১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী সসস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের মহান ব্রত পালন করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ইংল্যান্ড হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই অস্থায়ী সংবিধান আদেশ অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে আত্মনিয়োগ করেন একটি নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কঠিন কাজে।
তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য কর্মসূচির। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ নিয়ে যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিলো সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু যেভাবে সমাজতন্ত্রের আদলে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা প্রয়োগ করে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল তা সত্যিই আশ্চর্যজনক।
তিনি যে পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়’ গ্রহণ করেছিলেন তা বিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটি নব্য স্বাধীন দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি সময়োপযোগী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
দুই মাসের মধ্যে ভারত বাংলাদেশে থেকে তার সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭২ সালের ২৫ শে মার্চ ভারতের সাথে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন যা ছিলো তার কূটনীতিক দূরদর্শিতার ফল। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেন।
মাত্র ১০ মাসের মধ্যে জাতীকে সংবিধান উপহার দেন, এতো কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কোন দেশ সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি। তার দুরদর্শি পররাষ্ট্রনীতির ফলে অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলো। জাতিসংঘ, ওয়াইসি,কমনওয়েলথ সহ পৃথিবীর ১২৬ টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হন৷
সদ্য স্বাধীন দেশকে শক্ত অর্থনৈতিক,প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সবধরণের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। একটি সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামাজিক জীবন তখনও বেশ বিশৃঙ্খল।
খাদ্যাভাব, অবকাঠামোগত ভঙ্গুর অবস্থা, অর্থনৈতিক খাতের ধ্বংস হওয়া, শরনার্থীর চাপ ও পুনর্বাসনে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশটি বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে সফলতার সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রতিটা মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ করেন৷ প্রতিটি গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক খাতকে সচল রাখার চেষ্টা করেন। অর্থনৈতিক খাতের পুনঃগঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ ছিলো না।
তারপরেও তিনি বেসরকারি ও অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করে উৎপাদন ব্যবস্থায় এক দিগন্তকারী সফলতা অর্জন করেন।
এছাড়াও কৃষিতে ভর্তুকি সহ ২৫ একর পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে কৃষিতে আমূল বিপ্লবের সম্ভবনা সৃষ্টি করেন৷ ব্যাংক বিমা খাতে সংস্কার আনয়ন করে সহজলভ্য করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেনো ভেঙে না পরে সেজন্য তিনি ড.কুদরতি খোদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং যুগান্তকারী শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেন।
বঙ্গবন্ধু একদিকে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাথে সদ্ভাব রেখে বৈরি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নায়নে ওপর জোর দেন। এবং অনেকাংশে সফল হন।
১৯৭৩ সালে তিনি দেশে প্রথম নির্বাচন আহ্বান করেন এবং নির্বাচনে তার জনপ্রিয়তার ফলে আওয়ামীলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের পুনঃবাসন ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য তিনি ব্যপক পরিকল্পনা করেন। এবং যোগ্য জওয়ানদের নিয়ে একটা আধা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন।
একদিকে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী ও এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণ অসন্তোস ক্রমশই বাড়তে থাকে। অপরদিকে পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর থেকে তা বাতিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার সার্বিক বিবেচনায় বৈশ্বিক চাপের পক্ষে গিয়ে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয় ফলে দেশে দুই ধরণের মতাদর্শের জন্ম হয় এবং নিজ রাজনৈতিক দলে কোন্দল দেখা দেয়।
শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দূর্নীতির খবর প্রকাশ পেতে থাকে যা সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত করে। ফলে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সংস্কারের কথা চিন্তা করেন।
১৯৭৪ সালে বন্যা, খাদ্য ঘাটতি, বৈদাশিক মুদ্রা সঙ্কট, বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনিচ্ছার ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যারফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঐক্যের সংকট তৈরি হয়। দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে।
উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে জানুয়ারি মাসে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবাদপত্র ও বিচার ব্যবস্থার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে একদলীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু করেন।
১৯৭৫ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি দেশে প্রচলিত সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একমাত্র জাতিয় দল গঠন করেন। তার এই একদলীয় শাসল ব্যবস্থা তৎকালিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ম্যানিফেস্টোর আদলে গঠন করা হলেও তার মূল লক্ষ্য ছিলো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
কারণ তখনকার দল ব্যবস্থা ছিলো বিচ্ছিন্ন ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নির্ভর। দেশে সার্বিকভাবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অন্য কোন উপায় তখন ছিলো না। একদলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের সূচনাও তিনি করেন। উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যোগ, গ্রামীণ কৃষি বিপ্লব, মুদ্রামানের সংস্কার, রফতানি ও আমদানির মধ্যে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ।
আরও পড়্রনঃ ডিজিটাল প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ
কিন্তু তিনি তার পরিকল্পনা ও স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নি। কতিপয় সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী সৈন্য ও দেশী -বিদেশি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ১৯৭৫ সালে ১৫ ই আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু, তার উপস্থিত পরিবার পরিজন সহ তার কয়েকজন সহকর্মীকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, ব্যহত হয় সাংবিধানিক ধারার প্রকৃত গতিপথ।
ছবিঃ সংগৃহীত