহনযোগ্য অস্বচ্ছ লাল তরল জাতীয় পদার্থ । রক্ত ৩ ধরনের রক্তকনিকা দিয়ে তৈরি ।
১। লোহিত রক্ত কনিকা
২। শ্বেত রক্ত কনিকা
৩। অনুচক্রিকা
লোহিত রক্ত কনিকায় হিমোগ্লোবিন নামক এক ধরনের রঞ্জক পদার্থের কারনে মূলত রক্তের রঙ লাল হয় । রক্ত শীরা ও ধমনীর মাধ্যমে হৃদপিন্ড , ফুসফুস সহ দেহের অন্য সব অঙ্গে পরিবাহিত হয়।
লোহিত রক্তকনিকা গুলো সারা দেহে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত পৌঁছে দেয় এবং দেহে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড বহন করে ফুসফুসে নিয়ে আসে । পরে ফুসফুসের মাধ্যমে তা বাইরে নির্গত হয় ।
শ্বেত রক্ত কনিকাগুলো দেহের জীবানুর সাথে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখে । অনুচক্রিকার প্রধান কাজ রক্ত জমাট বাধাঁ ।
এছাড়া দেহের বিভিন্ন অংশে উৎপন্ন বর্জ পদার্থগুলো রক্তের মাধ্যেমে কিডনিতে পৌঁছায় । রক্ত দেহের তাপীয় ভারসম্য বজায় রাখে । রক্তের মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষ এবং টিস্যু পর্যাপ্ত খাদ্য এবং অক্সিজেনের সরবরাহ পায় ।
আমাদের দেহে পর্যাপ্ত রক্ত থাকলেও কখনো কখনো রক্তের দরকার হয়ে পড়ে। যেমন ছোট বড় যে কোন দুর্ঘটনায় দেহের কোন অঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তপাত হলে তাৎক্ষণিক রক্তের দরকার হয় ।
যে কোন অস্ত্র পাচারে রক্তের প্রয়োজন হয় । সন্তান প্রসবের সময় বেশির ভাগ মহিলাদেরই রক্তের দরকার হয় , তাছাড়া ঋতুচক্র চলাকালীন সময়ে অতিরক্ত রক্তপাত হলে তখন শরীরে রক্ত দেয়ার দরকার পরে ।
ক্যান্সারের মত মরনব্যাধি সহ, যে কোন ছোট টিউমার, ক্ষত ইত্যাদি চিকিৎসায় ও রক্তের দরকার হয় ।
এছাড়া অনেকের রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হলেও রক্ত নেয়ার প্রয়োজন হয়। যারা থ্যালাসেমিয়া রোগী তাদের প্রচুর রক্তের দরকার হয় ।
কার কখন কিসের প্রয়োজন হয় তা জানা মুশকিল । তাই প্রত্যেকের উচিত যার যার ব্লাড গ্রুপ জেনে নেয়া । মুলত ৪ ধরনের রক্তের গ্রুপ রয়েছে-
এর মধ্যে ব্লাডগ্রুপ ‘O’ কে সার্বজনীন রক্তদাতা এবং ‘AB’ কে সার্বজনীন রক্তগ্রহীতা বলা হয় । বিপদের সময় যেন দ্রুত সেবা নেয়া বা দেয়া যায় তাই সবার উচিত নিকটস্থ কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে নিজের রক্তের গ্রুপ জেনে নেয়া । এখন অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বা কোন সংস্থা থেকেও বিনামূল্যেও রক্তের গ্রুপ জানা যায় ।
রক্তদানের জন্য প্রথমেই রক্তদাতার সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে । মূলত ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সের যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যাক্তি রক্তদান করতে পারেন। রক্তদানের সাথে দেহের ওজন ও হিমোগ্লোবিনের সামঞ্জস্য থাকাটা জরুরি ।
নারী পুরুষ উভয়েই রক্তদান করাতে পারে তবে পুরুষের ক্ষেত্রে ওজন ৪৮-৫০ বা তার বেশি এবং নারীর ক্ষেত্রে ৪৫ বা তার বেশি হওয়া আবশ্যক ।
রক্তদানের সময় দেশের তাপমাত্রা ১০০ এর নিচে থাকতে হবে । মেয়েদের রক্তদানের সময় ঋতুচক্রের সময়ের ব্যাপারটিতে বিশেষ নজর রাখতে হবে ।
যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান প্রতি ডেসিলিটারে ১৪-১৫ গ্রাম তারা রক্ত দান করতে সক্ষম হবে ।
এছাড়া বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবনকারী বিশেষ করে যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নিয়ে থাকেন তাদের অবশ্যই রক্তদান থেকে বিরত থাকা উচিত ।
একদন খালি পেটে বা একদম ভরা পেটে কখনোই রক্ত দেয়া যাবে না , হালকা কিছু খাবার খেয়ে তারপর রক্তদান করতে হবে । তাছাড়া যাদের হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, হাই ব্লাড প্রেসারের মত জটিল রোগ রয়েছে তারা কোন ভাবেই রক্ত দান করতে পারবে না ।
রক্তদানের জন্য ব্যাবহার করা সিরিঞ্জটি নতুন বা পরিষ্কার কিনা তা দেখে নিতে হবে । অন্যের ব্যবহার করা অপরিষ্কার সিরিঞ্জ দিয়ে রক্তদান করা যাবেনা । রক্তের ব্যাগটিতে কোনরকম ছিদ্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে । ভুল উপায়ে রক্ত নিচ্ছে কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে ।
একবার রক্তদানে প্রায় ৪৫০ মিলিলিটারের মত রক্ত দেহ থেকে বের হয়ে যায় তাই স্বাভাবিক ভাবেই রক্তচাপ কমে যায় । তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাথা ঘুরানো বা খারাপ লাগা অনুভব হয় ।
রক্তদান শেষে কোনকিছুতে তাড়াহুড়ো করা যাবেনা এতে হিতে বিপরীত হতে পারে । এজন্য রক্তদান শেষে কমপক্ষে ১০ মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নেয়া উচিত এবং হাঁটাহাঁটি, দৌড়ঝাপ বা অন্য কোন কাজ না করা উচিত । এতে প্রেসার অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে । রক্তদানের পরে পর্যাপ্ত পানি বা তরল পদার্থ পান করতে হবে । আয়রন যুক্ত খবার খেতে হবে ।
রক্ত দিতে ভয় হয় এমন কথার সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত । কিন্তু রক্তদানের সাথে শরীরের ক্ষতি হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই ।
আমাদের দেশে পরিবার থেকেই রক্তদান ভীতিকর এরকম ভূল শিক্ষা দেয়া হয় কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে প্রায় প্রতিটি সুস্থ মানুষ । ওজন, বয়স এবং শরীর ঠিক থাকলে যে কেউ রক্ত দিয়ে অন্যকে বাচাঁতে পারে এতে ভয় পাওয়ার ইছু নেই বরং এটি একটি মহান কাজ । তাই নিজে রক্ত দিন এবং অন্যকে রক্তদানে উৎসাহী করুন ।
লোহিত রক্ত কনিকার গড় আয়ু প্রায় ১২০ দিন বা চার মাস । অর্থাৎ প্রতি চার মাস অন্তর আমাদের দেহে নতুন রক্তকনিকার সৃষ্টি হয় । এজন্য প্রতি ৪ মাসে একবার রক্তদান করা যায় এবং এতে করে হাড়ের লাল অস্থিমজ্জা থেকে রক্ত কনিকা তৈরির হার আরও বেড়ে যায় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে ।
এক গবেষনায় দেখা গিয়েছে যারা বছরে অন্তত দুবার বা তার বেশি রক্তদান করে তারা ক্যান্সারের মত ব্যাধির থেকে অনেকটাই নিরাপদ । রক্তদান দেহের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় ।
নিয়মিত রক্তদানে হার্টের অসুখ বা উচ্চ রক্তচাপের মত জটিল রোগের ঝুঁকিও কমে । এছাড়া রক্তদান করে অন্যকে সাহায্য করায় এক ধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায় ।
আমরা স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংগঠন বাঁধনের সাথে সবাই কম বেশি পরিচিত। এটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যেটি মূলত ছাত্র ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত হয় । এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সারা দেশে জরুরি রক্তের সিংহভাগের যোগান দিচ্ছে ।
এছাড়াও দেশে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক রয়েছে । যেমন – সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক , কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংক, এছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক রয়েছে ।
রক্ত যোগাড় করার একটি বড় মাধ্যাম এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামগুলো । বিশেষ করে ফেসবুক । ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ বা গ্রুপগুলোতে রক্তের সন্ধানে পোস্ট করা হয় এবং সক্ষম রক্তদাতারা রক্তদান করে । প্রায় প্রতিটি এলাকায় এখন রক্তদান কারী সংগঠন রয়েছে ।
আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কিংবা মানবিকতার তাগিদ থেকে প্রায় প্রত্যেকেরই উচিত রক্তদান কর্মসূচিতে এগিয়ে আসা । আজ অন্যকে রক্ত দিয়ে সাহায্য করুন কাল হয়ত আপনার প্রয়োজনে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী হবে ।
আমাদের দেশের হাসপাতাল গুলো প্রায় প্রতিবছরই যথেষ্ট পরিমান রক্তের যোগান দিতে পারেনা । ফলে রক্তের অভাবে মারা যায় কত হাজার হাজার লোক। এসব দুস্থ মানুষদের বাঁচানোর জন্য হলেও আমাদের প্রত্যেকের উচিত রক্তদানে অনুপ্রানিত হওয়া এবং অন্যকেও অনুপ্রানিত করা । আমাদের মানবতায় বেঁচে যেতে পারে হাজার প্রান ।
মন্তব্য লিখুন