স্বপ্নের ভূবণ গ্রীনল্যান্ড এর আত্ম পরিচিতি

গ্রীনল্যান্ড হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে রহস্যময় ও বড় দ্বীপপুঞ্জ। এই সপ্নিল রাজ্যর চিত্রময় ছবির রং যেন পৃথিবীর মানুষের হৃদয়কে করে আন্দোলিত। শুভ্র বরেফর চাদরে আবৃত এই স্বর্নটুকরো যেন কল্পনার চাইতেও কয়েকগুণ বেশি সপ্নিল।

সাদা বরফের আদলে লুকিয়ে থাকা প্রাকিতিক সৌন্দর্য, ডলফিনের হাতছানি, পেঙ্গুইনের কারসাজি, ইউরেনিয়াম, প্রাকিতিক সম্পদ যেন রহস্য সৃষ্টি করে কৌতুহলী হৃদয়ে। পৃথিবীর সকল চক্ষুকে পলকিত করার স্বাক্ষর যেন গ্রীনল্যান্ডই রাখে।

গ্রীনল্যান্ডের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান

ভাইকিন্স নামক একদল জলদস্যু মাছ শিকার করতো আটলান্টিক মহাসাগরে। মূলত তারাই সর্বপ্রথম গ্রীনল্যান্ড দ্বীপের আবিষ্কার করে। আর্কটিক ও আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেষে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ দ্বীপের নাম গ্রীনল্যান্ড।যার আয়তন প্রায় একুশ লক্ষ শিষট্রি হাজার ছিআশি বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের থেকে যার আয়তন প্রায় পনেরো গুন বেশি।

ভৌগোলিক ভাবে এর অবস্থান উত্তর অ্যামেরিকায় হলেও বর্তমানে তা ইউরোপ অর্থাৎ ডেনমার্ক এর অধীনে। এর পচ্চিম দিক সাধারণত ব্যাফিন উপসাগর ও ডেভিস প্রনালী থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে কানাডীয় আর্কটিক দ্বীপ পুঞ্জ থেকে।এর পূর্বদিক ডেনমার্ক প্রনালী দ্বারা আইসল্যান্ড থেকে পৃথক হয়েছে।

এর পূর্বকূল বরাবরই স্থাপিত হয় গ্রীনল্যান্ড জাতীয় পার্ক যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পার্ক হিসাবে বিবেচিত। গ্রীনল্যান্ড এর ভৌগোলিক অবস্থানের জটিলতার জন্য সূর্যের দেখা খুবই কম সময় মাত্র দুই বা তিন ঘন্টা দিন থাকে। এই শুভ্র চাদরে আবৃত রাজ্যর প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি যায়গাই প্রতিনিয়ত বরফে ঢাকা থাকে।

এখানে শৈত প্রবাহ অনেক বেশি সময় অব্যাহত থাকে।তাই তাপমাত্রা (-১০ থেকে -৫০) ডিগ্রি সেলসিয়াস বহাল থাকে। গ্রীনল্যান্ডের বেশিরভাগ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে। পচ্চিমে বরফের পরিমান ও অত্যাধিক শীতল হওয়ায় লোকের বসবাস কম ও কিছু জেলেদের বাস।আর দক্ষিণ দিকে কিছুটা গাছপালা সমৃদ্ধ ও কৃষি উপযোগী।

প্রাচীন কালের তথ্য অনুযায়ী এই সপ্নিল রাজ্য প্রথম বসবাস শুরু হয় পালেও এস্কিমো গ্রুপের সময়কালে। গ্রীনল্যান্ডের সবচেয়ে আদিম অধিবাসী হলেন ইনুইট উপজাতিরা।

তাছাড়া ইউরোপিয়ান,নরওয়েজিয়ান ও আইসলেন্ডের বাসিন্দারা এখানে বসবাস করেন। ইনুইট অধিবাসীরা এই সপ্নের রাজ্যকে নিজ ভাষায় কালালাইত নুনাত নামে ডাকেন।

স্বপ্নের ভূবণ গ্রীনল্যান্ড এর আত্ম পরিচিতি

গ্রীনল্যান্ডের স্বাধীনতা ও শাসনআমল

সর্বপ্রথম ১২৭২ সালে গ্রীনল্যান্ড ছিল নরওয়ের ইউনিয়নের অধীনে। পরর্বতিতে ড্যানিস আমলে নরওয়েজিয়ান রিকোলাইজেশন হয় ১৭২১ সালে। ডেনমার্কের অধীনে গ্রীনল্যান্ড বিঘটিত হয় ১৮১৪ সালে।১৯৫৩ সালে সায়তশাসনের আওতায় আসে।

গ্রীনল্যান্ড সরাস্ট্রশাসন অর্থাৎ নিজস্ব নিয়মের ভিতর পর্দাপন করে ১৯৭৯ সালে।তারা ২০০৮ সালে স্বাধীনতা এবং ২০০৯ সালে নিজস্ব সরকার গঠন করে। তাদের প্রধান মন্ত্রীর নাম কুপিক ক্লে ইস্ট।

স্বাধীনতা অর্জন করলেও তা পুরোপুরি নিয়ত্রন করেন ডেনমার্কের দ্বিতীয় রানী মার্গ্রেরেথী। বলা যায় গ্রীনল্যান্ড হলো ডেনমার্কের শাসন অধীন একটি প্রদেশ।

গ্রীনল্যান্ড নুক নগরী

গ্রীনল্যান্ডের রাজধানী ও পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট রাজধানী বলা যায় নুক শহরকে। গ্রীনল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি লোকের বসবাস এই নগরে। প্রায় ১৭০০০ হাজার লোক বসবাস করে এই নগরীতে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও তাপমাত্রা (৫-৫.৯) ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কারনে এই শহর পরিচয় পায় বসবাসের উল্লেখযোগ্য যায়গা হিসাবে। দেশের অর্থনিতী ও সচ্ছলতা অনেকটা রাজধানীর উপর নির্ভর করে। বলা যায় গ্রীনল্যান্ডের প্রানচান্ঞল্য হলো নুক শহর।

গ্রীনল্যান্ডের ভাষা ও সংস্কৃতি

গ্রীনল্যান্ডের মাতৃভাষা সাধারনত গ্রীনল্যান্ডিক ভাষা। তাছাড়াও ড্যানিস,ইংরেজি ও ইউরোপীয় ভাষায় তারা পারর্দশি। তাদের মধ্যে অনেকেই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী।

জাতিগত ভেদে ৮৮% গ্রীনল্যান্ডিক ইনুইট, ১২% ড্যানিস ও কিছু ইউরোপীয়। এই দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রথা কালালাইত ও স্ক্যানডিনাভিয়ান। তাদের সংগীত কালচারের মধ্য নানক,সুমে,ফ্রাইডে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

গ্রীনল্যান্ডে সামাজিকতার বিবেচনায় আত্নহত্যার হার অনেক বেশি যা ২০১০ সালে হয়েছিলো রেঙকিং শীর্ষ। তাছাড়া ও অ্যালকোহল সেবনের পরিমান তুলনায় মূলক ডেনমার্ক এর থেকেও অনেক বেশি।

শিক্ষা ও খেলাধুলা

গ্রীনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা সংগঠিত হয় অনেকটা ডেনমার্কের মতোই। এখানে দশ বছর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন তারপর মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক।

গ্রীনল্যান্ডে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান যার নাম ইউনিভার্সিটি অব গ্রীনল্যান্ড যা নুক শহরে অবস্থিত। গ্রীনল্যান্ডিক সংস্কৃতির আদলে এখানে ফুটবল, ট্রাক এন্ড ফিল্ড, হ্যান্ডবল,স্কিনিং জনপ্রিয়।

জনসংখ্যা ও অর্থনিতী

বরফের আদলে আবৃত সপ্নের রাজ্য গ্রীনল্যান্ড এর অনেকটা অংশই বসবাসের অযোগ্য। এই দেশের জনসংখ্যা তার আয়তনের তুলনায় খুবই কম। ২০২০ সালের হিসাব অনুসারে মাত্র ৫৭০০০ হাজার মানুষের বসবাস।

বাংলাদেশের বিবেচনায় জনসংখ্যার হার প্রায় তিন হাজার ভাগের এক ভাগ যা পৃথিবীর জনসংখ্যা ভিত্তিক জরিপে ২১৪ তম অবস্থানে। মানুষের জনসংখ্যার ঘনত্ব ০.০২৮ বর্গ কিলোমিটার। যার অধিকাংশ পূর্বউপকূলে এবং নুক শহরেই প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি লোকের বসবাস।

আরও পড়ুনঃ “মহাবন আমাজন” জঙ্গলের জানা অজানা তথ্য

এই খানের মানুষের অর্থনিতীর মূল অংশ জুড়েই রয়েছে মৎস্য শিকার। তাছাড়া পর্যটন শিল্প ও কৃষির উপর কিছুটা নির্ভরশীল। গ্রীনল্যান্ডের কৃষি পদ্ধতি হয় গ্রীন কালচার অর্থাৎ কাচের তৈরি বেস্টনির ভিতর। কৃষির পরিমান কম হওয়ায় তাদের খাদ্য এর অনেকটা যোগান মেটে ডেনমার্ক থেকে আমদানির দ্বারা।

আনুমানিক ২০১১ সালের ধারনা অনুযায়ী তাদের জিডিপি ১.৮ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২০০০০ মার্কিন ডলার এর মতো। গ্রীনল্যান্ডের মুদ্রার নাম ড্যানিস ক্রোন। যার এক টাকার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ১৩ টাকার সমান।

আবহাওয়ার পরির্বতন

গ্রীনল্যান্ডের অধিকাংশ অংশ শুভ্র বরফে আচ্ছাদিত। বরফের গলন যেহেতু তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল তাই আবহাওয়ার পরির্বতন ও ব্যাপক পরিলক্ষিত। ১৯৯১ সালের রির্পোট অনুযায়ী পাওয়া যায় এখানে শীতল তাপমাত্রা ও প্রবল ঠান্ডার দরুন কোন কোন স্থানে বরফের পুরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার।

বরফের বিগলন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহনীয় ভূমিকা রাখে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট, বননিধন ও নানাবিধ কারনে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ড যেহেতু বরফের আধার তাই এর শুভ্র বরফের গলন দুশ্চিন্তাজনক। পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ায় হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা যায় গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ২৩ ফুট ।

যার ফলে প্লাবিত হতে পারে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত সহ পৃথিবীর অনেক নিন্ম অঞ্চল। ১৯৯১ ও ২০০৪ সালের রির্পোট সাপেক্ষে গ্রীনল্যান্ড সমগ্র এলাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা ওই স্থানের তুষারপাত আর পানির লেভেল বাড়ার অন্যতম কারণ।

প্রাকিতিক সৌন্দর্য ও খনিজ সম্পদের আধার

পৃথিবীর মানচিত্রে এক অপরুপ সৌন্দর্য ও শুভ্র বরফের চাকচিক্য যে এত সুমধুর হতে পারে তার প্রতিকৃতি গীনল্যান্ড। এখানকার মানুষ ও প্রকৃতি যেন মিশে আছে এক সমতালে।

গ্রীনল্যান্ড শুধু সাইবেরিয়ার মতো শুভ্র বরফের দেশ নয়, এই বরফের আদলে লুকিয়ে আছে নানাবিধ খনিজ সম্পদ যেমন লোহা, আকরিক, সোনা, মানিক্য। সম্প্রতি গ্রীনল্যান্ড এ ইউরেনিয়াম এর সন্ধান ও মিলেছে যা রহস্যময়।

তাপমাত্রার প্রাদুভাবে বরফ যতই গলছে তার সাথে বেরিয়ে এসেছে খনিজ সম্পদ পাওয়ার অপার সভাবনা। তাইতো র্মাকিন প্রেসিডেন্টদের সপ্নই যেন গ্রীনল্যান্ড ক্রয় করা। ১৯৪৬ সালে তৎকালীন সময়ের র্মাকিন প্রেসিডেন্ট এই দেশকে কিনতে চেয়েছিলো ১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে।

সম্প্রতি বর্তমান অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল যা আনুষ্ঠানিকতা পাবার আগেই ডেনমার্ক সরকার নাকচ করে দেয়। এক কথায় বলতে গেলে গ্রীনল্যান্ড তার রুপবৈচিত্রের পাশাপাশি ধারন করে আছে নানাবিধ সম্পদের প্রাচুর্য।

শেষকথন

পৃথিবীর মধ্যে যদি অপরুপ দৃষ্টিনন্দন যায়গা থাকে তার অন্যতম স্বাক্ষর রাখে রুপকথার এই দেশ গ্রীনল্যান্ড।এর প্রকৃতি ও রং এর আচ্ছাদন যেন মানুষকে বুঝিয়েছে পৃথিবী আসলেই কতটা সুন্দর হতে পারে।

মেরুঅঞ্চলের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে গ্রীস্মকালের সময়ে টানা ২-৩ মাস দিন থাকে যাকে মিডনাইট সান নামে অবহিত করা হয়। তাছাড়াও এখানের আকাশে এক ধরনের লাইট দেখা যায় যা নর্থওয়েস্ট লাইট নামে পরিচত।

বরফের বুকে বাহারি সব নৌকার সমাহার ও বরফের উপর দিয়ে যাতায়াতের জন্য কুকুরের দ্বারা চালিত গাড়ি যেন সবারই মন কারে। গ্রীনল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যার ৭০% আসে হাইড্রোপাওয়ার থেকে।

ভ্রমন পিপাসু মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন হতে পারে গ্রীনল্যান্ড। তাই সকল ভ্রমনপ্রিয় মানুষের গ্রীনল্যান্ডের অপরুপ রুপবৈচিত্রের স্বাক্ষী হওয়া উচিত নিজ চোখের পলকিত দৃষ্টিতে।

Exit mobile version