নতুন শিক্ষা আইনঃ প্রাইভেট নোট-গাইড ও অন্যান্য প্রসংগ
দেশে নতুন শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে, ইতিমধ্যে এর খসড়া চুড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। সর্বশেষ শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ২০১০ সালে। শিক্ষা কার্যক্রমে শৃংখলা ফেরাতে তখনই একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন করার কথা বলা হয়েছিল। এর প্রায় একযুগ পর প্রণীত হল খসড়া (প্রথম আলো-৬/৮/২০২২)। আশাকরা যায় কিছুদিনের মধ্যে একটি নতুন শিক্ষা আইন পাওয়া যাবে।
ইত্যবৎসরে শুরু হয়েছে প্রণীত খসড়ার পর্যালোচনা ও মতামত প্রকাশ। বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে নোট-গাইড ও প্রাইভেট প্রসংগ। শিক্ষা মানব জীবনের একটি মৌলিক বিষয়। কাজেই এ বিষয়ে সবার খোলামেলা আলোচনা ও মতামত প্রয়োজন। গোঁড়ায় কোন ত্রæটি থেকে গেলে তার প্রভাব নানা ক্ষেত্রে বিকশিত হয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
আলোচনা-সমালোচনার প্রধান টার্গেট প্রাইভেট বা কোচিং ও নোট-গাইড বই। অন্যান্য বিষয় নিয়েও কমবেশী কথা হচ্ছে। একদিকে তুমুল জনপ্রিয়তা অন্যদিকে নিষিদ্ধ করার জোরালে দাবী-এ দুই সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে সবচেয়ে বেশী কৌতুহল সৃষ্টি করেছে প্রাইভেট বা কোচিং।
প্রণীত খসড়ায় বলা হয়েছে কোন শিক্ষক তার নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীকে পড়ানো যাবে। অর্থ্যাৎ কিছুটা এদিক-ওদিক করে প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থাটা বহাল রাখা হল। এটা ব্যবসায়ী শিক্ষকদের জন্য সুখবর।
এখানে শিক্ষার্থী কল্যাণের কিছু নাই, তাঁদেরকে আগে যেমন ছুটতে হত এখনও তেমনই করতে হবে। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানোতে নিষেধাজ্ঞার কারণ জানা যায়নি। সম্ভবতঃ সেটা এইঃ একজন শিক্ষক স্বীয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ পেলে শ্রেণীকক্ষে ভালমত পাঠদান করবেন না।
অর্থের আশায় প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট বা কোচিংএ যেতে উৎসাহ যোগাবেন। এতে পাঠদানের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। বর্তমানে সময়টা বাজার চর্চা ও সিন্ডিকেশনের। অনুকুল পরিস্থিতি তৈরির জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মিলে যদি একটা সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তবে এসব ঠুনকে আইন কোন কাজে দেবেনা। মুল বিষয় প্রাইভেট পড়ানো ও অর্থপ্রাপ্তি। নতুন শিক্ষা আইনে সুযোগটা আছে।
এরপর বাকীটা শিক্ষকগণ নিজেরা ম্যানেজ করে নেবেন,সমস্যা হবেনা। নিষেধাজ্ঞার পেছনে থাকা ধারণাটি শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর, তাদের ভাবমুর্তির উপরে একটি বড় কালো দাগ। প্রাইভেট-কোচিং প্রায় অপিরহার্য্য,সব শিক্ষার্থীকে সে পথ মাড়াতে হয়। তাই বলা যাবে একজন শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কালে স্বীয় প্রতিষ্ঠানে তার ব্যর্থতার বিষয়টা স্বীকার করে নিচ্ছেন। এটা শিক্ষকদের খারাপ লাগার কথা,তবে লাগেনা।
তাছাড়া বিষ হাত দিয়ে খাওয়া যাবেনা,চামচ দিয়ে খাওয়া যাবে -এ ধারণাও ঠিক নয়। প্রাইভেট সম্পর্কে এরুপ সিদ্ধান্তের কারণ সমাজে এর ব্যাপক বিস্তৃতি, একে উপড়ে ফেলা কঠিন। তাই নিয়মের মধ্যে এনে কিছুটা শৃংখলিত করার চেষ্টা। বলা বাহুল্য এ নিয়ম কেউ মানবেন না; এর তদারকির ব্যবস্থা নাই, সম্ভবও নয়। জনাব কাজী খলিকুজ্জামান (অর্থনীতিবিদ ও ২০১০ সালের শিক্ষানীতি কমিটির কো-চেয়ারম্যান) ঠিক বলেছেন -প্রাইভেট পড়ানো যাবেনা। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এসব লালন করার সুযোগ নাই।
প্রাইভেট বা কোচিং এর চরিত্র সম্পর্কে সবাই ওয়াকিফহাল। এটা শিক্ষার্থীকে ভাল জিপিএ পাইয়ে দেবার স্থুল আয়োজন। অতীতে নিজেদের সাফল্য প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। এসব কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও সেখান ছোটাছুটি।
এগুলি প্রকৃতপক্ষে দ্রুত ও স্বল্প আয়োজনে শিক্ষার্থীর মাথায় কিছু বিদ্যা গুঁজে দেয়ার কবিরাজী ব্যবস্থা। উচ্চ জিপিএ সমাজে খুব গুরুত্বপুর্ণ। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ও চাকরী পেতে এটা দরকার। অন্যান্য সামাজিক রীতিতেও এর মুল্য আছে। এটা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনেরও পথ। ব্যয়বহুল হলেও চমকপ্রদ সাফল্যের কারণে প্রাইভেট জনপ্রিয়। শিক্ষার্থীরা এর বলি। এর সংগে সন্তানকে গড়ে তোলার কোন সম্পর্ক নাই।
শিক্ষার উদ্দেশ্য সন্তানকে মানুষ করা, মানবতার বিকাশ ঘটানো। মোটা দাগে ধারণাটা এইঃ একজন মানুষ দুটো বিষয়ের সমষ্টি -একটি তার দৈহিক গঠন অন্যটি সেই দেহের উপরে তৈরি হওয়া গুণগত বিষয়াবলী। এসব বিষয়ের মধ্যে আছে জ্ঞান বুদ্ধি নীতি আদর্শ চরিত্র মেধা মনন বিচার বিবেচনা চিন্তা চেতনা সমাজ রাষ্ট্র প্রভৃতি। এগুলিকে একত্রে মনুষ্য সংষ্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়।
শরীর গঠনের জন্য যেমন দরকার বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার মনুষ্য সংষ্কৃতির জন্য তেমনই প্রয়োজন মান সম্মত শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশ। একজন পুর্ণাংগ মানুষ দীর্ঘসময় ধরে যুগপৎ চলা এই উভয় প্রক্রিয়ার ফল। বিদ্যালয়ে এই পরিবেশ আছে। সন্তানকে গড়ে তোলার সুযোগ আছে।
কিন্তু প্রাইভেট বা কোচিং ঠিক এর বিপরীত। তার পরিসর খুব সংকীর্ণ, ব্যবস্থাগুলি রাখা সম্ভব নয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার সংগে তাই প্রাইভেট-কোচিং এর শিক্ষার ব্যবধান বহু। বিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বৃহৎ ও সুদুর প্রসারী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে, সে রকম কাঠামো নিয়ে।
বিপরীতে প্রাইভেট-কেচিং এর লক্ষ্য ও পরিকল্পনা খুব ক্ষুদ্র, কেবল পরীক্ষা আর জিপিএর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই ব্যবস্থা শিশু-কিশোরদের মনন ও চেতনাকে অপরিণত ও খর্ব করে। তাই এটি সন্তানকে মানুষ করার পথে বড় প্রতিবন্ধক। ফলাফল অর্জনের নিরিখে কেউ কেউ প্রাইভেট-কোচিংকে শিক্ষার সহায়ক বলে মনে করেন। এটা সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতা। প্রাইভেট-কোচিং এর শিক্ষা হল টোটকা। স্বল্পায়াসে দ্রুত ফল লাভের উপায় হিসাবে টোটকা সমাজে জনপ্রিয়।
নতুন শিক্ষা আইন নোট-গাইডের পরিবর্তে সহায়ক বই এর কথা বলেছে। এ ব্যবস্থা ঠিক। এসব বই এর প্রয়োজন আছে। কেবল টেক্সট বই পড়ে শিক্ষার্থীরা সবকিছু শিখতে পারবেনা। সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক বই প্রকাশ করা যাবে। তবে কারা কীভাবে প্রকাশ করবেন, অনুমোদন কারা দেবেন, কী কনটেন্ট থাকবে -তা পরিষ্কার নয়। কাজেই এরপর শুরু হবে অনুমোদন প্রাপ্তির লড়াই এবং ব্যবসায়ীদের নিজেদের পছন্দমত বই প্রকাশের চেষ্টা। বলার অপেক্ষা রাখেনা এই চেষ্টা বিফলে যাবেনা।
আইনে নোট-গাইড নিষিদ্ধ হলেও এই প্রক্রিয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাটি আর অক্ষুন্ন থাকবেনা। কারণ এর সংগে জড়িত শত শত কোটি টাকার ব্যবসা (প্রথম আলো উপসম্পাদকীয় -৬/৮/২০২২)। সহায়ক বই নির্ধারণের বিষয়টি শিক্ষা বোর্ডের হাতে রাখা উচিত। এতে বই এর মান যথাযথ হবে। শিক্ষার্থীরা টানা-হেঁচড়ার হাত থেকে রেহাই পাবে।
বর্তমানে শিক্ষার্থীদেরকে নির্দিষ্ট নোট-গাইড কিনতে ও পড়তে বাধ্য করা হয়, বাধ্য করা হয় নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে পড়তেও। অন্যথা হলে ভাল নম্বর পাওয়া যায়না, ব্যবহারিক পরীক্ষায় সমস্যা হয়। তাই নিয়মিত পড়তে না পারলেও মাঝে মাঝে হাজিরা দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে আসতে হয় -গরুর হাটে হাসিল প্রদানের মত। শিক্ষকের কথা শিক্ষার্থীর কাছে শিরোধার্য্য। এটা নোট-গাইড ব্যবসার প্রধান ভিত্তি।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ আমার ছেলে একবার ধরে বসল তাকে একটা ইংলিশ গ্রামার বই কিনে দিতে হবে। অনেক খুঁজে বাস স্ট্যান্ডের এক অখ্যাত লাইব্রেরীতে সেটা পাওয়া গেল। দেখা গেল সেটা ফটোকপি করা বই আর তাতে অনেক ভুল। জেলার সেরা স্কুলের সেরা একজন শিক্ষকের সিলেকশন দেখে আমি হতভম্ব। শিক্ষক বলেছেন বইটি ভাল তাই আমার ছেলে নাছোড় বান্দা, বইটি কিনতেই হবে। এসব কারবার বন্ধ হওয়া উচিৎ।
শিক্ষার বর্তমান বাস্তবতা অনেকটা প্রাইভেট ও নোট-গাইড এর অনুকুলে। এ পথে ভাল জিপিএ পাওয়া সহজ। ভাল জিপিএ না পেলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত জীবনের সম্ভাবনা গোঁড়াতেই ফিকে হয়। অভিভাবক এটা চাননা। মুখে যাই বলুন তারা আতংকিত। তাই হঠাৎ করে প্রাইভেট-কোচিংকে কঠিন (নিষিদ্ধ করা হয়নি) করে তোলায় বড় রকমের আপত্তি আছে। এদের উপরে নির্ভরশীল বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যাবে কোথায়! বিদ্যালয়ে সেরকম সংকুলান নাই; ইচ্ছাকৃত ভাবে বিদ্যালয়কে পিছিয়ে রাখা হয়েছে।
অনেকদিনের পরিকল্পিত চেষ্টায় আজকের অবধারিত পরিবেশটি নির্মিত। এর দায় কমবেশী সবার। শিক্ষার্থীরা কোচিংএ যেতে বাধ্য হচ্ছে, অভিভাবকেরা বাধ্য হচ্ছেন তাদেরকে সেখানে পাঠাতে। এমতাবস্থায় পর্যাপ্ত বিকল্প তৈরি না করে হঠাৎ করে এসব বন্ধ করা মাথায় বাজ পড়ার সামিল। পরিবেশ বলবে যাও আর আইন বলবে যেওনা-এ দ্বৈরথ আরও ক্ষতিকর। আইনের জেতার সম্ভবনা কম। উচিৎ ছিল নতুন আইনের খসড়ায় প্রাইভেট-কোচিংএর বিকল্প পথের নির্দেশনা রাখা। এই নির্দেশনা হত একটি অত্যন্ত বাস্তব সম্মত কাজ।
প্রাইভেট কোচিং এক দুই বছরে গড়ে ওঠেনি, একে স্বল্প সময়ে সরানোও যাবেনা। এজন্য সময়ের দরকার; স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা রাখতে হত যাতে সমস্যাটি ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা যায়। এমনটা হলে আজকের এই উৎকন্ঠা সৃষ্টি হতনা। কিন্তু শিক্ষা আইন করে বসল উল্টো,প্রাইভেট ও নোট গাইডের বাণিজ্যকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে একটা কৌশলী ব্যবস্থা করে রাখল।
প্রাইভেট-কোচিংকে গ্রহণযোগ্য করতে কেউ কেউ চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের প্রাইভেট প্রাকটিস এর উদারণ দেন। বলেন, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলে শিক্ষকদের বেলায় সমস্যা হবে কেন। কথাটায় যুক্তি আছে। তবে সমস্যা অন্যত্র। উভয়ের কর্মক্ষেত্র আলাদা।
শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীকে মানুষ করা। এঁরা প্রজন্মেকে পথ দেখান। এখানে ভুল করার সুযোগ নাই। এই শিশুরাই পরে চিকিৎসক-প্রকৌশলী হন। অর্থাৎ শিক্ষকদের কাজ সুসম্পন্ন হলে পরে উদয় হন প্রাকটিসওয়ালারা। আগের কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন না হলে পরেরগুলো নিয়ে পড়তে হবে বিপদে। তাই সবাইকে আগে মানুষ হতে হবে,পরে প্রাকটিস। ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দেয়া অর্বাচীনতা। সমাজ বিপদে পড়বে অমানুষদের নিয়ে। সমাজের আজকের চালচিত্রে মনে হয় এরকম প্রক্রিয়া কতকটা চালু আছে।
প্রাইভেট কোচিংএ শিক্ষার্থীকে যান্ত্রিক নিয়মে পাল্লা দিতে হয়, তার অন্তরাত্মা মরার উপক্রম। সে হয়ে ওঠে বাছাই করা কিছু পাঠ ও বিদ্যার ঝুলি। শিক্ষার উদ্দ্যেশ্য শিক্ষার্থীর মনোজগৎ নির্মাণ করা, তাকে শিক্ষার ক্ষুদে শোরুম বানানো নয়। বর্তমান বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া এর ক্রেতাকে এগিয়ে নেয়, শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে। এভাবে পিছিয়ে যেতে যেতে অনেকের আর কোন খোঁজ থাকেনা।
সম্ভবতঃ সে কারণে দেশে আজ প্রকৃত মানুষের বড় অভাব। ভাল পেশাজীবিই বা কই। ডাক্তার-প্রকৌশলীদের প্রসংগ এসেছে। এদের সেবার মান-ধরণ বুঝতে দুটো পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে। ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশন ২০১৯ সালে ১৫ লাখ ভিসা ইস্যু করে যার বড় অংশ মেডিকেল ভিসা (বিবিসি বাংলা, ঢাকা ৩০.০৪.২০২০)। প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় ও শ্রীলংকান প্রকৌশলী ও বিজনেস এক্সিকিউটিভ বাংলাদেশে কাজ করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০/০২/২০১৮ তে সংসদে এরকম ৮৫৪৮৬ জন বিদেশীর একটি হিসাব দেন। শিক্ষা যথাযথ হলে দেশের সতীর্থদের দক্ষ হবার কথা। বিদেশীদের আনাগোনাও কমে যাবার কথা। উদ্দেশ্য অনুযায়ী দেশের মানুষের সহজে ও সুলভে ভালমানের সেবা পাওয়ার কথা। তা হয়না। এটা না-হওয়ার কারণ শিক্ষায় প্রথম পর্বের অপুর্ণতা। প্রাইভেট-কোচিং এর সমর্থকেরা সম্ভবতঃ এই পথে চলতে চান। শিক্ষা ইতিমধ্যে প্রচুর পরিমাণে ব্যয়বহুল ও বাণিজ্যিক। অবাধ প্রাকটিসের কারণে এটা আরও বেশী হলে ভারতীয় হাই কমিশন ভিসা দিয়ে কুল পাবেনা। আমাদের মুল সমস্যা আসক্তি। তাই যুক্তির অভাব হয়না। এর মাশুল দিতে হবে। এবং সে তালিকায় শিক্ষকেরাও থাকবেন।
সমস্যাগুলোর কোন সরল সমাধান নাই। প্রাইভেট ও নোট-গাইড ছাড়াও আরও অনেক সমস্যা আছে যেমনঃ মান সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব (প্রবণতার অভাব আরও বেশী), অপরিসর শ্রেণীকক্ষ (এক কক্ষে অনেকজন বসেন,পেছন হতে শোনা যায়না) শিক্ষা সামগ্রীর উচ্চ মুল্য, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, বহু ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার সিস্টেম নিয়ে অন্তহীন এলাপাথারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি , বিনিয়োগ কম, রাষ্ট্রের উদাসীনতা সর্বোপরি শিক্ষাকে পুরোদস্তুর বাণিজ্যে পরিণত করার আকুলতা-ইত্যাদি। সমস্যা গুলি একটি আরেকটির সংগে জড়িত তাই সাকুল্য সমাধান প্রয়োজন; একটি দুটিকে নিয়ে টানাটানি করে দীর্ঘস্থায়ী ফল লাভ করা যাবেনা।
সমস্যাগুলির পেছনে আছে বড় বড় সব রাজনৈতিক হাংগর-দৈত্য। তাই দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশে ব্যাঙএর ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, কর্পোরেট জগতের প্রত্যাশা পুরণে তৎপর। এই জগতের বাইরে আছেন আরও অনেকে তাদের জন্যও কিছু করা কর্তব্য। বাইরের এই রথিরা কোচিং ও নোট-গাইডের ব্যবসায়ী তথা শিক্ষা বাণিজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারী খাত, বাণিজ্যের ভাষায় এসএমই (শর্ট এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ)। দেশে এসএমই খাতের বিকাশ হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে এটা প্রধান খাত।
তাই শিক্ষা খাতের এসএমইর বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ স্বাভাবিক। শিক্ষায় কর্পোরেট জগতের হাতিগুলোর খোরাক যোগাবে এসব এসএমই’র তৈরি কলাগাছ । শিক্ষা শেষ পর্যন্ত হাতি আর কলাগাছের গল্পের মধ্যে আবর্তিত হবো কিনা তা সময়ই বলতে পারবে।
শিক্ষাকে সঠিক পথে ফেরাতে দরকার প্রচুর বিনিয়োগ। আয়োজন গুলি গ্রামেও নিয়ে যেতে হবে। ইদানীং বলা হচ্ছে শহরের সব সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে; গ্রাম হবে আধুনিক, শহরের মত (আমাদের শহরগুলো কি আধুনিক?)।এটা ভাল সমাধান, তবে সময় লাগবে। তখন গ্রামে আধুনিক ও ভাল মানের শিক্ষা পাওয়া যাবে।
শহরের স্কুলে এত চাপ থাকবেনা। সবার স্বস্তি। শিক্ষকেরা চাইলে ভালভাবে পড়াতে পারবেন। কিন্তু একটা সমস্যা থেকে গেল। ইতিমধ্যে শহরে এসে পরা মানুষেরা কি আবার গ্রামে ফিরবেন। ঘরবাড়ী হাওয়া-বাতাসের কাছে ইজারা দিয়ে আসা এসব মানুষের পক্ষে ফেরা কঠিন। না ফিরলে শহরের স্কুলে চাপ কমবেনা। ভাল হবেনা শিক্ষার মান ও পরিবেশ।
প্রাইভেট বা কোচিং শিশুর মনোজগতের ঘাতক। তাই ফৌজদারী আইনে বিচারের সুযোগ আছে। বিচার না হোক অন্ততঃ এগুলি বন্ধ হোক । নোট-গাইড বিষয়েও একই কথা। ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর যেন না হয়। পন্ডিত ও অভিজ্ঞজনদের পরমর্শ পথ দেখাতে পারে।
সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করে স্কুলের কার্যক্রম জোরদার করবে,পরিবেশ ক্রমে স্বাভাবিক হবে। সহায়ক বই তৈরিতে এঁদের পরামর্শ অগ্রগণ্য। ভালভাবে পাঠান, অতিরিক্ত সময় ও ক্লাসের ব্যবস্থা, ক্লাসের বাইরে গ্রুপ পদ্ধতি, আলোচনা,সেমিনার, অন্যান্য কার্যক্রম সর্বোপরি গ্রামের স্কুল গুলির পরিবেশ ও মান উন্নত করা প্রভৃতি বিষয় ভাবা যেতে পারে।
আমাদের বিজ্ঞ কর্তামন্ডলী ও শিক্ষকগণ উপায় বের করতে সক্ষম। তবে তার আগে প্রয়োজন বাণিজ্যের ঘুর্ণিপাক হতে বেরিয়ে আসা। যারা যাঁতা তারাই ত্রাতা। শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দরকার। তাঁদের সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য সমিচীন হবেনা। তারা সেবাটা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে লোকের বিশ্বাস শিক্ষায় অন্যায্য কর্মগুলো তাদের অনেকের সহায়তায় গেঁড়ে বসেছে।
পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার। নতুন শিক্ষা আইন এর খাল দিয়ে আসা কুমির সবার জন্য সমান ভয়ংকর। কুমিরের কাছে আপন পর নাই।