হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭-১২ আগস্ট ২০০৪) প্রথাবিরোধী লেখক ও বহুমূখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথাবিরোধী, মৌলবাদ ও ধর্মীয় কুঃসঙ্কারের বিরোধিতা করে বেশ আলোচিত হয়েছেন। প্রগতিশীল চিন্তাধারার বহু স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার লেখনিতে। সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী লেখক হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে খুব অল্প বয়সেই। তিনি নবম শ্রেণিতে থাকাকালিন ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কচিকাঁচার আসরে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।
তিনি ছিলেন একাধারে ব্যকরণবীদ,কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং অধ্যাপক ছিলেন। তার এই বহুমূখী প্রতিভা বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তার লেখার সংখ্যা ৭০টি৷ সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, প্রেম, প্রতিবাদ ইত্যাদি তার কবিতার মূল উপাদান।
‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ তার সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। হুমায়ুন আজাদের ১০ টি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে-
- অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)
- জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০)
- সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫)
- যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭)
- আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০)
- হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা(১৯৯৩)
- আধুনিক বাংলা কবিতা(১৯৯৪)
- কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮)
- কাব্য সংগ্রহ(১৯৯৮)
- পেরোনোর কিছু নেই(২০০৪)
১৯৯০ সালের দিকে তিনি একজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন৷ তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৩। তার ভাষা দৃঢ়, কাহিনি গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তার উপন্যাস, ‘ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সবকিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫),মানুষ হিসেবে আমার অপরাধ সমূহ (১৯৯৬),যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬), শুভব্রত; তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), কবি অথবা দন্ডিত পুরুষ (১৯৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ (২০০১), শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২), ১০০০ এবং আরও ১ টি ধর্ষণ (২০০৩), একটি খুনের স্বপ্ন (২০০৪), পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)।
আরও পড়ুনঃ বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের ৭০টি শিক্ষনীয় বিখ্যাত উক্তি বা বানী
প্রাবন্ধিক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন অনন্য। তার লেখনি রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা ধর্মীয় কুঃসঙ্কারের মূলে কুঠারাঘাত করে। ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। তার প্রবন্ধগ্রন্থ সমূহ হচ্ছে-
- শিল্পকলার বিমানবিকীরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮)
- ভাষা আন্দোলন ; সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০)
- নারী (১৯৯২)
- প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২)
- নিবিড় নীলিমা (১৯৯২)
- মাতাল তরণী (১৯৯২)
- নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২)
- জলপাই রঙের অন্ধকার (১৯৯২)
- রবীন্দ্র প্রবন্ধ/ রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৯৩)
- শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা(১৯৯৩)
- আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭)
- পার্বত্য চট্টগ্রাম ;সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা (১৯৯৭)
- মহাবিশ্ব (২০০০)
- দ্বিতীয় লিঙ্গ (মূল: সিমোন দ্যা বেভোয়ার, ২০০১)
- আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩)
- ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪)
নারী, দ্বিতীয় লিঙ্গ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ তৎকালিন মৌলবাদীদের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। এবং রাজনৈতিক ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। যার ফলে একটি মৌলবাদী চক্র ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী বই মেলায় বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনে হুমায়ুন আজাদের উপর প্রাণঘাতি হামলা চালায়। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান এবং একই বছর ৭ই আগস্ট গবেষণার জন্য জার্মানির মিউনিখ শহরে পাড়ি জমান। কিন্তু ১২ আগস্ট নিজ বাসায় তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
এই মহান প্রথাবিরোধী লেখক ও বহুমূখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন আজাদ তার সাহিত্য কর্মের জন্য ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন।
ছবিঃ সংগৃহীত