২০২১ সাল বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকীর বছর। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের “মহারাজা” সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়। শিল্প ও সাহিত্যে বিখ্যাত রায় পরিবারের ছেলে তিনি। তার পিতা বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক সুকুমার রায় এবং প্রপিতামহ লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক ও প্রকাশক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সত্যজিৎ এই রায় পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন।
অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক এবং চিত্রকর হিসেবে পরিচিত। কিন্তু চলচ্চিত্রকার হিসেবে তার সুখ্যাতি অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
কর্মজীবনের শুরুতে সত্যজিৎ ছিলেন একজন ভিজুয়ালাইজার। ১৯৪৩ সালে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার ইংরেজ এবং বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে বিবাদের জেরে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
সে বছরই সিগনেট প্রেস নামক প্রকাশনা সংস্থায় প্রচ্ছদ আঁকার কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। পথের পাঁচালী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির স্বপ্নও এই সময়ে এসে জোরালো হয়ে ওঠে। ১
৯৪৭ সালে চিদানন্দ দাসগুপ্ত এবং অন্যান্যদের সাথে প্রতিষ্ঠা করেন “কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি”। এ সময় সোসাইটির সুবাদে দেশি বিদেশি প্রচুর সিনেমা দেখেন সত্যজিৎ যা তাকে একজন চলচ্চিত্রকার হতে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করেছে।
ফরাসি চিত্রপরিচালক জঁ রনোয়ার একবার তার দ্য রিভার চলচ্চিত্রের জন্য ভারতবর্ষে আসেন। সেসময় সত্যজিৎ রায় তাকে যথার্থ চিত্রস্থান খুঁজতে সাহায্য করেছিলেন। সত্যজিৎ রনোয়ারকে পথের পাঁচালী নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানালে তিনি কাজটা এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেন।
এরপর সত্যজিৎ আর বিলম্ব করেন নি তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি কিছু প্রামাণ্যচিত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন।
চিত্রঃ পথের পাঁচালী (১৯৫৫)
সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে একঝাঁক নতুন মুখ নিয়ে ১৯৫২ সালের শেষদিকে পথের পাঁচালী নির্মাণ শুরু করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরের মধ্য দিয়েই তিনি চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছেন। তবে আর্থিক অসুবিধার কারণে দীর্ঘ ৩ বছর যাবত চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ করতে হয়েছে।
অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। সে বছরই মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। নিখুঁত গ্রামবাংলার সাথে দুর্গা আর অপুর শৈশবের চমৎকার চিত্রায়ণ করেছিলেন সত্যজিৎ।
বিভূতিভূষণের লেখা দুর্গা অপুকে জীবন্ত করে তোলার তার এ প্রয়াস ছিল শতভাগ সফল। সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এই ছবিটি বর্তমানেও নিজ স্থান বজায় রেখেছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও আলো ছড়ায় পথের পাঁচালী।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া লিখেছিল- “It is absurd to compare it with any other Indian cinema…. Pather Panchali is pure cinema”. অসংখ্য পুরস্কার আছে এই চলচ্চিত্রের অর্জনের ঝুলিতে। এরমধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৯৫৬ সালে ৯ম কান চলচ্চিত্র উৎসবে “Best Human Documentary” অর্জন উল্লেখযোগ্য।
চিত্রঃ অপুর সংসার (১৯৫৯)
সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র “অপরাজিত” যেখানে তরুণ অপুর কলেজ জীবন, দারিদ্র্যর সাথে খাপ খাইয়ে চলা ও মায়ের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কের চিত্রায়ণ করা হয়েছে।
পথের পাঁচালীর পর ১৯৫৬ সাল নির্মিত এই চলচ্চিত্র তাকে আন্তর্জাতিক মহলেও সুপরিচিত করে তোলে। এই ছায়াছবিটি ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জেতে। অপুর জীবন নিয়ে পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে “অপুর সংসার” নামে তৃতীয় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সত্যজিৎ।
কলকাতায় অপুর দরিদ্র জীবনের চিত্র থেকে কাহিনির শুরু। এক অস্বাভাবিক ঘটনায় অপর্ণাকে বিয়ে করে সে। সময়ের ব্যবধানে অপুর সুখের সংসারেও ঘটে বিয়োগান্তক পরিণতি। কিন্তু জীবন এবার অপুকে একেবারে খালি হাতেও ফিরিয়ে দেয়নি।
অনেক সমালোচকদের মতে এটিই অপু ত্রয়ীর সেরা চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রেই সত্যজিৎ রায়ের পছন্দের দুজন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুরের রূপালি পর্দায় পথচলা শুরু। পথের পাঁচালী, অপরাজিত এবং অপুর সংসার – অপু ত্রয়ীর এ তিনটি চলচ্চিত্রই সত্যজিৎকে একজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।
চিত্রঃ কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২)
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ মৌলিক চিত্রনাট্য থেকে প্রথম চলচ্চিত্র বানান। “কাঞ্চনজঙ্ঘা” নামক এ ছায়াছবিটি তার বানানো প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। দার্জিলিং এর পাহাড়ি পরিবেশে বিত্তশালী এক পরিবারের একদিন বিকেলের ঘটনাপ্রবাহ চিত্রায়ণ করা হয়েছে এ চলচ্চিত্রে।
পরিবার এবং নিজের মনের ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে এক অপূর্ব এবং জটিল মননের চলচ্চিত্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। দর্শক সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসিত এ চলচ্চিত্রটি। পরিবার ও সমাজের সাথে মনের এমন টানাপোড়েন সত্যজিৎ খুব সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এখানে।
চিত্রঃ চারুলতা (১৯৬৪)
১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথ রচিত “নষ্টনীড়” অবলম্বনে “চারুলতা” নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। ১৯ শতকের আবহে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে এক বাঙালি বধূ চারুর একঘেয়ে জীবন এবং ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখানো হয়েছে।
অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে এটি একটি নিখুঁত চলচ্চিত্র। বিশেষ করে বাগানে দোলনায় বসে থাকা চারুর আড়চোখে অমলকে দেখার দৃশ্যটি একটি আলাদা আবেশ তৈরি করেছিল।
চারু চরিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং অমল চরিত্রে সৌমিত্রের অভিনয় প্রশংসা কুড়ায়। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন এই চলচ্চিত্রে তিনি সবচেয়ে কম ভুল করেছেন এবং এটি আবার কখনো নির্মাণ করতে হলেও তিনি একইভাবেই নির্মাণ করবেন। এক বাঙালি সমালোচক চারুলতার কঠোর সমালোচনা করলে সত্যজিৎ এর প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন।
অপুর সংসার চলচ্চিত্রের সমালোচনারও জবাব দিয়েছিলেন তিনি। সাধারণত সত্যজিৎ রায় সমালোচনা নিয়ে চিন্তিত হতেন না। তবে এই দুই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন।
চিত্রঃ নায়ক (১৯৬৬)
চারুলতা পরবর্তী বছরগুলোতে সত্যজিৎ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান তার সিনেমা গুলো নিয়ে। বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনতে তখন বেশি কাজ করেছেন তিনি।
“নায়ক” সেরকমই একটি চলচ্চিত্র যেখানে নতুন ধারার বাংলা ছায়াছবির পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৬ সালে উত্তম কুমার ও শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত এ চলচ্চিত্রে এক তারকার জীবনের অন্তরালের নানা ঘটনা দেখানো হয়।
ট্রেন যাত্রায় এক সফল চিত্রনায়ক এবং এক সংবেদনশীল তরুণী সাংবাদিকের কথোপকথন নিয়ে এ সিনেমা। ছবিটি বার্লিনে পুরস্কার জিতলেও সে সময় এটি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে একটু ব্যতিক্রম ধারার এ চলচ্চিত্রটি শিল্পের বিবেচনায় বেশ সফল বলা চলে।
চিত্রঃ গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮)
সত্যজিৎ পুত্র সন্দ্বীপ বলতো তিনি কেবল গুরুগম্ভীর বড়দের জন্য ছবি বানান। ছেলের এমন অনুযোগের কথা ভেবেই ১৯৬৮ সালে প্রপিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর শিশুতোষ গল্প থেকে নির্মাণ করেন “গুপী গাইন বাঘা বাইন”। তার সবচেয়ে ব্যবসাসফল এ ছবিতে দেখা যায় নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক গায়ক এবং আরেক ঢোলবাদকের গল্প। ভূতের রাজার বর পেয়ে তারা দুই
রাজ্যের যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে। চলচ্চিত্রটি শিশুদের উদ্দেশ্যে বানানো হলেও ছোট বড় সকলেই সমান উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেছিল। এই ছবির পরবর্তী পর্ব “হীরক রাজার দেশে” বানানো হয় ১৯৮০ সালে। এই চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ তার রাজনৈতিক মতের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। হীরক রাজা মূলত ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণাকালীন সরকারের প্রতিকীরূপ।
চিত্র: জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯)
৭০ এর দশকে সত্যজিৎ রায় তার রচিত বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা থেকে দুটি ছবি বানান। “জয় বাবা ফেলুনাথ” এবং “সোনার কেল্লা” নামক চলচ্চিত্র দুটিই বইয়ের মত সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করে্। দুটো ছবিতেই ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য চলচ্চিত্র গুলো হল- মহারাজা, জলসাঘর, পরশ পাথর, দেবী, মহানগর, তিন কন্যা, অভিযান, কাপুরষ, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন অরণ্য। হিন্দি ভাষায় ও তিনি দুটো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এগুলো হল – শতরঞ্জ কে খিলাড়ি এবং সদগতি।
১৯৮৩ সালে “ঘরে বাইরে” চলচ্চিত্র বানানোর সময় হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিৎ রায়ের। অসুস্থতার কারণে জীবনের বাকি ৯ বছর তার কাজ ছিল খুবই সীমিত। ১৯৮৪ সালে পুত্র সন্দ্বীপ রায়ের সাহায্যে ঘরে বাইরের নির্মাণকাজ শেষ করেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে তার ছেলেই ক্যামেরার কাজ দেখতেন। তার শেষ তিনটি ছবি অভ্যন্তরীণ মঞ্চে নির্মাণ করায় সেগুলো ছিল অনেক বেশি সংলাপ নির্ভর। তার শেষ তিনটি চলচ্চিত্র গণশত্রু, শাখা প্রশাখা এবং আগন্তুক।
১৯৯২ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সত্যজিৎ রায়। অসুস্থ অবস্থাতেই জীবনের শেষ এবং গগুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অস্কার গ্রহণ করেন। এই বিশেষ সম্মাননা তিনি সারাজীবনের অসাধারণ কাজের জন্য পেয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই মহারাজা মৃত্যুবরণ করেন।
সত্যজিৎ রায় তার প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরুপ বহু সম্মাননা লাভ করেছেন। চার্লি চ্যাপলিনের পর তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট পেয়েছিলেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে লাভ করেন ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানসূচক লেজিওঁ দনরে তে ভূষিত করে।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার অস্কার লাভের পাশাপাশি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ভারতরত্নে ভূষিত হন তিনি। সে বছরই মৃত্যুর পর লাভ করেন মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার।
জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন- “সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র সূর্য না দেখা একই কথা”। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি তার শিল্পী মন ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণে আমাদের সেরা কিছু কাজ উপহার দিয়ে গিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রকে বদলে দেয়া মহারাজা তিনি। জন্ম শতবার্ষিকীতে এই অসাধারণ গুণী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
মন্তব্য লিখুন