আমরা অনেকেই হয়তো জানি, নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২০ এর জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডা. রুহুল আবিদ এবং তার প্রতিষ্ঠান “হাইফা”। তিনি নিঃস্বার্থ ভাবে অসহায় ও বঞ্চিত মানুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষে গড়ে তুলেছিলেন এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি। নোবেলজয়ী না হলেও তার মনোনীত হওয়ার ঘটনাও আমাদের জন্য কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ডা. রুহুল আবিদ বিশ্বদরবারে আমাদেরকে গর্বিত করেছেন তার মানবিকতা ও সেবা প্রদানের মনোভাব দিয়ে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
Health and Education for All (HAEFA) হাইফা মূলত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের দরিদ্র ও বঞ্চিত গার্মেন্টস কর্মীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
আমাদের দেশের একটা বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠী বিভিন্ন পোশাক তৈরির কারখানায় কর্মরত। তারা পর্যাপ্ত বেতন ভাতা বা সুযোগ সুবিধা কোনটিই পায়না। এই অসহায় ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এগিয়ে আসেন ডা. রুহুল আবিদ ।
২০১১ সালে ডা. আবিদ কর্মরত ছিলেন আমেরিকার Warren Alpert Medical School -এ। সে সময় তিনি তার এক সহকর্মী Dr. Rosemary Duda সাথে বাংলাদেশের অসহায় জনগণের জন্য একটি সহযোগিতা মূলক প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করেন। সেই পরিকল্পনা থেকেই ২০১২ সালে ডা. আবিদ গড়ে তোলেন HAEFA (Health and Education for All)।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তিনি ঠিক করেন তার প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে এদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা নিয়ে। ঢাকা, গাজীপুর এবং শ্রীপুরের তিনটি কারখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ শুরু করে হাইফা।
হাইফা প্রথমত গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়মিত চেকআপের আওতায় রাখে। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষ লক্ষ্যই থাকে NCD (Non Communicable Diseases) নিয়ে। হাইফায় ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ , COPD (chronic obstructive pulmonary disease), রক্তশূণ্যতা, অপুষ্টি, গর্ভকালীন জটিলতা এবং টিবি রোগকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক্ষেত্রে হাইফা -কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয়। বিষয়টি হচ্ছে মালিকপক্ষের সহায়তা পূর্ণ মনোভাব অর্জন। এজন্য এই প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে কর্মক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণ না করে যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা যায়। মাত্র ৭ মিনিটেই নিয়মিত চেকআপ সাড়া হয় হাইফায়। এই রুটিন চেকআপকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করে নেয়া হয়েছে-
এত কম সময়ে এসব করা সম্ভব হয় হাইফার নিজস্ব আবিষ্কার “নীরোগ” নামের একটি ইএমআর সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে।
হাইফার আবিষ্কৃত একটি সফটওয়্যার “নীরোগ” যা অ্যান্ড্রয়েড ট্যাবলেটের মত একটি ইএমআর সিস্টেম। ২০১৬ সাল থেকে হাইফায় এই নীরোগ ইএমআর ব্যবহার করা হচ্ছে। সোলার প্যানেলের শক্তি ব্যবহার করে মোবাইল রেকর্ডিং এর একটি ব্যবস্থাই এই সফটওয়্যারকে উল্লেখযোগ্য করেছে। সোলার প্যানেলের ব্যবহার একে অফলাইনেও কার্যকর রাখে। নীরোগ প্রতিটি রোগীর তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করে একটি নিরাপদ সার্ভারে সৌরশক্তি ব্যবহৃত ওয়াইফাই রাউটার ব্যবহার করে সংরক্ষণ করে রাখে। সংগৃহীত তথ্য লোকাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত নীরোগ ইএমআর ব্যবহার করে হাইফা প্রায় ২৫,০০০ গার্মেন্টস কর্মীদের চেকআপ করেছে।
হাইফা মূলত বাংলাদেশের বঞ্চিত একটি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছে। গত তিন বছরে এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ৩০,০০০ এরও বেশি গার্মেন্টস কর্মীদের কার্যক্ষেত্রেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। এছাড়াও ৯,০০০ এরও বেশি শ্রমিক এবং সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সার্ভিক্যাল ক্যান্সার নিয়ে সচেতন করা এবং চিকিৎসায় সহায়তা করেছে হাইফা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি ১৫০,০০০ এরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।
২০২০ এর এপ্রিলে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির সাথে সম্মিলিত ভাবে প্রজেক্ট HOPE নামে একটি কর্মসূচির সূচনা করে হাইফা । এই কর্মসূচির অর্ন্তভূক্ত ছিল ৪ দিনব্যপী একটি প্রশিক্ষণ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকারী ও বেসরকারি স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়াই ছিল এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য।
এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ডা. আবিদ এবং হাইফা আরও প্রায় ৩৫টি সংস্থার সাহায্যে ১,২০০ এরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর নাগাদ আরও ৩,৬০০ কর্মী প্রশিক্ষণ পাবে বলে ধারণা করা হয়েছে।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে ডা. আবিদের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায় এসকল স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই এবং প্রায় ১০,০০০ KN95 মাস্ক এবং জরুরি চিকিৎসা সেবা হিসেবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত অ্যাজমা রোগীদের জন্য ইনহেলার সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশী-আমেরিকান চিকিৎসক ডা. রুহুল আবিদ বর্তমানে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির আওতাভুক্ত Alpert Medical School এর অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়াও তিনি Cardiovascular Research Centre (CVRC), Cardiothoracic Surgery Division, Rhode Island Hospital এর প্রধান পরিদর্শকের দায়িত্বে আছেন।
বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেন একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দলনেতা হিসেবে। PHC (Global Health) নামক প্রোজেক্টটি ছিল নিরাময়যোগ্য ও নিরাময় অযোগ্য রোগ নিয়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন হৃদরোগ নিয়েও কাজ করেছিলেন এই প্রোজেক্টের আওতায়।
তিনি জাপানের Nagoya University থেকে পিএইচডি অর্জন করেন Molecular Biology and Biochemistry নিয়ে। এরপর ২০০১ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের Beth Israel Deaconess Medical Centre থেকে ভাস্কুলার মেডিসিনে ফেলোশিপ প্রোগ্রাম করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ২০০২ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একজন লেকচারার হিসেবে।
২০০৬ সালে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ডা. আবিদ ২০১১ সালে ব্রাউন মেডিকেল স্কুলে কাজ শুরু করেন। সেসময় তিনি তার ভাস্কুলার বায়োলজি ল্যাব নির্মাণ করেন Rhode Island Hospital এর CVRC তে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত Alpert Medical School এর মেডিকেল ফ্যাকাল্টি প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
২০১৭ তে Brown Global Health Initiative এর প্রধান ফ্যাকাল্টি মেম্বারের দায়িত্ব পান। বর্তমানেও তিনি এই পদে বহাল আছেন। তিনি ভাস্কুলার বায়োলজি, কার্ডিও ভাস্কুলার ডিজিজ এবং গ্লোবাল হেলথ নিয়ে বিভিন্ন রিসার্চ পেপার ও প্রতিবেদন লিখেছেন। এছাড়াও লিখেছেন মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য বইয়ের কিছু অধ্যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে American Heart Association এবং Association of International Cancer Research এ কর্মরত ছিলেন।
২০০৬ সালে ডা. আবিদ Young Investigator Award অর্জন করেন ATVB, American Heart Association থেকে। এছাড়াও ২০১১ সালে American Heart Association ভাস্কুলার বায়োলজিতে তার অবদানের জন্য তাকে সম্মাননা প্রদান করে Werner Risau New Investigator পুরস্কারে ভূষিত করে।
ডা. রুহুল আবিদ এবং তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হাইফা ২০২০ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন প্রাপ্ত হন University of Massachusetts, Boston থেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনথ্রোপলজির অধ্যাপক Jean-Philippe Belleau তথ্যটির সত্যতা যাচাই করেছেন। ২১১ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডা. আবিদ একজন ছিলেন। যদিও এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে World Food Programme (WFP)।
আমাদের দেশের একজন মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে এদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছেন। আমরা অনেকেই তার সম্পর্কে জানতাম না। ২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার এবং তার প্রতিষ্ঠান হাইফার মনোনয়ন প্রাপ্তির খবর তাকে ব্যাপকভাবে আলোচনায় নিয়ে আসে। পুরস্কার না পেলেও তার অবদান সম্পর্কে পুরো বিশ্ব জেনেছে। তিনি বিশ্বদরবারে আমাদেরকে গর্বিত করেছেন। তার এবং তার প্রতিষ্ঠান হাইফার এই মানবিক কর্মসূচী বজায় থাকুক এই কামনা করি আমরা সবাই।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ HAEFA, The Daily Star, The Daily New Nation, Dhaka Tribune.
মন্তব্য লিখুন