অতীত হয়ে যাওয়া কাল বর্তমানের তুলনায় সুখকর হয়, চেতনার মানসপটে সেই সময়ের বিশেষ কোনো ঘটনায় হৃদয় উদবেলিত হয়, ঠোঁটের কোণে হাসি এসে বসে। কল্পনার সে জগৎটা ভালোই লাগে, যতক্ষণ-না বাস্তব জ্ঞান চেতনায় কড়া না-নাড়ে এবং এক দীর্ঘশ্বাস না-পড়ে! সুনীলের ‘সেই সময়’ উপন্যাসটিও ঠিক তেমনটি হৃদয়ে চমৎকৃত ভাবটা ধরে রাখে, যতক্ষণ-না সাতশ পৃষ্ঠার কাহিনীটা শেষ হয়ে যাবার কথা মনে পড়ে! ভালো জিনিস, যেমন- মধু একবারে গ্রহণ করতে নেই, তাতে আসল স্বাদ উপভোগ করা যায় না; বরং তিক্ত স্বাদের সৃষ্টি করে। তেমনি এই মনোমুগ্ধকর উপন্যাসটি দ্রুত পড়তে ইচ্ছে হয় না— শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে! কিন্তু কাহিনির ধুয়ায় মজে পরের ঘটনা জানার আকাঙ্ক্ষাটাও দমানো যায় না। এ বড়োই মধুর সমস্যা! আর তাতে দীর্ঘ আড়াই বছর সময় নিয়ে লেখা ‘সেই সময়’ উপন্যাসও যেন কত তাড়াতাড়িই-না শেষ হয়ে যায়। সত্যি, কোনো বস্তু সৃষ্টি করতে যতটা সময় লাগে, সৃষ্ট বস্তু দেখে তা বোঝা যায় না!
সুনীলের ত্রয়ী উপন্যাস সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম তিনটিই বাংলা সাহিত্যের এক অপূর্ব সৃষ্টি। এ ত্রয়ী উপন্যাস শুধু তাদেরই ভালো লাগবে, যারা ইতিহাসপ্রিয়, কাব্যপ্রিয়, কবিপ্রিয়, জীবনী নিয়ে জানতে আগ্রহী, সেই সময়ের (অতীতের) সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী! আগ্রহী হওয়া উচিত, যদি-না তিনি পণ্ডিত কিংবা গবেষক না-হন। কেননা লেখক নিজেই বলেছেন, বাকি সব ঐতিহাসিক উপন্যাসের মতন তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত চরিত্রকে নিজের ইচ্ছেমতো সাজিয়েছেন, ইচ্ছেমতো কথা বলিয়েছেন। ‘সেই সময়’ ঐতিহাসিক ও গবেষণাধর্মী উপন্যাস। তবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধর্ম হচ্ছে তা ঐতিহাসিক প্লট নিয়ে লেখা হবে কিন্তু ঔপন্যাসিক তার পছন্দমতো ও প্রয়োজন মতো চরিত্র, ঘটনার আবির্ভাব ঘটাতে পারবেন। এ তিনটি উপন্যাসের প্রত্যেকটির পাঠেই অনেক অজানা তথ্য একসঙ্গে, ধারাবাহিকভাবে, সাজানো-গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায়, যা পাঠকের জ্ঞান আহরণের তৃষ্ণা নিঃসন্দেহে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
এবারে বলা যাক ‘সেই সময়’ কেন সময় পরিভ্রমণ; কী আছে এতে, কীরকম জ্ঞানের খোঁজ পাওয়া যাবে…
সময়টা মূলত ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ। এই সেই সময়, যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলনের মতো মহৎ উদ্যোগ নেন। কিন্তু সমাজে এ নতুন সংস্কার করতে চাইলে কেমন কঠিন অবস্থা হয়েছিল, আর যখন বিধবাবিবাহ অনুমতি পেল, তখন কেমন অবস্থা ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের, সমাজ কীরূপ আচরণ করেছিল তাঁর সঙ্গে এবং তাঁর সুহৃদদের সঙ্গে? অন্য সকলে কি আইন প্রণয়ন হলেই তারা পূর্বের কুসংস্কার ভুলে নতুনকে স্বাগত জানিয়েছিল?
কেই-বা প্রথম বিধবাবিবাহ করে তার সূচনা ঘটালেন, আর সেই বিধবা নববধূদের অবস্থা কেমন ছিল? আর এ সকল বিবাহের খরচ কীভাবে কে জোগাড় করতেন, বিয়েগুলোও কি সহজ ছিল? এছাড়াও ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রথম নারী বিদ্যালয় নির্মাণ করলে জীবনঝুঁকি যে কীভাবে এলো, আর কীভাবে তা দূর হলো, তা জানতে ‘সেই সময়’ বইটি পড়ে ফেলুন আর সময় পর্যটন করে জ্ঞান অর্জন করুন চটপট!
বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মধুবাবুর ছেলেবেলা, তাঁর বাল্যকালের কাহিনী, কেমন ছিল তার কৈশোর, আর কেন তার এতো বিদেশি কবি হতে ইচ্ছে হলো— সবটাই খুব নিপুণভাবে সুনীল নিয়ে এসেছেন তাঁর উপন্যাসে।
এছাড়াও মধুসূদন যখন ধর্মান্তরিত হলেন, তখন তাঁর পরিবারের কী অবস্থা হয়েছিল? তার পত্নী, ছেলে মেয়ে, পিতা, মাতা, তাঁর বান্ধবগন সম্পর্কে ধারাবাহিক বর্ণনা রয়েছে এখানে। এই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা যে কীভাবে কাব্য লেখা শুরু করলেন, আর সেসব কাদেরই-বা উৎসর্গ করলেন, কবিমুখে তা জানতে পড়ুন ‘সেই সময়’। পাশপাশি ভাবুন তো, কবি তাঁর সৃষ্টি তাঁর কোনো প্রিয় ব্যক্তিকে উৎসর্গ করার পর কোনো দুরবস্থায় যদি উক্ত ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তখন কবিমনের কী অবস্থা হয়?
এছাড়াও আমাদের যে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, সেই ঊনিশ শতকের কলকাতার তৎকালীন সামাজিক অবস্থা যাতে ফুটে উঠেছে, তার রচয়িতা কালী প্রসন্ন সিংহ সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে তাঁর জীবনের কিছু চমৎকৃত অধ্যায় আরেকটু ছাঁচে ঢেলে ‘সেই সময়’-এ যে বিশেষ চরিত্রটি তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কে আগেই বলে দিয়ে আপনাদের আগ্রহ কমিয়ে দিতে চাই না!
তাই, শেষের আগে মনে করিয়ে দিচ্ছি, এই বিমুগ্ধকর ‘সেই সময়’ উপাখ্যান না-পড়ে নিজেকে চমৎকৃত হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করবেন না যেন! আহ! সেই সময়! সত্যিই সেই সময়ে কতকিছুই না হয়েছিল! জীবন চলে যায়, তবু তার পদধুলো রেখে যায়! কবি ও কবিমনের নতুন ভাবের উদয় ঘটায়, এই তো ‘সেই সময়’।
মন্তব্য লিখুন