প্রেম শ্বাশত চিরন্তন। প্রত্যেক মানুষেই জীবনে কারো না কারো প্রেমে পড়েন। প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে কত গল্প -গাঁথা। যেমন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এর প্রেমের কাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেম কাহিনী। এটি বিশ্ব বিখ্যাত ইংরেজ লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়রের একটি কালজয়ী ট্রাজেডি নাটক।
রোমিও-জুলিয়েটের এই সুকরুণ প্রেম কাহিনী সংঘটিত হয়েছিল ইতালিতে। নাটকটি মন্টগো এবং ক্যাপুলেট পরিবারের মধ্যে দীর্ঘ লড়াইয়ের গল্প।
মূলকাহিনীতে দেখা যায়, এই প্রেমিক -প্রেমিকা যুগল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার চেয়ে আত্নহত্যাকেই ঠিক বলে মেনে নেয়। তরুণ এই যুগলের ভালবাসার জন্য মৃত্যুবরণ আজো পৃথিবীর মানুষকে একই আবেগে নাড়া দেয়।
নাটকের নায়ক। মন্টেগু এবং লেডি মন্টেগুর পুত্র ও উত্তরাধিকারী। প্রায় ১৬ বছরের এক যুবক রোমিও সুদর্শন, বুদ্ধিমান এবং আবেগময়। অপরিণত হলেও তার আদর্শবাদ এবং আবেগ তাকে চূড়ান্ত পছন্দনীয় চরিত্রে পরিণত করে।
তিনি তার পরিবার এবং ক্যাপিউলেটদের মধ্যে সহিংস লড়াইয়ের মাঝখানে থাকেন তবে তিনি সহিংসতায় মোটেও আগ্রহী নন। তবে তার একমাত্র আগ্রহ ‘প্রেম’।
নাটকের শুরুতে তিনি রোজালাইন নামের এক মহিলার প্রেমে পাগল হয়েছিলেন কিন্তু জুলিয়েটকে দেখার পর তিনি তার প্রেমে পড়ে যায় এবং রোজালিনকে ভুলে যান।
নাটকের নায়িকা। ক্যাপিউলেট এবং লেডি ক্যাপিউলেটের এর মেয়ে। ১৩ বছর বয়সী একটি সুন্দরী মেয়ে জুলিয়েট নাবালিকা হিসেবে নাটকটি শুরু করেছিল।
প্রেম এবং বিবাহ সম্পর্কে খুব কম চিন্তা করেছিলেন, তবে তিনি তার পরিবারের শত্রুর পুত্র রোমিওর প্রেমে পড়ে যান। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আত্নবিশ্বাসী তার নার্স, যদিও নার্স রোমিওর বিপক্ষে মোড় নেওয়ার মুহুর্তে তিনি তার জীবন থেকে নার্সকে বন্ধ করতেও রাজি ছিলেন।
জুলিয়েটের চাচাতো ভাই। নিরর্থক, ফ্যাশনেবল এবং সৌজন্যতার অভাব সম্পর্কে অনেক সচেতন। তিনি আক্রমনাত্মক, হিংস্র এবং তরোয়াল আঁকার জন্য তীব্র হয়ে ওঠেন যখন তিনি মনে করেন যে তার গর্ব আহত হয়েছে। তিনি মন্টেগু পরিবারকে ঘৃণা করেন।
রাজার এক আত্মীয় এবং রোমিওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি নাটকের একটি অত্যন্ত অসাধারণ চরিত্র। তিনি প্রেম ক্লান্তিকর সম্পর্কে রোমিওর রোম্যান্টিকাইজড ধারণাগুলি খুঁজে পান এবং রোমিওকে ভালবাসাকে যৌন ক্ষুধার সাধারণ বিষয় হিসাবে দেখার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন।
রোমিওর কাজিন এবং চিন্তাশীল বন্ধু।
রাজার এক আত্মীয় এবং জুলিয়েটের বাবা ক্যাপিউলেটকে বেশি পছন্দ করেন। ক্যাপিউলেট জুলিয়েটের জন্য যোগ্য পাত্র হিসেবে প্যারিসকে নির্বাচন করেছিলেন।
একজন ফ্রান্সিসকো ফ্রিয়ার, ক্যাথলিক পবিত্র মানুষ এবং রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এর উভয়ের বন্ধু। দয়ালু, সংযমের প্রবক্তা, বহুদর্শী, বিজ্ঞ ও ভৈষজ্যাভিজ্ঞ ছিলেন।
জুলিয়েটের নার্স, যিনি জুলিয়েটকে ছোটবেলায় বুকের দুধ খাওয়াতেন এবং সারা জীবন জুলিয়েটের দেখাশুনা করেছিলেন।
ক্যাপিউলেট পরিবারের কুলপতি, জুলিয়েটের পিতা এবং মন্টেগুদের তিক্ত শত্রু। তিনি সত্যিই তার মেয়েকে অনেক ভালবাসেন। তাই মেয়ের সুখের জন্য তিনি প্যারিসকে মেয়ের যোগ্য পাত্র হিসেবে নির্বাচিত করেন।
জুলিয়েটের মা, ক্যাপিউলেটের স্ত্রী। নৈতিক ও বাস্তববাদী সহায়তার জন্য তিনি সবসময় নার্সের উপর নির্ভর করছেন।
রোমিওর বাবা, মন্টেগো বংশের পিতৃপুরুষ এবং ক্যাপিউলেটের প্রধান শত্রু।
রোমিওর মা, মন্টেগুর স্ত্রী। রোমিওর ভেরোনা থেকে নির্বাসিত হওয়ার খবর শুনার পর তিনি ছেলের শোকের জন্য মারা যান।
প্রিন্স এস্কালাস:
ভেরোনার রাজা। ভেরোনায় রাজনৈতিক ক্ষমতার আসন হিসাবে তিনি সবসময় জনশক্তি বজায় রাখতে উদ্বিগ্ন থাকতেন।
রোমিওর চাকর, যিনি রোমিওকে জুলিয়েটের মৃত্যুর খবর এনেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে জুলিয়েট আসলেই মারা যায় নি।
মান্তুয়ার একজন দরিদ্র ‘ওঝা’। যিনি রড় রকমের অর্থের বিনিময়ে রোমিওর কাছে বিষ বিক্রি করতে চাইছিলেন না। কারণ মান্তুয়ার আইন অনুসারে সে বিষ বিক্রয়ের শাস্তি মৃত্যু।
ক্যাপিউলেট বাড়ির দুজন চাকর। যারা তাদের গুরুর শত্রু মন্টেগুদের ঘৃণা করেন।
রোজালিনকে রোমিও প্রথম ভালোবেসেছিলেন কিন্তু রোজালাইন কখনো তার প্রেমে সাড়া দেয় নি।কারণ তিনি সতীত্ব পূর্ণ জীবন যাপনের শপথ করেছেন।
নাটকটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ভালোবাসার থিম। নাটকটি ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেমের গল্প উপস্থাপন করে। রোমান্টিক প্রেমকে কেন্দ্র করে মূলত রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এর মধ্যে প্রথম দেখাতে দেখা দেয় নিবিড় আবেগ।
এই নাটকের ভালবাসা হিংসাত্মক এবং পরমার্থাত্নক যা অন্য সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধের উপর ক্ষমতা রাখে। এটি একটি মর্মান্তিক প্রেম। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এর ভালবাসা আজও অমর হয়ে আছে। যেন ভালবাসার অপর নাম ‘রোমিও -জুলিয়েট’। তারা প্রেমিক যুগলদের ভালবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ইতালির প্রাচীন ‘ভেরোনা’ নামক শহরে ধনী ও প্রতাপশালী দুই বংশ বাস করিতেন । এই দুই ধনী পরিবার হলেন ক্যাপিউলেট এবং মন্টেগু। ক্যাপিউলেট পরিবারের কন্যা ‘জুলিয়েট’ এবং মন্টেগু পরিবারের পুত্র ‘রোমিও’। দুই পরিবারের মধ্যে অনেক দিন থেকে ঝগড়া চলছে, সময়ের সাথে সাথে তা আরো বেড়ে চলে।
সম্পর্কের তিক্ততা এতো বেশি হয়েছিল যে, দুই পরিবারের দাস-দাসীরাও একে অপরের সাথে দেখা হলে ঝগড়া লেগে যেতো। তাদের এই বিরক্তিকর কর্মকান্ডে সবাই অস্বস্তির মধ্যে থাকতো।
মজার বিষয় হলো, জুলিয়েটকে দেখার আগে রোমিও প্রেমে পড়েছিল একই পরিবারের আরেক তরুণী ‘রোজালিন’ -এর। রোজালিনের সাথে দেখা করতেই উতলা হয়ে ছিলো সে। আর সে উদ্দেশ্যে বন্ধুদের পরামর্শে ক্যাপিউলেটের বাড়িতে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন রোমিও।
অনেক খ্যাতিমান অতিথিরা সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন। অনেক সুন্দরীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন রোজালিনও সেখানে উপস্থিত থাকবে। এজন্য রোমিওর বন্ধু ‘বেনভোলিও’ তাকে ছদ্মবেশে যেতে বলেছিলেন যাতে তিনি রোজালিনকে দেখতে পারেন, তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারেন।
তাই ক্যাপিউলেটের বাড়িতে এই অনুষ্ঠানে রোমিও ও তার বন্ধু বেনভোলিও ছদ্মবেশে গিয়েছিল। কিন্তু রোজালিনের দেখা মেলেনা সেখানে। আর সে দেখা না হওয়াতেই যেন লুকিয়ে ছিল পৃথিবীর এক ‘অমর প্রেম কাহিনী’। সেখানে জুলিয়েটের সাথে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় রোমিও।
অনুষ্ঠান থেকে নিজের কক্ষে ফিরে ঘুম আসছিলোনা জুলিয়েটেরও। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রোমিওর সাথে কল্পনায় কথা বলতে থাকে। জুলিয়েটের আকর্ষণে বাড়ি ফিরতে না পেরে রোমিও তখন দেয়াল বেয়ে উঠে যায় জুলিয়েটের কাছে। তারা একে অপরের প্রতি তাদের ভালবাসার কথা ঘোষণা করে এবং বিয়ে করে একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
জুলিয়েটের নার্স ও ফ্রিয়ার লরেন্সের সহায়তায় গোপনে বিয়ে করলেন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট । ফ্রিয়ার লরেন্স তাদের বিয়ে দেয় যাতে করে এই দুই পরিবার শত্রুতাকে আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
এসব ঘটনা কিছুটা জানাজানি হয়ে গেলে জুলিয়েটের চাচাতো ভাই ‘টাইবল্ট’ এর সাথে বিরোধে জড়িয়ে সম্মুখযুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় রোমিওর। টাইবল্ট রোমিওর বন্ধু ‘মার্কুটিওকে’ হত্যা করে।
রোমিও লড়াই ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু মার্কুটিওর মৃত্যুর পর রোমিও টাইবল্টকে হত্যা করেছিলেন। এজন্য ভেরোনার রাজা রোমিওকে ভেরোনা থেকে নির্বাসিত করেন।
টাইবল্টের মৃত্যু ও রোমিওর নির্বাসনের খবর শুনে জুলিয়েট অনেক ভেঙ্গে পড়েন। জুলিয়েটের বিমর্ষ অবস্থা দেখে তার বাবা -মা প্যারিস নামক এক ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন কিন্তু তারা জানেন না যে জুলিয়েট ইতিমধ্যেই বিবাহিত।
জুলিয়েট ফ্রিয়ার লরেন্সের সাহায্য চায়। ফ্রিয়ার তাকে এক ধরনের বিষ পান করার পরামর্শ দেন, যে বিষ পান করলে মৃত্যু হবে না, কিন্তু সবাই মৃত বলে মনে করবে। নিদিষ্ট সময় পর বিষের প্রভাব কেটে গেলে পানকারী আবার সুস্থ হয়ে যাবে। জুলিয়েট বিষ পান করে মৃতবৎ অবস্থায় চলে গেলো।তাকে মৃত ভেবে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে রেখে দেওয়া হলো।
ফ্রিয়ার লরেন্স রোমিওর কাছে একটি চিঠি লিখে পুরো ঘটনা ব্যক্ত করেন এবং জুলিয়েট মারা যায়নি, ঔষধ খেয়ে মৃত্যুর ভান করছে এবং জুলিয়েটকে এসে নিয়ে যেতে বলেন চিঠিতে।
কিন্তু ফ্রিয়ারের চিঠি রোমিওর কাছে পৌঁছায় নি। ঐদিকে রোমিওর চাকর বালথাসারের কাছ থেকে জুলিয়েটের মৃত্যুর খবর শুনে রোমিও। তারপর বিষ সংগ্রহ করে নিজেও জীবনের পাট চুকিয়ে ফেলার জন্য জুলিয়েটের কবরের কাছে আসে। সেখানে জুলিয়েটের হবু স্বামী প্যারিস তাকে দেখে আক্রমণ চালায়।
দুইজনের সংঘর্ষে প্যারিসের মৃত্যু হয়। এরপর রোমিও মারা যায় বিষ পান করে। জুলিয়েটের জ্ঞান ফেরার পর দেখল তার পাশে রোমিওর মৃত শরীর পড়ে আছে। তাই দেখে জুলিয়েট রোমিওর পকেটের থেকে ছুরি বের করে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিল। জুলিয়েট!! রোমিও!! প্যারিস!! তিনটি মৃতদেহ পড়ে রইল পাশাপাশি।
এসব ঘটনা শুনে রাজা ঘটনাস্থলে আসেন। রাজা, মন্টেগু ও ক্যাপিউলেটদের দিকে ঘুরে বললেন যে তাদের এই শত্রুতার জন্যেই আজ এই দুই সন্তানদের প্রান দিতে হয়েছে।
তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে পুরনো শত্রুতাকে ভুলে যাবার জন্য পণ করেন। ক্যাপিউলেট বললেন তিনি রোমিওর জন্য একটি মূর্তি বানাবেন এবং মন্টেগু জুলিয়েটের জন্য একটি স্বর্নের মূর্তি বানাবেন। দুই সন্তানের এইভাবে বিসর্জনের মাধ্যমে দুই পরিবারের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়র এর “রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট” বিয়োগান্তক নাটকের ভালবাসার জন্য মৃত্যুবরণ আজো পৃথিবীর মানুষকে একই আবেগে নাড়া দেয়!! এভাবেই মৃত্যুর মাধ্যমেই অমর হয়ে রইল দু’জনের প্রেমকাহিনী।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন