“ওথেলো সিনড্রোম”- অনিয়ন্ত্রিত এবং প্যাথলজিক্যাল হিংসা

“ওথেলো সিনড্রোম”- অনিয়ন্ত্রিত এবং প্যাথলজিকোলিকাল হিংসা

“ওথেলো সিনড্রোম” কী?

“ওথেলো সিনড্রোম” এক ধরনের মনোরোগ, মনোবিদ্যায় প্যাথলজিক্যাল জেলাসি, ডিলুশনাল জেলাসি বা মরবিড জেলাসি নামে পরিচিত। এই রোগ কোন প্রমান ছাড়াই ব্যাক্তির মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে তার সঙ্গী বা সঙ্গীনীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে।

তাকে হারিয়ে ফেলার অতিরিক্ত ভয় আর সন্দেহ যখন মাত্রা ছারিয়ে য়ায় তখনই নেমে আসে মানসিক কিংবা শারীরিক নিপীড়ন যা ভয় এর কারণ বৈকি। আর এই সব মিলিয়ে যে জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি হয় এই সমস্যাকেই “ওথেলো সিনড্রোম” হিসেবে অভিহিত করা হয়। ব্রিটিশ মনস্তও্ববিদ জন টড এই সমস্যাকে “ওথেলো সিনড্রোম” হিসেবে অভিহিত করে।

“ওথেলো সিনড্রোম” নামটি কোথা থেকে এলো?

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজিডি ‘ওথেলো’র শুরুটা হয়েছিল ইটালির ভেনিস শহরে। ভালোবাসা, অবিশ্বাস, সন্দেহ, খুন, বিশ্বাসঘাতকতা্, প্রতিশোধ, অনুতাপ- কী নেই এই নাটকে!!

অন্যের প্ররোচনায় নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওথেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী ডেসডিমোনাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। পরোকীয়ার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে, শেষ পর্যন্ত নিজ হাতে খুন করে ডেসডিমোনাকে। সবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওথেলো নিজেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

ওথেলো আর ডেসডিমোনার ভিতরে ভালবাসার অভাব কখনো ছিল না। বরং সাধারনের চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিল হয়তো। প্রচন্ড ভালবাসা কখনও ধ্বংস বয়ে আনে, এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বোধহয় এটাই।

“ওথেলো সিমড্রোম” -এর লক্ষন ও রোগীর আচরন

আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে উদাহরণ

৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ তার ৬৫ বছর বৃদ্ধা স্ত্রীকে পরকীয়ার অজুহাতে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। কোনো কাজে ঘরের বাইরে গেলে গোপনে নজরদারি রাখতেন এবং ফিরে এলে কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল এই ধরনের নানা প্রশ্ন করা ছিল তার রুটিনমাফিক কাজ। এমনকি স্ত্রীকে প্রতিবেশী কারো সাথে মিশতেও তিনি বাধা দিতেন।

একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করার কয়েকদিন পরেই স্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেএে স্বামীকে বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকেন। অফিসে নারী কলিকদের সাথে কথা বলা যাবে না, সোশ্যাল মিডিয়ার নারী বন্ধু রাখা যাবে না ইত্যাদি।

আরও পড়ুনঃ ভিটামিন আমাদের কোন শক্তি প্রদান করে না

‘ওথেলো সিনড্রোমের’ কারন

মনস্তাও্বিকঃওথেলো সিনড্রোমের সাথে সম্পর্কিত অনেক মনস্তাত্ত্বিক বিষয় রয়েছে। কিছু ব্যাক্তি এটাকে চিএবিভ্রমের সাথে তুলনা করেন।অবচেতনভাবে রোগীর চিওের কিছু পরিবর্তন ঘটে ফলে সে তার সঙ্গীর কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে।

এটা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সঙ্গীর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে রোগীর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যায়। কিছু মস্তিষ্কের রোগ এই বিশ্বাসভঙ্গের
চিএবিভ্রমণ ঘটাতে পারে বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞানী কব ১৯৭৯ সালে দেখান যে সকল ধরনের সেরিব্রাল ইঞ্জুরি এই রোগ ঘটাতে পারে। যৌনশক্তি হ্রাস পাওয়ার সাথে ওথেলো সিনড্রোমে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যক্তিত্ব

অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসহীন,অনির্ভয় ও শঙ্কিত ব্যক্তিরাই তাদের সঙ্গীদের ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন থাকে বা তাদের প্রতি সঙ্গীর দায়বদ্ধতা বা প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে।

পরিবেশগত

কেউ কেউ এমন ধারণা পোষণ করে যে ওথেলো সিনড্রোমের রোগীরা এরুপ সন্দেহ করতে পারে যে তাকে এমন ঔষধ বা পদার্থ খাওয়ানো হচ্ছে যা তাদের যৌনক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

রোগের বিস্তার

ঠিক কতজন এই রোগে আক্রান্ত সে ব্যাপারে সঠিক উপাত্ত নেই তবে বর্তমানে এটিকে একটি বিরল রোগ মনে করা হয়। তবে এখনও অনেক চিকিৎসক এ ধরনের রোগী পাচ্ছেন। পুরুষ ও নারী রোগীর মধ্যে নাটকীয় কিছু পাথক্য পরিলক্ষিত হয়।

পুরুষ রোগী নারীদের তুলনায় বেশি সহিংস প্রবন এবং নিজ হাত ব্যবহার করে আঘাত বা হত্যা করতে চায় অপরপক্ষে নারীরা ভোঁতা বস্তু ব্যবহার করে। পুরুষরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর সামাজিক অবস্থান ও ধনসম্পদকে প্রধান হুমকি হিসেবে মনে করে। নারীরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর যৌবন ও শারীরিক আকর্ষণকে হুমকি হিসেবে মনে করে ইর্ষা মনে করে।

রোগ উদ্দীপক

পুরুষের ক্ষেএে এই রোগের প্রধান উদ্দীপক হচ্ছে দাম্পত্য বিশ্বাসভঙ্গ এবং নারীদের ক্ষেএে প্রধান উদ্দীপক হচ্ছে আবেগিও বিশ্বাসভঙ্গতা দূর করা না যায় তাহলে তারা আত্মহত্যা করতে পারে এমনকি তাদের সঙ্গীনীকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। নারীদের ক্ষেএে আর্তরক্ষত ব্যতীত সঙ্গীকে খুন করার প্রবনতা কম।

এই রোগটি অন্যন্য রোগের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন দীর্ঘদিনের, মদ্যাশক্তি,অ্যালকোহোল,ভিন্ন অন্য বস্তু যথাঃ

মরফিন,কোকেন,অ্যামফিট্যামিন প্রভৃতির প্রতি আসক্তি। মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ যেমনঃ পার্কিনসন্স রোগ, হান্টিংটন্স রোগ ছাড়াও স্কিটসোফ্রিনিয়া, নিউরোসিস, অ্যাফেক্টিভ ডিস্টার্ব্যান্স বা ব্যক্তিও্বের রোগ ইত্যাদির সাথে ‘ওথেলো সিনড্রোমের’ সম্পর্ক থাকতে পারে।

প্রতিরোধ নাকি প্রতিকার?

ওথেলো সিনড্রোম প্রতিরোধ করার তেমন কোন উপায় আমাদের হাতে নেই। পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত মজবুত হলে এই ধরনের সমস্যা সাধারণত হয় না,আর হলেও খুব সহজেই তা কাটিয়ে ওঠা যায়। সমস্যাটা যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক তাই আগে থেকে বোঝা কিংবা সতর্ক হবার কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই।

তবে হ্যাঁ, আপনি যেটা করতে পারেন তা হলো, আশেপাশে কারো মধ্যে বা আপনার নিজের মধ্যে ভালবাসার মানুষকে নিয়ে অহেতুক সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হয় তবে সেটা নিজের মধ্যে চেপে রাখবেন না। যেকোনো সমস্যা ঢেকেঢুকে রাখতে গিয়েই কিন্তু আমরা সমস্যাটাকে আরও বড় করে তুলি।

তাই এ ব্যাপারে কথা বলুন, বুঝতে চেষ্টা করুন যা আপনি ভাবছেন সেটা কি অদৌ সত্যি? নাকি পুরোটাই আপনার কল্পনা?

পরিবারের সহযোগিতা খুব দরকার

সবার আগে যা দরকার তা হলো পরিবারের সবার সহযোগিতা। যে কোন দাম্পত্য কলহে পরিবার একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। আপনার যদি মনে হয় আপনার ভালবাসার মানুষের জীবনে অন্য কারো অস্তিত্ব আছে তাহলে, সেটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন। মনগড়া একটি গল্প বানিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

পরিবারের বাকিদের সাথেও এই সমস্যা নিয়ে কথা বলুন। নিজের সমস্যার কথা জানান। একে অন্যকে সময় দিন। বাইরের কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে আপনজনকে ভুল বুঝলে পরে ওথেলোর মত ‘হায় হায়’ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রেখে সমস্যার সমাধান করুন।

নিতে পারেন মনোবিদদের পরামর্শ

যেই মুহূর্তে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার সঙ্গি আপনার প্রতি সম্পূর্ন বিশ্বস্ত। তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আপনার অনিরাপওার ফল সেই মূহুর্তেই কিন্তু আপনি সমস্যার অর্ধেক সমাধান করে ফেলছেন। কিন্তু সমস্যাটা যেহেতু মনস্তাও্বিক এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিনতি হয় খুন,জখম,আত্মহত্যা কিংবা সম্পর্কবিচ্ছেদ। তাই আপনার উচিত একজন মনোবিদদের পরামর্শ নেওয়া।

অতিরিক্ত যেকোনো কিছু আপনার ক্ষতি বয়ে আনে। সেটা যদি ভালোবাসার মতো স্বর্গীয় বিষয় হয়,তবুও অতিরিক্ত আসক্তি সব সময় ভয়ের কারণ। তাই একজন আরেকজনকে সময় দিন সম্পর্কে তিক্ততা যেনো কখনো না আসে।

প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু সেই ভয়ে যদি সম্পর্কই শেষ করে ফেলেন তাহলে কি করে হবে বলুন তো!! নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন, নিজের ভালবাসার মানুষের উপর বিশ্বাস রাখুন। হৃদয়ের এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতিকে উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নেই , কারো না।

Exit mobile version