নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচেবে রচিত থিংস ফল অ্যাাপার্ট -কে ধরা হয় আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে। মূলত এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই আফ্রিকান সাহিত্যের সূচনা হয়। আচেবের এই উপন্যাসটি তাঁর নিজের প্রকাশিত প্রথম সাহিত্যকর্ম। আচেবের এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আফ্রিকান উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্যের সুত্রপাত হয়।
লেখক পরিচিতি
চিনুয়া আচেবে (জন্ম: নভেম্বর ১৬, ১৯৩০ – মৃত্যু: মার্চ ২১, ২০১৩) নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তাঁকে আফ্রিকার “আধুনিক সাহিত্যের জনক”ও বলা হয় । তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ই নভেম্বর। ১৯৯০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন চিনুয়া আচেবে। তাঁর পরবর্তী বছরগুলো বেশিরভাগই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ এর সুবাদে বিশ্বজুড়ে খ্যাতিলাভ করেন আচেবে। তাঁর অনান্য বিখ্যাত গ্রন্থ হল নো লংগার এট ইজ, দি ম্যান অফ পিপল। ২০১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পটভূমি
উপন্যাসের সময়কাল উনিশ শতকের শেষের দিকের নাইজেরিয়া। নাইজেরিয়া নামে পরিচিত দেশটি তখন বিভিন্ন রাজ্য এবং গোত্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে উত্তর নাইজেরিয়াতে গড়ে উঠেছে বিশাল সোকোতো খিলাফত, কিন্ত দক্ষিন নাইজেরিয়া অঞ্চলে বসতি ছিল বিভিন্ন প্যাগান বা প্রকৃতিপূজারী জাতিগোষ্ঠীর। এই গোষ্ঠীগুলোর মাঝে অন্যতম বৃহৎ ছিল ইবো গোষ্ঠী।
ইবো সমাজ ছিল অনেকটাই গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত জ্যেষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা শাসিত। আর এই শাসক অভিজাততন্ত্রে প্রবেশের ব্যাপারটি ছিল সম্পুর্ন মেধাভিত্তিক। যে কোন ইবো পুরুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজে উঁচু স্থান অর্জন করে অভিজাত সমাজে স্থান পেত। তাদের কোন নিজস্ব রাজ্য ছিল না, ছোট ছোট গোত্র নিজস্ব অঞ্চলভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
যুদ্ধ, শান্তির মত বিষয়গুলো অভিজাত সমাজের সকলের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হত। পাশাপাশি, দৈব বক্তারাও ধর্মীয় গুরু হিসেবে ইবো সমাজে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখত। ইবো সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সমাজে নারী স্বাধীনতা অন্য আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর চেয়ে তুলনামূলক বেশি ছিল।
ছবিঃ থিংস ফল অ্যাাপার্ট উপন্যাসের পেঙ্গুইন সংস্করনের প্রচ্ছদ
কাহীনি সংক্ষেপ
থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসটির কাহীনি মূলত তিনভাগে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে আমরা দেখি উপন্যাসের নায়ক ওবি ওকোনকোর পিতা উনোকা একজন অলস ব্যক্তি হলেও ওকোনকো নিজ পরিশ্রমের গুনে সমাজে উঁচু স্থান লাভ করে। ওকোনকো একজন সফল কৃষক, একজন যোদ্ধা, একজন কুস্তিগীর এবং সর্বোপরি উমোফোয়া গোত্রের ইবো অভিজাত সমাজের একজন সদস্য।
ওকোনকো তাঁর পিতা উনোকাকে ঘৃনা করত কারন সে ছিল দুর্বল, অলস; একই কারনে নিজপুত্র নোয়েকে সে অপছন্দ করে। প্রতিবেশি এক গোত্রের সাথে বিবাদের সুত্র ধরে ইকেমুফুনা নামে একটি বালককে উমোফোয়া গোত্র পণবন্দী হিসেবে নিয়ে আসে।
ছেলেটির ঠাই হয় ওকোনকোর বাড়িতে। নোয়ে আর ইকেমুফুনার মাঝে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে , ওকোনকোও ছেলেটিকে স্নেহ করত। কিন্ত এক পর্যায়ে ইবো গোষ্ঠীর অন্যতম অভিজাত ইজেডু ওকোনকোকে জানায় যে ইবো দৈব বক্তা ইকেমুফুনাকে হত্যার আদেশ দিয়েছে। নিজেকে শক্ত প্রমানের জন্য ওকোনকো ছেলেটিকে নিজের হাতে হত্যা করে কিন্ত এর মাধ্যমে সে নিজ সন্তান নোয়ের ঘৃনার লক্ষ্যে পরিণত হয়।
ইজেডু কিছুদিন পর স্বাভাবিকভাবে মারা গেলে তার শেষকৃত্যে ওকোনকোর অসাবধানতাবশত ছোঁড়া একটি গুলিতে ইজেডুর পুত্র নিহত হয়। অনিচ্ছাকৃত এই হত্যার জন্য ওকোনকোকে সাত বছরের নির্বাসন দেয়া হয় যে সময়টা সে সপরিবারে মাতুলালয়ে অতিবাহিত করে।
দ্বিতীয় খন্ডে আমরা দেখি ওকোনকোর বন্ধু ওবিরিকা তার সকল খামার দেখাশোনা করছে এবং তার নিয়মিত খোঁজখবর রাখছে। ওবিরিকার কাছ থেকে ওকোনকো জানতে পারে যে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরা তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে এবং শ্বেতাঙ্গ মিশনারিরা তাদের ধর্মকে বিদ্রুপ করে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করছে।
আরও পড়ুনঃ
সাহিত্যে উত্তর-উপনিবেশীকতা: সাহিত্যের নতুন ধারার আন্দোলন
তৃতীয় খন্ডটি হল উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স । এই খন্ডের শুরুতে ওকোনকো তার নির্বাসন শেষে নিজ গ্রামে ফিরে আসে। মিশনারিদের তৎপরতা তখন তুঙ্গে। এমনকি ওকোনকোর পুত্র নোয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহন করে। একপর্যায়ে ইবোদের পবিত্র প্রানী হিসেবে পরিচিত একটি সাপকে এক নবদিক্ষীত খ্রিস্টান হত্যা করে এবং আরেক নবদিক্ষীত খ্রিস্টান গোত্রের অনুষ্ঠান চলাকালে একজন জ্যেষ্ঠ অভিজাতের মুখ থেকে পবিত্র মুখোশ খুলে ফেলে। ফলে ইবোরা চরম অপমান বোধ করে। ওকোনকোর নেতৃত্বে ইবোরা গ্রামের গির্জাটি পুড়িয়ে দেয়।
ওকোনকো এবং অনান্য অভিজাতদের ব্রিটিশ প্রশাসক আলোচনার জন্য ডাকে কিন্ত তারা আলোচনা করতে গেলে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা করে বন্দী করা হয়। বন্দী অবস্থায় তাদের প্রহারও করা হয়। ফলে ওকোনকো এবং অন্য অভিজাতরা গ্রামে এসে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারে আলোচনা করতে থাকে । এই সময় ব্রিটিশরা তাদের সতর্ক করার জন্য দুত পাঠালে ওকোনকো সেই দুতকে হত্যা করে। কিন্ত ইবোরা তার এই কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে। পাশাপাশি, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারেও ইবো নেতারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হতাশায় এবং ইবোদের সিদ্ধান্তহীনতায় ক্রদ্ধ ওকোনকো শেষে আত্মহত্যা করে।
বিশ্বসাহিত্যে থিংস ফল অ্যাাপার্টের স্থান
আফ্রিকার প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসবে থিংস ফল অ্যাাপার্ট সবসময় গুরুত্ব পাবে। সেইসাথে এটি উপনিবেশবাদবিরোধী এক ক্লাসিক রচনা হিসেবে স্বীকৃত। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন থিংস ফল অ্যাাপার্ট উপন্যাসটিকে ইংরেজি ভাষায় লেখা ১০০ টি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের অন্যতম হিসেবে অভিহিত করেছে। ইতোপূর্বে পশ্চিমা লেখকরা যেমন জোসেফ কনরাড তাঁদের সাহিত্যকর্মে আফ্রিকাকে এক সংস্কৃতিহীন পশ্চাদপদ জনপদ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। কিন্ত আচেবেই প্রথম পশ্চিমের এই ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি দেখান যে শ্বেতাঙ্গদের আগমনের বহু আগে থেকেই আফ্রিকার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। পশ্চিমের সাথে আফ্রিকান সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্ত সেটা কখনোই আফ্রিকাকে পশ্চাদপদ করে তোলে না।
তথ্যসুত্রঃ
১। Things Fall Apart, Chinua Achebe, Heinemann Edition:1996
২। The Empire Writes Back, Bill Ashcroft, Routledge:2002