“মানবদেহের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম অঙ্গ” শুনলে আপনার ভাবনায় চলে আসতে পারে মস্তিষ্ক কিংবা ফুসফুস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় এবং ভারী অঙ্গ হলো ত্বক । কি অবাক হচ্ছেন? দেহ হতে সম্পূর্ণ ত্বক পৃথক করলে তার দৈর্ঘ্য হবে ২০ বর্গ ফুটের সমান।
মেরুদন্ডী প্রাণীর বাহ্যিক অঙ্গসমূহকে আচ্ছাদিত এবং ভেতরের অঙ্গগুলোকে সুরক্ষিত করে রাখা আবরণী কলার অংশই হলো ত্বক । ত্বক যেরকম আকারে বৃহৎ, একই সাথে শারীরবৃত্তীয় বহুবিধ কাজ সম্পাদন করে দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখাতে এটি সমভাবে পারদর্শী।তো চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক আমাদের দেহের এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের আদ্যোপান্ত।
ত্বকের একেবারে বাইরের পাতলা স্তর হলো এপিডার্মিস। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তরের জীবাণুর সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করার কাজ এখানেই ঘটে।এটি প্রতিদিন ব্যাপন ও বাষ্পীভবনের মাধ্যমে দেহ হতে বের হওয়া তরলের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখে।
তাছাড়া শরীর থেকে দরকারি পানি যেন বের হয়ে না যায় তার ব্যবস্থাও করে।এটি স্ট্রাটিফাইড স্কোয়ামাস এপিথেলিয়াল কোষের মাধ্যমে তৈরী।এপিডার্মিসে রক্তনালী না থাকার জন্য কৈশিক জালিকার মাধ্যমে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় দরকারী পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে।এপিডার্মিসে কেরাটিনোসাইট (৯৫%), মেলানোসাইট, ল্যাংগারহ্যান্স, মেরকেল (স্নায়ুতন্ত্র বিষয়ক কাজ করে) জাতীয় কোষ থাকে।
কেরাটিনোসাইট মূলত দেহে যেকোন ধরনের রোগ জীবাণু, প্যারাসাইট, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে।এ প্রতিরোধ ভেঙে যদি জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে দেহে কেরাটিনোসাইট সংক্রমিত হবার পূর্ব সংকেত পাঠায়।দেহ শ্বেত রক্তকণিকা প্রেরণ করে জীবাণুকে ধ্বংসের জন্য।ল্যাঙ্গারহ্যান্স কোষও প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়।
মেলানোসাইটের কারণেই প্রত্যেকের গায়ের বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন।মেলানিন নামক কালো বর্ণের রন্ঞ্জক ধারণ করে মেলানোসাইট ।এ মেলানিনের পরিমাণ যার ত্বকে কম সে ফর্সা ।অপরদিকে,বেশি পরিমাণ মেলানিন গায়ের রঙ গাঢ় করে দেয়।
আমরা প্রায়শই ফর্সা গায়ের বর্ণকে সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করি।কিন্তু ফর্সা আসলে মেলানিনের ঘাটতি প্রকাশ করে। মেলানিনের অভাব স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্নি ত্বকের কোষের ডি.এন.এ নষ্ট করে দেয়।সূর্যের আলোতে গেলে ত্বক মেলানোজেনেসিসের মাধ্যমে মেলানিন তৈরি করে ত্বককে সুরক্ষা দেয়।তবে মেলানিনের পরিমাণ বাড়ার জন্য সূর্যের আলোতে ত্বক কালচে হয়ে যায়।
একে ৫ টি উপস্তর বা স্ট্র্যাটায় ভাগ করা যায়। যথাঃ
(১) স্ট্রাটাম ব্যাসালি
(২) স্ট্রাটাম স্পাইনোসাম
(৩) স্ট্রাটাম গ্রানুলোসাম
(৪) স্ট্রাটাম লুসিডাম
(৫) স্ট্রাটাম করনিয়াম
এপিডার্মিস ও হাইপোডার্মিসের মাঝে অবস্থান করা অংশ যা তাপ ও চাপ হতে শরীরকে রক্ষা করে।এর দুটি স্তর রয়েছে : প্যাপিলারি ও রেটিকুলার অন্ঞ্চল। প্যাপিলারি স্তরটি এপিডার্মিসের কাছে।রেটিকুলার স্তরটি ঘন যোজক কলা (কোলাজেন ফাইবার, ইলাস্টিক ফাইবার, বহি:কোষীয় পদার্থ) দিয়ে তৈরি।
মেকানোরিসেপ্টর ও থার্মোরিসেপ্টর নামক বায়োসেন্সর দুটি বাইরের পরিবেশ সম্বন্ধে মস্তিষ্ককে সচেতন করে তোলে।তাছাড়া এখানে বিস্তৃত রক্তনালী এপিডার্মিস ও ডার্মিসে পুষ্টি সরবরাহ,উৎপন্ন বর্জ্য অপসারণ করে। ফাইব্রোব্লাস্ট, ম্যাক্রোফেজ ও এডিপোসাইট কোষ ডার্মিসে পাওয়া যায়। ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ম্যাক্রোফেজ রোগ -জীবাণু ধ্বংস করে।
“সাব-কিউটেনিস টিস্যু” নামে অধিক পরিচিত হাইপোডার্মিস ত্বকের সবচেয়ে ভেতরের স্তর।একে ‘চর্বির গুদামঘর’ও বলা হয় এডিপোসাইট জমে চর্বিস্তর হবার কারণে।না খেয়ে থাকলে এ চর্বি ভেঙে শক্তি উৎপন্ন হয়।তবে চোখের পাতা,কানের পিনাসহ শরীরের কিছু অংশে এ চর্বি অনুপস্থিত।এ স্তরেই ডায়বেটিস রোগীদের ইনসুলিন প্রয়োগ করা হয়।
ত্বকের মূল কাজ দেহকে আবৃত করে রেখে বাইরের প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা করা।তাই একে ‘বাহ্যিক রক্ষাকবচ’ বললেও ভুল হবে না।আগুনে পোড়া রোগীর শরীরের তরল পদার্থ বের হয়ে যায়।এর কারণ তাদের ত্বক পুড়ে যাওয়ায় দৈহিক সুরক্ষা দিতে পারে না।তাই প্রথম ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের মৃত্যুর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি থাকে।
পরিবেশের তাপ ও চাপের তফাৎটা ডার্মিসের মেকানোরিসেপ্টর ও থার্মোরিসেপ্টর অনুধাবন করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।
ত্বক তাপমাত্রা অনুধাবন করার সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণও করে।গরমের দিনে ঘামের মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয় এটি।অন্যদিকে,শীতে দেহের তাপ যেন বাইরে যেতে না পারে সেজন্য সাবকিউটেনিয়াস চর্বিস্তরটি কাজ করে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তরেই ত্বক কাজ করে নন-স্পেসিফিকভাবে।ম্যাক্রোফেজ ও ল্যাঙ্গারহ্যান্স বাইরে থেকে আগত রোগ জীবাণু ধ্বংস করে।
বিপাক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ইউরিক এসিড, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াসহ আরও কিছু বর্জ্য পদার্থ ঘামের মাধ্যমে ত্বক বের করে দেয়।
৭-ডিহাইড্রোকোলস্টেরল ত্বকে জমা থাকে যা সূর্যের আলো পেলেই ভিটামিন-ডি তে রুপান্তরিত হয়।
মানবদেহের বৃহত্তম অঙ্গ,ত্বক আকারে বড় হওয়ার পাশাপাশি কাজেও পটু।মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তরেই সে সক্রিয়। এছাড়াও দেহ থেকে দূষিত ও ক্ষতিকর পদার্থ দূরীকরণের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক রাখতে বহুলাংশে এটি সাহায্য করে।দিনরাত অবিরত এত শত কাজ করা এ অঙ্গটি এত নিখুঁতভাবে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন ,সেজন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াই যেতে পারে।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, Roar.media, Dailyhunt.in
মন্তব্য লিখুন