হ্যাং সন ডুং: আমাদের পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য ভয়ংকর সুন্দর জায়গা, যেসব জায়গাতে এখনও পা পড়েনি মানুষের। আজ থেকে প্রায় এক লাখ বছর আগে মানুষ আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে এশিয়া, ইউরোপ ও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থলভাগে বসবাস শুরু করে।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত সময়ে বিভিন্ন গুহা আদিম মানুষের অভিবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। কারণ ঝড়-বৃষ্টি কিংবা রাতে হিংস্র পশুর হাত থেকে বাঁচতে এই গুহাগুলোই ছিলো মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় আধুনিক কালে এসব গুহা গুলো অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে।তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কল্যাণে এখন সেই সব গুহা আবিষ্কৃত হচ্ছে । যার ধারাবাহিকতায়, মাত্র এক দশক আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা আবিষ্কার হয়।
গুহাটি উচ্চতা, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সবচেয়ে বড়। গুহাটি অবস্থিত ভিয়েতনামের কোং বিন প্রদেশে। প্রতিবেশী লাইসের সাথে দেশটির সীমান্ত এলাকায় কোং বিন প্রদেশে অবস্থিত এই গুহাতে প্রথম মানুষের পদচিহ্ন পড়ে ২০০৯ সালে। কারণ এই গুহায় প্রবেশপথ এত দূর্গম যে এই গুহায় প্রবেশ করার মতো উপযুক্ত প্রযুক্তি মানুষের ছিলো না।
স্থানীয় ভাষায় এই গুহাটির নাম “হ্যাং সন ডু“। যার বাংলা অর্থ হলো পাহাড়ি নদীর গুহা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহাটি ভিয়েতনামের কো বিং অবস্থিত।
হ্যাং সন ডুং গুহাটি সৃষ্টি হয়েছিল আনুমানিক প্রায় ২০-৫০ লাখ বছর আগে।সৃষ্টির সময়কালে প্রায় ত্রিশ লাখ বছর সময় ব্যবধানের কারণ, এই সব গুহা তৈরির প্রক্রিয়া।
বিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের গুহাকে “সলুউশনাল কেভ” বলে।কারণ পানিতে পাহাড়ের লাইম স্টোন বা চুনা পাথর যৌগিভূত হওয়ার কারণে এই ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়।সাধারণত বৃষ্টি বা নদীর পানির কারণেও এমনটা হয়ে থাকে।
বৃষ্টি বা নদীর পানি ভূ-পৃষ্ঠের মাটি চুয়িয়ে ভূ-গর্ভস্থ চুনাপাথরের স্থরে পৌঁছানোর পূর্বে পানিতে কার্বন- ডাই-অক্সাইড যোগ হয়। যার ফলে ওই পানি অম্ল হয়ে যায়। এবং তাতে খুব সহজেই চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়। এবং পাহাড়ের অভ্যন্তর ভাগ ক্ষয়ে এমন গুহার সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে লাখ লাখ বছর সময় লেগে যায়।
হ্যাং সন ডুং গুহার এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রায় ৫০ লাখ বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়াটি শেষ হয়েছিল আনুমানিক ২০ লাখ বছর আগে।অবশ্য যে চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে এই গুহার সৃষ্টি হয়েছিল তার বয়স কিন্তু প্রায় ২৫ কোটি বছরেরও বেশি।
হ্যাং সন ডুং গুহাটির আয়তন প্রায় তিন কোটি পঁচাশি লাখ ঘনমিটার।এটি আবিষ্কারের আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহাটি ছিল মালয়শিয়ার ডির কেভ,যা এই গুহাটির আয়তনের অর্ধেকের ও কম।
গুহাটির দৈর্ঘ্য ৫.৬মাইল বা ৯ কিলোমিটারের ও বেশি। গুহাটির উচ্চতা ২০০ মিটার বা ৬০০ ফুটের ও বেশি। তবে মেঝে থেকে এর সর্বোচ্চ দূরত্ব ৫০০ মিটার বা ১০০৫ ফুটের ও বেশি। গুহাটির দুটি প্রবেশপথ খুব দূর্গম হলেও এর ভেতরে অনেক প্রস্থ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর প্রস্থ প্রায় ১৫০ মিটার বা প্রায় ৫০০ ফুট।
যেই নদীর কারণে এই গুহাটি সৃষ্টি হয়েছিল সেটি এখন ও, এই গুহার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিছু জায়গায় এই নদীর স্রোত এত যে, কোনো অবলোকন ছাড়া এটা পাড় হওয়া অসম্ভব প্রায়।আবার গুহাটির কিছু জায়গায় এটা এতটাই শান্ত যে তা সুইমিংপুল হিসেবে ও ব্যবহার করা যায়।
এইগুহার আরও একটি অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে,এর ভেতর দুটি বিশাল সাইজের টলেন রয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ গুহার ছাদের একাংশ কোনো কারণে ধসে গিয়ে গুহাটির যে অংশে সূর্যের আলো ও বৃষ্টির পানি একত্রে প্রবেশ করতে পারে তাকে টলেন বলে।
ভূ-গর্ভস্থ গুহার জীববৈচিত্র্য খুব সাদামাটা হলেও, এই টলেনগুলোতে পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। সাধারণত ভূ-গর্ভস্থ গুহাগুলোর দৈর্ঘ্য তিন থেকে চার কিলোমিটার এর বেশি হয় না, কারণ গুহাগুলোর দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে সাথে এর ভড় ও বাড়তে থাকে। গুহার ভিতরটা ফাঁপা হওয়ার কিছু দৈর্ঘ্য পর গুহার দেয়ালের পক্ষে সেই ছাদের ভড় বহন করা সম্ভব হয় না।
অথচ ভিয়েতনামের এই গুহারটির দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের তুলনায় দুই গুণের ও বেশি।অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ব্যতিক্রমের কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।
হ্যাং সন ডুং এর রেকর্ডধারী দৈর্ঘ্যের কারণ মূলত এর খাঁড়া দেয়াল। মেঝের সাথে সমকোণে দাঁড়িয়ে থাকায় এই দেয়ালগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ভড় বহন করতে পারে। এর ফলেই হ্যাং সন ডুং বিশ্বের বৃহত্তম গুহার খেতাব অর্জন করেছে। বর্তমানে ভিয়েতনামের এইগুহাটি তাদের এক জাতীয় উদ্যান ফুং না কিং ব্যাংয়ের অংশ হলেও এইগুহাটি প্রথম আবিষ্কার করেন এক রাখাল।
হো খানহ নামের এক রাখাল ১৯৯০ সালে, ঝড়-বৃষ্টির সময় এই গুহার প্রবেশ মুখে আশ্রয় নেন। হো খানহ এর ভাস্য মতে সেদিন গুহার ভেতর থেকে প্রচন্ড গর্জন ভেসে আসছিলো এবং সেই সাথে গুহার ভেতর থেকে মেঘের মতো ধোঁয়া ও বেরিয়ে আসছিলো। তিনি ভয় পেয়ে যাওয়ার সেদিন ঘরে ফিরে আসেন।
তারপর প্রায় দুই দশক গুহারটির কথা ভুলেই ছিলেন তিনি। এর পর ২০০৯ সাথে ব্রিটিশ গুহা গবেষণা সংগঠন সেখানে একটি বড় গুহার সন্ধানে সার্ভে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই খবর পেয়ে হো খানহ তাদের সাথে দেখা করেন এবং ১৯ বছর আগে খুঁজে পাওয়া সেই গুহাটির কথা জানান।
ব্রিটিশ গুহা গবেষণা সংগঠনের প্রধান হাওয়ার্ড ও ডেভ লেমবার্ট ১০-১৪ এপ্রিল ২০০৯ সালে বিশ্বের বৃহত্তম এই গুহা নেটওয়ার্কে আয়তন ও প্রশস্ততা পরিমাপ করতে সমীক্ষা শুরু করেন। হো খানহ দেখানো পথ ধরেই তারা হাং সন ডুং এর কাছে পৌঁছে যায়।
ব্রিটিশ এই সার্ভে দলের নের্তৃত্বে ছিলেন হাওয়ার্ড। অভিজ্ঞ এই গুহাচারী এর আগেও একাধিক বড় গুহা সার্ভে করেছেন। ২০০৯ সালে হ্যাং সন ডুং গুহাত তার প্রথম অভিযান দ্বিতীয় মুখের এক কিলোমিটার আগেই থেমে যায়,যার কারণ সেখানে প্রায় ২০০ মিটার নরম একটি ক্যালসাইট পাথরের দেয়াল রয়েছে। গুহাটির মেঝে থেকে ২০০ মিটার উঁচু, নরম এবং পিচ্ছিল পাথরের দেয়াল রয়েছে।
ক্লোস্টোন নামের ই পাথর বেয়ে উঠতে গেলে তা খোসে পড়ে যায়। তাই উপযুক্ত সরঁজাম ছাড়া এ দেয়ালে ওঠা সম্ভব হয় না।পরের বছর হাওয়ার্ড ও তার দল উপযুক্ত সরঁজাম নিয়ে এই গুহায় উপস্থিত হন। এবং পুরো গুহাটির সার্ভ সম্পন্ন করেন।
সেই থেকে গত দশ বছর হাওয়ার্ড ১০০ বারের ও বেশি এই গুহাটি অতিক্রম করেছেন। এমনকি সেখানের পর্যাটন ব্যবসার সাথে ও তিনি জড়িয়ে গেছেন।হাওয়ার্ডের দ্বিতীয় অভিযানে বেশ কয়েকজন জীব বিজ্ঞানীও ছিলেন।গুহাটির মধ্যে থাকা টলেন দুটিতে বিপুল পরিমাণ জীববৈচিত্র্য এবং জানা- অজানা অনেক বৃক্ষরাজির সন্ধান পেয়েছেন।
ভূ- গর্ভস্থ সেই জঙলে বাইরে থেকে খালি কয়েক প্রজাতির বানর ই সেখানে প্রবেশ করতে পারে।গুহার ২০০ মিটার উঁচু দেয়াল বেয়ে ওঠা নামা এসব বানরের জন্য কোন ব্যপারই না। জঙলেত মেঝেতে ঘুরে বেড়ানো সুস্বাদু শামুখ গুলোর খোঁজে এরা এখানে আসে। আর এই জঙলের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন সরিসৃপ,বাদুড়, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর এবং পাখি।
এছাড়া প্রানী জগতের নতুন সদস্য হিসেবেও কয়েকটি প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন তারা। যার মধ্যে রয়েছে মাছ, কাকড়া, চিংড়ি, বিছা এবং কাঠ উঁকুন। গুহার অন্ধকার পরিবেশে অনেক দিন ধরে বসবাস করায় তাদের গায়ের রং স্বচ্ছ এবং অনেকেরই প্রায় চোখ নেই।বিষয়টি অন্ধকার গুহায় বিবর্তনের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গুহার ভিতরে তারা দেখতে পান ছোট ছোট ফোয়ারা। এছাড়া গুহার ভিতরে আছে অনেক সুরঙ্গপথ, যা দিয়ে সহজেই ভিয়েতনামের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করা যায়।
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এতটা গভীরে হওয়ায় হ্যাং সন ডুং গুহার আবহাওয়া ব্যবস্থা ও সম্পূর্ণ আলাদা, অনেক সময় বাইরের আকাশ মেঘ মুক্ত হলেও হ্যাং সন ডুং এর ভেতর বেশি আদ্রতা থাকায় এর আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে।১৯৯০ সালে তেমন মেঘ ই বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন হো খানহ।
ভূ-গর্ভস্থ এই মেঘের কারণে হাওয়ার্ড এর সার্ভে ও বেশ কয়েক বার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০১৯ সালে এসে আবার নতুন করে রেকর্ড গড়ে এই হ্যাং সন ডুং। একদল ডুবুরি দল এই গুহার সার্ভেতে অংশ নেয়, তারা আবিষ্কার করেন, ভূ-গর্ভস্থ এই গুহাটি একটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে নিকটবর্তী হ্যাং থ্যুন আরেকটি গুহার সাথে সংযুক্ত। বছরের বার মাসই এই গুহাটি পানিতে ডুবে থাকে তাই পেশাদার ডুবুরি ছাড়া এটি আবিষ্কার করা সম্ভব ছিলো না।
নতুন এই গুহাটির সাথে সংযুক্ত হওয়ায় হ্যাং সন ডুং এর আয়তন এখন চার কোটি ঘনমিটার। কিন্তু হ্যাং সন ডুং বিশ্বের বড় গুহাগুলোর তালিকায় থাকতে পারবে বলে মনে করেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ স্যাটেলাইটের কল্যাণের বিশ্বের বড় বড় গুহা আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনে হ্যাং সন ডুং এর চেয়েও অনেক বড় গুহার অস্তিত্ব রয়েছে।
এই গুহা আবিষ্কারের চার বছর পর অথাৎ ২০১৩ সালে গুহাটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।কিন্তু ভিয়েতনামের আইন অনুযায়ী প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ১০০০ পর্যটক এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন। হ্যাং সন ডুং এর অনন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনের জন্য ই এমন সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে। এ গুহা পরিদর্শনে মাথাপিছু ৩ ডলার করে খরচ হবে।
ধীরে ধীরে ভিয়েতনামের এই এলাকা পর্যটন প্রিয় হয়ে উঠছে। ভিয়েতনামের সরকার পর্যটকদের সুবিধার জন্য প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ক্যাবল লাইন বানানো পরিকল্পনা করেছেন। প্রায় ২০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পটি এখন পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে স্থগিত আছে।
তাদের দাবী যে যুক্তিতে এখানে প্রতিবছর ১০০০ এর বেশি পর্যটক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, সেই একই যুক্তিতে এখানে ক্যাবল লাইন স্থাপন করা অনুচিত কাজ হবে। আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ভিয়েতনামে বর্ষাকাল থাকে তাই এইগুহাতে প্রবেশ করা যায় না। ভিয়েতনামের এই অপূর্ব সুন্দর এই গুহাটি পরিদর্শন করতে যাতে পারেন আপনিও। সেখানে গেলে মনে হবে পৃথিবী ছেড়ে পাতালের কোনো দেশে চলে এসেছেন।
মন্তব্য লিখুন