স্কটল্যান্ডের দুঃসাহসী সেনাপ্রধান “ম্যাকবেথ“। নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ জয় করে আনন্দ নিয়ে ফোরেসের প্রাসাদে ফিরছিলেন। এমন সময় তিন ডাইনি দৃশ্যমান হলো ম্যাকবেথের সামনে এবং ম্যাকবেথ সম্পর্কে তারা ভবিষ্যৎবাণী করল একদিন তিনি স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন।
স্ত্রীর প্ররোচনায় লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বশবর্তী হয়ে স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানকে হত্যা করল ম্যাকবেথ রাজা হওয়ার জন্য। রাজা ডানকানকে হত্যা করে স্কটল্যান্ডের রাজা হলো ম্যাকবেথ।
কিন্তু ডানকানকে হত্যা করেই সে থেমে থাকলো না। নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য ও শত্রুর সন্দেহের হাত থেকে রক্ষার জন্য একের পর এক খুন করেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে ম্যাকবেথের অপশাসনে, তার অত্যাচারী ভূমিকায় স্কটল্যান্ডের মানুষ অতিষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে লেডী ম্যাকবেথ নিজের এবং তার স্বামীর কৃত অপরাধের জন্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে এবং পাগলপ্রায় হয়ে যায়। একসময় লেডী ম্যাকবেথ মারা যান।অন্যদিকে ম্যাকডাফের হাতে পরাজিত হয়ে ম্যাকবেথ মারা যায়।
নাটকের কিছু চরিত্রের তালিকাঃ
ডানকানঃ স্কটল্যান্ডের রাজা
ম্যাকবেথঃ রাজা ডানকানের দুঃসাহসী সেনাপতি।প্রথমে ছিল গ্লামিসের থেন,পরে কডোরের থেন এবং শেষে স্কটল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন।
[এখামে থেন মানে রাজার অধীনস্থ কোন এক অঞ্চলের অধিপতি ]
লেডী ম্যাকবেথঃ ম্যাকবেথের স্ত্রী।
ব্যাঙ্কোঃ ম্যাকবেথের বন্ধু ও সহযোগী এবং ডানকানের বাহিনীর আরেকজন সেনাপ্রধান।
ফ্লিয়ান্সঃ ব্যাঙ্কোর ছেলে।
ম্যালকমঃ রাজা ডানকানের বড় পুত্র।
ডোনালবেইনঃ রাজা ডানকানের ছোট পুত্র।
ম্যাকডাফঃ ফাইফের থেন( অর্থাৎ ফাইফ নামক অঞ্চলের অধিপতি।)
লেডী ম্যাকডাফঃ ম্যাকডাফের স্ত্রী।
ম্যাকডাফের পুত্র
সিওয়ার্ডঃ নর্থামব্রিয়ার আর্ল, ইংরেজ সামরিক বাহিনীর প্রধান।
তিন ডাইনি
নাটকের মূল বিষয়বস্তুঃ
উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার লোভ এবং এর ফলে ম্যাকবেথের পরিণতি। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতার লোভ মানুষকে কিভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।যারা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চান তাদের উপর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তব ও মানসিক প্রভাব এই নাটকে দেখানো হয়েছে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। রাজা ডানকানের দুই সেনাপতি ম্যাকবেথ আর ব্যাঙ্কো। স্কটল্যান্ডের এই দয়ালু রাজার বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের বিদ্রোহ দমন করেছেন তারা। তাই জয়ের আনন্দ নিয়ে ফোরেসের প্রাসাদে ফিরছেন দুই সেনাপতি।
ফেরার পথে ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কোর সামনে আসে অদ্ভুত তিনটি নারীমূর্তি। তারা আসলে কোনো জীবন্ত প্রাণী বা প্রেতাত্মা নয়। আসলে তারা তিনজন ডাইনি।ম্যাকবেথের জন্য তারা অপেক্ষা করেছিল। ম্যাকবেথকে তারা অভিবাদন জানায়। প্রথম ডাইনি ম্যাকবেথকে বলল, “গ্লামিসের অধিপতি ম্যাকবেথ, তোমায় অভিনন্দন জানাই”। দ্বিতীয় ডাইনি বললো, “কডোরের অধিপতি ম্যাকবেথ, তোমায় স্বাগত জানাই ”। তৃতীয় ডাইনি বললো, “স্কটল্যান্ডের ভাবী রাজা ম্যাকবেথ, তোমায় স্বাগত জানাই”।
ডাইনিদের দেখে যত অবাক হলেন তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন তাদের এসব কথা শুনে। গ্লামিসের অধিপতি তিনি হতে যাচ্ছেন তা তিনি জানেন কিন্তু কডোরের অধিপতি থাকতে তিনি কেমন করে গ্লামিসের অধিপতি হবেন। আর স্কটল্যান্ডের রাজা সে তো স্বপ্ন।
আরও পড়ুনঃ
“ওথেলো” উইলিয়াম শেক্সপিয়র এর একটি বিয়োগান্ত নাটক!
“রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট” উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কালজয়ী ট্রাজেডি নাটক!!
ডাইনিরা ব্যাঙ্কো সম্পর্কে বলে, তার বংশের কেউ স্কটল্যান্ডের রাজা হবে। এরপর তিন ডায়নি বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।এরপর ব্যাঙ্কো আর ম্যাকবেথ দুজন ফিরে আসে ডানকানের প্রসাদে। এরিমধ্যে রাজার দূত এসে ম্যাকবেথকে জানায় যে তাকে ‘থেন অফ কডর‘ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
ডায়নিদের দুটো কথা মিলে যাওয়ায় ম্যাকবেথের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা গোপন আকাঙ্ক্ষাটি জেগে উঠল।ডানকান ম্যাকবেথের দূর্গে এক রাতের অতিথি হতে চাইলেন।ডায়নিদের সব কথা ম্যাকবেথ তার স্ত্রীকে চিঠিতে জানায়। এ কথা শুনে লেডী ম্যাকবেথ লোভে পরে যায়।
তার মনে রাণী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। তাই তার স্বামীকে সিংহাসনে বসানোর লক্ষ্যে ডানকানকে হত্যা করার পরিকল্পনা জানায় ম্যাকবেথকে।
ম্যাকবেথের মনে রাজা হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও ডানকানে হত্যা করে সে রাজা হতে চাননি। তাই লেডী ম্যাকবেথের কথায় সে প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু লেডী ম্যাকবেথ তাকে সাহস দেয় এবং নানা কৌশলে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়। এরপর আতিথ্য গ্রহনের রাত্রিতেই ম্যাকবেথ হত্যা করে ডানকানকে এবং হত্যার দায় চাপিয়ে দেয় দুই দেহরক্ষীর উপর।
ভোর বেলায় ম্যাকডাফ ও ল্যানেক্স এসে রাজার ঘরে তার মৃতদেহ দেখতে পায়। এর ফলে ম্যাকবেথকে খুনি বলে সন্দেহ করে ম্যাকডাফ। একথা রাজার দুই ছেলে ম্যালকম ও ডোনালবেইন জানার পর তারা প্রানের ভয়ে রাজ্যে ছেড়ে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে পালায়।
এই সুযোগে ম্যাগবেথ ডানকানের হত্যা তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে সিংহাসনে বসেন।তার রাজ্য চালানোর সঙ্গী হন রস ও ম্যাকডাফ।
এতকিছুর পরেও ম্যাকবেথ স্বস্তি পান না। ব্যাঙ্কো-সম্পর্কিত ভবিষ্যৎবাণীটি তাকে তাড়া করে। এক রাজকীয় ভোজসভায় ব্যাঙ্কো ও তার পুত্রকে আমন্ত্রণ জানায় এবং গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে হত্যা করে ব্যাঙ্কোকে।
কিন্তু তার পুত্র ফ্লিয়ান্স পালিয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে ম্যাকবেথের অপশাসনে, তার অত্যাচারী ভূমিকায় স্কটল্যান্ডের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।এদিকে ম্যাকডাফ ও ইংল্যান্ডে গিয়ে ম্যালকমের সাথে হাত মেলায়। এই কথা শুনে ম্যাকবেত রেগে গিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে এবং শত্রুর সন্দেহের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য আবার যান ডাইনিদের কাছে। ১ম ডাইনি তাকে ম্যাকডাফ থেকে সতর্ক থাকতে বলে। ২য় ডায়নি তাকে বলে, নারী গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ কোনো মানুষ ম্যাকবেথের ক্ষতি করতে পারবে না। ৩য় ডাইনি বলে, যতক্ষন না বিশাল বার্নাম বন পাহাড়ের উপর আসসে ততক্ষন তার পতন হবে না।
ডাইনিদের একথা শুনে ম্যাকবেথ ম্যাগডাফের প্রাসাদে গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে তার স্ত্রী ও পুত্রকে হত্যা করান।ইংল্যান্ডের রাজার প্রসাদে ম্যালকম ও ম্যাকডাফের কথা হয়। তারা যুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেন।এমন সময় ডানকানের সভারস সেখানে এসে জানায় দেশের শোচনীয় অবস্থা এবং ম্যাকডাফের স্ত্রী ও পুত্রকে হত্যার কথা।
এইদিকে লেডী ম্যাকবেথ অসুস্থ। তিনি নিজের ও স্বামীর কৃত অপরাধের জন্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে এবং পাগলপ্রায় অবস্থা।একটি দৃশ্যে দেখানো হয় সে ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন এবং কথা বলছেন।
লেডী ম্যাকবেথের এই ঘুমের ঘোরে বলা কথার মধ্যে দিয়ে তার ও ম্যাকবেথের সব অপরাধই প্রকাশ পেয়ে যায়।বার্নামের বনে আশ্রয় নিয়েছে ইংরেজ ও স্কচ সামন্তদের যৌথ সৈন্যবাহিনী যেখানে তারা ম্যালকম, সিওয়ার্ড ও ম্যাকডাফের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করেন।
নিজেদের সংখ্যা গোপন রাখতে প্রবীণ ইংরেজ সেনাপ্রধান সিওয়ার্ড সবাইকে বন থেকে ডাল কেটে নিয়ে তার আড়ালে অগ্রসর হতে বলেন। এর ফলে ডাইনিদের প্রথম ভবিষ্যৎবাণী ফলে যায়। এইদিকে ম্যাকবেথ খবর পান লেডী ম্যাকবেথ আর নেই। ফলে ম্যাকবেথ আরও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ডানসিনান দুর্গের সামনে চলে আসে ম্যালকমের সৈন্যবাহিনী।মুখের সামনে থেকে ডাল সরিয়ে ফেলে তারা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে ম্যাকবেথের মনে ছিল একটিমাত্র ভরসা।
ডায়নিরা বলেছিল, নারীর গর্ভজাত সন্তানের হাতে তার পরাজয় নেই। ম্যাকডাফ ম্যাকবেথের মুখোমুখি হন।স্ত্রী পুএের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিনি দৃঢ়সংকল্প। কিন্তু ম্যাকবেথ তখন ম্যাগডাফকে বলে, তোমরা যত সহজে দুর্গে প্রবেশ করেছে, তত সহজে আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। কারন তার শরীর মায়াবলে সুরক্ষিত, নারীর গর্ভজাত সন্তান তাকে পরাজিত করতে পারবে না।
এরপর ম্যাকডাফ জানায় তার জন্ম রহস্য। তিনি জানান স্বাভাবিকভাবে মাতৃগর্ভ থেকে তিনি ভূমিষ্ট হননি।সঠিক সময়ের আগে মাতৃগর্ভ থেকে তুলে নেয়া হয়েছে তাকে। একথা শুনে ম্যাকবেথের বাঁচার আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়।অতঃপর ম্যাকবেথের পরাজয় হয়।ম্যাকবেথের ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে ম্যাকডাফ এলেন। এরপর ম্যালকমকে রাজা বলে অভিহিত করা হয়।স্কটল্যান্ডের দুঃখের দিনের অবসান হলো।
অবশেষে আমরা বলতে পারি, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। অর্থাৎ ম্যাকবেথের স্ত্রী লেডী ম্যাকবেথের প্রয়োচনায় ম্যাকবেথের মনে লোভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে এর ফলে একটার পর একটা পাপ করতেই থাকে। আর এই পাপের কারনেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
ছবিঃ সংগৃহীত