“মুক্তচিন্তা মহাসমুদ্রের মত, কুলে না দাঁড়ালে এর বিশালতা অনুভব করা যায়না, উপলব্ধি করা যায়না এর উচ্ছ্বাস, আহবান। আমরা মুক্তচিন্তার কাছে যাইনা তাই বৃহৎ জীবনের সান্নিধ্য হতে বঞ্চিত। শিক্ষিত হন অনেকে কিন্তু জীবনকে হাতে পান খুব অল্প। জীবনকে খুঁজে পেতে তাই যেতে হবে মুক্তচিন্তার কাছে। মুক্তচিন্তা মর্ম বিবেচনায় মুক্তিরই চিন্তা।”
সম্প্রতি পাশ হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন মুক্তচিন্তার আলোচনাকে সামনে এনেছে। গণমাধ্যম কর্মীদের মত এই আইন মুক্তচিন্তা ও মতের প্রকাশে বাধা ; ভয় সৃষ্টি করবে। এর বিপরীতে কর্তৃপক্ষের যুক্তি সোশাল মিডিয়া নতুন ধরণের গণমাধ্যম। এতে নানা জনে ইচ্ছে মাফিক পোষ্ট দেন যা অনেকের মানহানি ঘটায়, বিব্রত করে ; কারো কারো স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত। এই পরিস্থিতির মুখে লাগাম টানতে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যাত্রা। সাংবাদিক মহল একমত হননি, আলোচনা চলছে। এহেন পরিস্থিতিতে মুক্তচিন্তার বিষয়টি সাধারণের মাঝে সম্প্রসারণের অবকাশ রাখে।
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। মুক্ত চিন্তা ও মুক্ত মত তার সহজাত বিষয়। মানুষের ভেতরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি প্রধানতঃ এই দুই পথে বের হয়। আরও একটি পথ আছে -লাঠি-চাপাতি, মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়। সে কথায় পরে আসছি। সমাজকে সজীব ও মানুষকে সম্পৃক্ত রাখতে মুক্তচিন্তা ও মতের সাবলীল প্রকাশ প্রয়োজন।
বিভিন্ন কারণে অনেক সময়ে তা হয়না। সমাজের অনুশাসন বিধিবিধান ও পরিবেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তেমন পরিস্থিতিতে এর সংগে জড়িতরা মাঠে নামেন, যেমন এখন নেমেছেন সংবাদকর্মীরা। মুক্ত মত প্রকাশের বিষয়টি সাধারণভাবে আলোচনায় আসেনা; পরিস্থিতি জটিল হলেই শুরু হয় বিতর্ক। বিধিবিধানের উপরে আলোচনা আছে।
এছাড়াও কতক সামাজিক বিষয় এর গতি রোধ করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট। এই তালিকায় প্রথমে আছে বিশ্বাসভিত্তিক প্রাচীন মতবাদগুলি। এছাড়া প্রথা গোঁড়ামী পুর্ব হতে প্রচলিত বিধিবদ্ধ ধারণা যুক্তিবিহীন বিষয় ও সামাজিক নানা কুটিল পরিস্থিতি পরিবেশকে কঠিন করে তোলে। তারা মনে করেন মুক্তচিন্তা তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং অস্তিত্তে¡র জন্য হুমকি। যুক্তিহীন হওয়ায় বিজ্ঞানের বিপক্ষে, অন্ধ হওয়ায় যুক্তির বিপক্ষে এবং অনড় হওয়ায় পরিবর্তনশীলতার বিপক্ষে এদের অবস্থান।
এগুলো বিরোধের মুল জায়গা। বিরোধ আরো আছে। সবমিলিয়ে সমাজ উভয়কে নিয়ে চলমান। বিপরীত ধর্মী হওয়ায় মুক্তচিন্তা ও বদ্ধচিন্তার যুগপৎ অবস্থান সমাজে তৈরি করেছে এক বিষম জগাখিচুরী। পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে উচ্চমাত্রার সহনশীলতার উপদেশ থাকা স্বত্তে¡ও তা তেমন কাজে আসেনা । পারস্পরিক বিরোধীতা কখনো তীব ্রহয়,সৃষ্টি করে নানা বিপত্তির । এই পরিবেশ মুক্তচিন্তার জন্য ক্ষতিকর তবে বদ্ধচিন্তার সমস্যা হয়না।
আগের অধ্যায়ে লাঠি-চাপাতির কথা বলেছি। ছোট পরিসরে বসবাস এবং অনুক্ষণ অনিরাপত্তার বোধ কাজ করে বিধায় বদ্ধচিন্তাকে প্রায়শঃ এসব অনুসংগের সাহায্য নিতে হয়। বিপত্তির এটা এক বড় কারণ। এদের মাথা খালি হাত ভরা। সমস্যায় পড়লে তাই হাতই ছোটে আগে। তবু এরা সমাজে প্রতিপত্তি সহকারে বহাল। কারণ সমাজ কাঠামোর মধ্যে এর উৎস ও বসবাসের জন্য ভালো পরিবেশ আছে, খাওয়া-পরার ব্যবস্থাও তেমনি। রাজনীতি সহ নানা কারণে সমাজের বর্তমান ভারসাম্য অনেকটা এদের পক্ষে থাকায় মুক্তচিন্তার সংখ্যালুঘুদের নাজেহাল করে ছাড়ে।
এই পরিস্থিতি অতিক্রম করতে এর মুক্তচিন্তার শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন, প্রয়োজন সক্রিয় চর্চা। মুক্তচিন্তা মানুষকে পথ দেখানোর মশাল, এগিয়ে নেবার প্রধান সারথি। এর উৎস মুক্ত জীবন। যাদের জীবন মুক্ত নয় তাদের চিন্তাও মুক্ত নয়। তিনি কেবল একটি বস্তু-জীবনের ভার বহন করে চলেছেন।
মুক্ত জীবনের প্রসংগে দু’একটি কথাঃ মুক্ত জীবন বলতে সাধারণভাবে উন্মুক্ত চেতনা ও উদার দৃষ্টিভংগীর জীবনকে বোঝায়। এই জীবন আসক্তিমুক্ত, বৃহৎ পরিসরের; বদ্ধ জীবনের ঠিক বিপরীত। হয়তো এরকম জীবন অনেকেরই নেই। তাই মুক্তচিন্তারও অভাব। আমাদের চলতি জীবন ধারা মুক্ত ও বৃহৎ জীবনের নমুনা নয়। ভেতরের কাঠামোবদ্ধ জীবনটাকে বচন ভুষণ ছাড়া বাইরের অন্য আদর্র্শিক পরিবেশগুলোর সংগে মেলানো যায়নি। চিন্তারও দশা একই। ভেতরে এক, বাহিরে আরেকÑ মনে হয় এটা এই সমাজের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব। মুক্তচিন্তার চর্চা এ অবস্থা থেকে বের হতে সাহায্য করবে।
বর্তমান সভ্যতা এক অর্থে মানুষের মুক্তচিন্তার অবদান। এর শুরুটা অতীতে। প্রয়োজনের সংগে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব অরণ্যচারী মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়। অতঃপর সেই চর্চা তাকে চারপাশের প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে ও ভালোমত টিকে থাকতে সাহায্য করে। আদিতে ছিল মুক্ত চিন্তার কাল। রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ সমাজ ও ধর্মের অনুশাসন ছিলনা। কেউ তর্জনী উঁচু করেনি, ফতোয়াও দেয়নি।
মানুষ চিন্তা করেছে অতঃপর অর্জিত অভিজ্ঞতাকে পরিশীলিত করে প্রয়োগ করেছে। এরপর ঘটেছে তার অগ্রযাত্রা। প্রাচীন জীবনের পথ ধরে পর্যায়ক্রমে আবিষ্কৃত হয় চারণিক যুথবদ্ধ ও পরে সামাজিক জীবন,উদ্ভাবিত হয় জীবনকে পরিচালনার উপকরণ ও কৌশলগুলি। ক্রমে উদ্ভুত হয় সমাজ ও এর বিধিবিধান আদর্শ চিন্তার সম্প্রসারণ নৈতিকতা অধিকার প্রভৃতি। কাগজ আবিষ্কার হলে সভ্যতার উল্লম্ফন ঘটে; চেতনাগত ও মনস্তাত্তি¡ক নানা বিষয় যুক্ত হয়। সভ্যতা এই ধারায় চলমান আর এর পেছনের মুল নক্শাকার সক্রিয় মুক্তচিন্তা। দ্বিতীয়বার এর উল্লম্ফন ঘটাল ইন্টারনেট। এতদুর আসার পর সেই পথ রুদ্ধ হলে মানুষকে ফিরে যেতে হবে তার অতীতের সংর্কীণ জগতে। নিশ্চই কেউ রাজী হবেন না।
বর্তমান বাস্তবতা ঘোর প্রতিক্রিয়শীলতার মুখে। তাই মুক্তচিন্তা ও মতের প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক বেশী। আদিকালে মানুষের চারপাশে বন-জংগল হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ছিল। সেসবের মোকাবিলায় মাথাকে সদা সক্রিয় রাখতে হত। সভ্যতার এতদিন পরে এসে পরিস্থিতি আবার অনেকটা সে রকম। বন-জংগল জন্তু -জানোয়ার নেই, কিন্তু ভয় হিংস্রতা নিমর্মতা বিদ্বেষ আগের চেয়ে বরং বেশী, শাসন-অনুশাসন-দুঃশাসনের বেড়াজাল দুর্ভেদ্য। তাই মানুষ আগের মতই বিপদে।
সার্বিক নিরাপত্তার জন্য তার সর্বশেষে আবিষ্কার রাষ্ট্র। এই আবিষ্কারও তাকে নিরাপত্তা দেয়নি। ভুপেন হাজারিকার গাওয়া একটি বিখ্যাত গান –পুরোনো ইতিহাস ফিরে এলে লজ্জা কি তুমি পাবেনা—-। পুরোনো ইতিহাস ফিরে এসেছে তবে কাউকে লজ্জা দিতে পারেনি। আমরা মানুষ হলে তবে লজ্জিত হওয়ার প্রসংগ। অনেককেই মনে হচ্ছে পুরোনো ইতিহাসের নেশায় মগ্ন। এমতাবস্থায় আরও বেশী করে মুক্তচিন্তার পথে চলা উচিৎ। বন্য পরিবেশে টিকে থাকতে কৌশলের চেয়ে সংগ্রামের প্রয়োজন বেশী। তাই দরকার অধিক সক্রিয় মুক্তচিন্তা।
যুগটা বাজারের। কড়ি গুনলে অন্যান্য পণ্যের মত বুদ্ধিও কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু মুক্তচিন্তা সেভাবে মেলেনা; নিজেকে গড়ে নিতে হয়। এটা প্রধানতঃ মানুষের ব্যক্তি কেন্দ্রিক চর্চা যার উপকরণ মানুষের চারপাশ এবং অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সবকিছু।
মানুষকে এর উপযোগী করার চেষ্টার রাষ্ট্রীয় আয়োজনের নাম শিক্ষা। তবে এই ব্যবস্থা মুক্তচিন্তা ব্যতীত অনেক কিছু শেখায়। তার আসক্তি বরং উল্টো। কথা ছিল এটা মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা আদর্শ বিবেক ও মহৎ গুণাবলী অর্জনে সাহায্য করবে; তাকে মুক্তচিন্তার আধার হিসাবে গড়ে তুলবে যেন সে তার চারপাশের সবকিছুকে উন্মুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ও মুল্যায়নের সুযোগ পায়। তার চরিত্র গঠনের কাজও এখান থেকে হওয়ার কথা। তবে হয়নি।
সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত ব্যাপক নেতিবাচক প্রবণতা, শিক্ষাও তার শিকার। এখানেও দুর্বৃত্তায়ন প্রকট,মহৎ গুণাবলী নির্বাসিত,দৃষ্টি উদার হওয়ার পরিবর্তে অন্ধ হওয়ার উপক্রম। সিলেবাস পরিবর্তন না করলেও বিশেষ অসুবিধে হতনা। এর ফল হল লোভ হরণ বিভাজন প্রভৃতি প্রবল; আবশ্যিক অনুসংগগুলির (প্রতিক্রিয়াশীলতা সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী উগ্রতা হিংস্রতা) ভয়ানক দাপট।
শিক্ষার্থীরা চাওয়া-পাওয়ার ছোট পরিসরে জীবনটাকে পুর্ণ করতে ব্যস্ত -এটা এই ব্যবস্থার বড় সাফল্য। মানুষের জীবন এসব চাওয়া-পাওয়ার বাইরে অনেক বিস্তৃত, অনেক মহৎ বিষয়ের সমষ্টি। সুদুর অতীত থেকে দুর ভবিষ্যত পর্যন্ত তার বিস্তার। বহু কিছু শেখা জানা ও বোঝা প্রয়োজন, অনুভব করা দরকার, মুল্যায়ন করা দরকার। সে সুযোগ নাই। বিদঘুটে বিচিত্র সব কারবারে শিক্ষা ব্যবস্থা ন্যুজ¦ । তার নিজের মানুষ হওয়াই কঠিন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলিতে ‘লাঠিয়ালদের’ তৎপরতা বুঝিয়ে দেয় শিক্ষার বর্তমান ছক পুরোনো ইতিহাসের প্রতি কতটা আসক্ত। লাঠির দৌরাত্ম পরিষ্কার করেছে মুক্তচিন্তা চর্চা কতটা প্রয়োজন।
আমরা জানিনা মুক্তচিন্তা আমাদেরকে কোন দেশে নিয়ে যাবে। জানা নাই সেখানকার পরিবেশ উদারতা ও রুপ রস। তবে এটুকু বোধ হয় বলা যাবে যে, মুক্তচিন্তা মহাসমুদ্রের মত, কুলে না দাঁড়ালে এর বিশালতা অনুভব করা যায়না, উপলব্ধি করা যায়না এর উচ্ছ্বাস ,আহবান। আমরা মুক্তচিন্তার কাছে যাইনা তাই বৃহৎ জীবনের সান্নিধ্য হতে বঞ্চিত। শিক্ষিত হন অনেকে কিন্তু জীবনকে হাতে পান খুব অল্প। জীবনকে খুঁজে পেতে তাই যেতে হবে মুক্তচিন্তার কাছে। মুক্তচিন্তা মর্ম বিবেচনায় মুক্তিরই চিন্তা।
এখন প্রয়োজন মন ও বিবেকের প্রসারতা এবং মুক্তচিন্তার চর্চ। এগুলি ভবিষ্যতের পাথেয়। দৃষ্টিকে দিগন্তে প্রসারিত করা দরকার, সকল মানুষ পরিবেশ ও সময়ের সংগে হাত মেলাতে হবে; মুক্তচিন্তার চর্চা বিকল্পহীন। পৃথিবীকে সুন্দর করার এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়।