ডাউন সিনড্রোম: শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এর প্রভাব এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা

ডাউন সিনড্রোম: শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এর প্রভাব এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা

ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক রোগ। একে ট্রাইসোমি ২১ বা সংক্ষেপে DS/DNS ও বলা হয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের ২১ নং ক্রোমোজমে একটি অতিরিক্ত জিন থাকে। ১৮৬৬ সালে জন ল্যাংডন ডাউন নামের একজন ব্রিটিশ ডাক্তার প্রথম বারের মত এ সিনড্রোমের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেন। তার নামানুসারে একে ডাউন সিনড্রোম নামে অভিহিত করা হয়। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর পিতা মাতা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে থাকে। দৈবক্রমে ঘটা এ জেনেটিক সমস্যায় আক্রান্তের ২১ নং ক্রোমোজমের তৃতীয় অনুলিপিটি রোগীর শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত করে।

প্রতিবছর জন্মগ্রহণকারী ১০০০ হাজার শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মায়। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির কম বয়সে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে বেশি। উন্নত বিশ্বে ৫০-৬০ বছর পর্যন্তও বেঁচে থাকা সম্ভব। ২০১৩ এর হিসাব অনুযায়ী, এ সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল ৮.৫ মিলিয়ন মানুষ এবং মারা যায় ২৭০০০ রোগী।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের এ জিনগত সমস্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় রোগীরাও সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবছর ডাউন সিনড্রোম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২১ মার্চ “বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস” পালন করা হয়। বাংলাদেশেও ব্যাপক পরিসরে দিবসটি পালন করা উচিত যাতে আমাদের দেশের মানুষ এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পায় এবং ভ্রান্ত ধারণা দূরীভূত হয়।

শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এর প্রভাব:

বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বিলম্বিত হয়ে থাকে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত প্রাপ্ত বয়স্ক তরুণের বুদ্ধিমত্তা একজন ৮-৯ বছরের শিশুর সমানও হয়।

শারীরিক বিকাশ স্বাভাবিকের চেয়ে দেরিতে হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এ সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু হামাগুড়ি দিতে শেখে ৮ মাস বয়সে যা স্বাভাবিক শিশুরা ৫ মাসেই শিখে ফেলে এবং হাঁটা শুরু করে প্রায় ২১ মাস বয়সে যা অন্য শিশুরা ১৪ মাসেই শুরু করে।
অন্যান্য অনেক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমনঃ হৃদরোগ, এপিলেপসি, লিউকেমিয়া, গলগণ্ড ইত্যাদি।

শারীরিক গঠনে বিশেষ কিছু দিক যেমনঃ ছোট থুতনি, অসম এবং তির্যক চোখ, সমতল গড়নের নাক, মুখের আকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জিহ্বা, অ্যাপনিয়া, প্রশস্ত মুখমণ্ডল, অপেক্ষাকৃত খাটো গলা, অস্বাভাবিক নমনীয়তা, অস্বাভাবিক প্যাটার্নের হাতের ছাপ, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট আঙুল ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অতি মাত্রায় ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। কথা বলায় সমস্যা বোধ করা। অনেকে ৩০ এর বেশি বয়স হলে পুরোপুরি বাকশক্তি হারাতে পারে। অতিমাত্রায় আবেগের বহিঃপ্রকাশ করা।

আলঝেইমার্স এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শিশু এবং বয়স্ক উভয়ের। ৪০ এর বেশি বয়সী ৫০-৭০% রোগীর আলঝেইমার্স হওয়ার সসম্ভাবনা থাকে। দেখা এবং শোনায় অসুবিধা হতে পারে। সন্তান ধারণে অক্ষমতা।

সঠিক ব্যবস্থাপনা:

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে লালন পালনে পিতা-মাতার সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হয়। একজন স্বাভাবিক শিশুর চাইতে এদের লালন পালন সম্পূর্ণ আলাদা হয়। জন্মের পর থেকেই নিয়মিত সকল ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়।

পারিবারিক ভাবে যতটা সম্ভব সহজ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জনের জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে এরা অনেক ধরনের কাজে পারদর্শীতা অর্জনে সক্ষম হয়।

সঠিক যত্ন এদের মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যাদের দেখতে বা শুনতে অসুবিধা হয়, তারা হিয়ারিং মেশিন, চশমা বা লেন্স ব্যবহার করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস কী? লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

পারকিনসন রোগ কী? আক্রান্ত হওয়ার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা!

পরিবারের সবার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সহযোগিতার মনোভাব অনেকাংশে সমাজের অন্যান্য সকল মানুষের সাথে আক্রান্তের যোগাযোগের সমস্যা দূর করতে পারে। যেহেতু এ সিনড্রোম থাকলে নতুন কিছু শিখতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগে, সেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর আগে বাড়িতেই পড়াশুনা শুরু করে দেয়া ভালো।

এখনো একক কোন চিকিৎসা আবিস্কৃত হয়নি যা ডাউন সিনড্রোম পুরোপুরি নিরাময় করতে পারে। তাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহায়তা দিয়ে আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা পরিবারের লোকজনের দায়িত্ব।

বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম:

আমাদের দেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে রয়েছে অসচেতনতা ও ভ্রান্ত ধারণা। এমনকি অধিকাংশ মানুষের ধারণা অটিজম এবং ডাউন সিনড্রোম একই। অথচ ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানেই অটিজম নয়। অটিজম স্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত অপরদিকে ডাউন সিনড্রোম জিনগত।

এছাড়াও বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে আলাদাভাবে তেমন কোনো ধরনের সহায়তা নেই বললেই চলে। আনুষ্ঠানিক ভাবে ২০১৬ সালে গঠিত হয় “বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি”। ২০১০ সালে DS আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের নিয়ে “প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপ” নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয় যারই পরিবর্তিত রূপ হিসেবে বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি তৈরি হয়।

তৎকালীন প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপটি ২০১৪ সালের ২১ মার্চ প্রথমবারের মত বাংলাদেশে “বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস” পালন করে যা পরবর্তীতে ২০১৭ সালে সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ২০১৭ সালেই সংগঠনটির সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয় গবেষণার উদ্দেশ্যে।

আমাদের সচেতনতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের জীবনযাত্রা অনেকাংশে সহজ ও স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা অবহেলা না করে যথাসম্ভব সহাযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

Exit mobile version