প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনমুগ্ধকর স্থাপনা নিয়ে যুগ থেকে যুগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত “লুক্সেমবার্গ”। বিশ্বের ধনী ৫ টি দেশের তালিকায় এর নাম। অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার সাথে নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ফলে এদেশে অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ লুক্সেমবার্গ সম্পর্কে তবে জানা যাক।
লুক্সেমবার্গ এর সরকারি নাম গ্রান্ড ডাচি অব লাক্সেমর্বাগ (Grand Duchy of Luxembourg). এদেশের নাগরিকদের বলা হয় লুক্সেমবার্গীস বা লুক্সেমবার্গার। এদেশের নীতিবাক্য হল- “We want to remain what we are!“. এদেশের আইনসভার নাম “chamber of Deputies.”
অবস্থান ও ইতিহাস:
লুক্সেমবার্গ পশ্চিম ইউরোপের একটি স্থলবেষ্ঠিত দেশ।যার উত্তর ও পশ্চিমে বেলজিয়াম, পূর্বে জার্মানি ও দক্ষিণে ফান্স অবস্থিত। আয়তনে এ দেশটি অনেক ছোট। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেনেলুক্স এর অন্তভূক্ত। এছাড়াও এটি শেনঝেন চুক্তিতে সাক্ষরকারী একটি দেশ। শেনঝেন ভিসার মাধ্যমে দেশটিতে শেনঝন চুক্তিতে সাক্ষরকারী দেশের যেকোন নাগরিক অনায়াসে যাওয়া আসা করতে পারে। জিডিপির ক্রমে বিশ্বের সবচেয়ে ধনি দেশ এখন “লুক্সেমবার্গ“।
বিগত কয়েক দশক ধরে নাগরিক জীবনের সমৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি দক্ষ দেশ পরিচালনায় লাক্সেমবার্গের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিলো উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই ছোট দেশটি।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিয়াষু পর্যাটকরা ছুটে আসে এই দেশে এর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে।
দেশটির লিপিবদ্ধ ইতিহাস যদিও রোমান সভ্যতাকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু এর আসল ইতিহাস শুরু হয়েছিল ৯৬৩ খ্রীস্টাব্দে। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দী ধরে শক্তিশালী হাউস অব লাক্সেমবার্গের উত্থান ঘটে। কিন্ত যখন এটি বিলুপ্ত হয় তখন দেশটির স্বাধীনতারও অবসান ঘটায়।
১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে দেশটি হাফসিবুর্গ সামরাজ্যের অধীনে চলে যায়।পরর্বতীতে সুদীর্ঘ আশি বছরের যুদ্ধের পর দেশটি দক্ষিণ নেদারল্যান্ডস এর একটি অংশ হিসেব আবির্ভূত হয়।এরপর ১৮৬৭ সালে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।১৯১৪-১৯১৮ এবং ১৯৪০-১৯৪৪ পর্যন্ত দেশটি জার্মানদের অধীনে ছিলো।
আয়তন ও জনসংখ্যাঃ
২৫৮৬.৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে মোট জনসংখ্যা ৬ লাক্ষ ১৩ হাজার। আয়তনে এটি বিশ্বের ২৮ তম ক্ষুদ্র দেশ। এদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক স্থানীয় । বাকি অর্ধেক মানুষ অভিবাসী যার মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশটির অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে।
ভাষাঃ এ দেশের সরকারি ভাষা তিনটি- লাক্সেমবর্গিস, ফ্রেন্স, জার্মানি।
তবে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ লাক্সেমবর্গিস ভাষায় ই কথা বলেন। ইংরেজি এদেশের চতুর্থতম ভাষা। এদেশের বিদ্যালয়ে এ চারটি ভাষাই শেখানো হয়।তবে এখানে পর্তুগিজ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় পর্তুগিজ ভাষায় ও অনেক মানুষ কথা বলে।
ধর্মীয় অবস্থা:
দেশটির বেশির ভাগ মানুষ খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী। দেশটির ৭৩% মানুষ খ্রীষ্টান। বাকি ২৩% মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। ৩ % মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং ১% মানুষ বৌদ্ধধর্মবলম্বী।
লাক্সেমবার্গের রাজধানীর নাম লাক্সেমবার্গ সিটি। এটি দেশটির সবচেয়ে জনবহুল শহর। এটি দক্ষিণ লাক্সেমবার্গের আল-জেরিস ও পাত্রিস নদীর তীরে অবস্থিত। যেটি পুরা ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু।
লুক্সেমবার্গ সিটি ইউরোপ এর অন্যান্য শহরের মতোই ছবির মতো সুন্দর ও সাজানো গুছানো। এ শহর পুরানো ও নতুন স্থপত্যে মিলেমিশে এক হয়ে আছে।
লাক্সেমবার্গ কাসেল, এ শহরে অবস্থিত, যা মধ্যযুগের প্রথমদিকে ফ্রাঙ্কদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে এটির চারপাশে এখন বসতি গড়ে উঠেছে। এটি একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম একটি রাজধানী শহর। এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি সদর দপ্তর অবস্থিত।
লাক্সেমবার্গে একটি মধ্য মহাদেশীয় জলবায়ু বিদ্যমান।সাথে শীতকাল ও গ্রীষ্মকালে হালকা গরম অনুভুত হয়।শীতকালে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর গ্রীষ্মকালের গড় তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিনামূল্যে গণপরিবহন সেবা:
ইউরোপ এর বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ লাক্সেমবার্গ ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে গণপরিবহন সেবা নিশ্চিত করেছে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার নজির থাকলেও পুরা দেশব্যাপী এমন গণপরিবহন সেবা দেওয়ার উদাহরণ বিশ্বে এই প্রথম।
ট্যাক্স এর রাজধানী:
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বল্প হারের কর্পরেট ট্যাক্স, সুবিধাজনক ব্যবসায়ীক পরিবেশ এবং দক্ষ জনগোষ্ঠীদেশটির অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির মূল চাবিকাঠি। দেশটিতে আছে ১৫০ টির বেশি ব্যাংকিং সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অধিকাংশই হলো বিদেশী মাকিকানাধীন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবসা করতে হলে অনেক বেশি ট্যাক্স গুনতে হয় কিন্তু লাক্সেমবার্গে তার বিপরীত। এখানে ট্যাক্স দিতে হয় না।তাই একে ট্যাক্স এর রাজধানী ও বলা হয়।
বিশ্বের সব জনপ্রিয়খাবারের দেশ:
লুক্সেমবার্গের খাওয়া দাওয়াকে কেন্দ্র করেই মূলত এদেশের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । এবং এই পুরা দেশের সংস্কৃতির কেন্দ্র আবার এর রাজধানী। এখানে রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক মিশেলিন রেস্তোঁরা।
এখানের স্থানীয় খাবার পর্যটকদের ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ায়। খাবারের তালিকায় রয়েছে: জূড ম্যাট গার্ডিবাউনেন (দেশটির জাতীয় খাবার, যা শুয়োরের মাংস এবং বড় বড় মটরশুটি দিয়ে রান্না করা হয়), কুইটসেন্টার্ট (ডুমুরের পিঠা), গ্রোম্পেরেকিচেলচার (ক্রিস্পি আলুর ফ্রাই), রিলেসিংসপ্যাচটিট (মাংস এবং ওয়াইন পাই) এবং কাচ্চিস ( নরম পনির) হল লুক্সেমবার্গের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের নাম।
ভাস্কর্য ও স্থাপনা:
চিত্রঃ অ্যাডলফ সেতু , লুক্সেমবার্গ
লুক্সেমবার্গ শহরে অবস্থিত অ্যাডলফ সেতু পর্যাটকদের মূল আকর্ষন। ১৯০০ থেকে ১৯০৩ সালে এই সেতু নির্মাণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার ওয়াল নাট হেলেন সেতুর সংকলনে এটি তৈরি করা হয়। লাক্সেমবার্গের ভাষায় ‘যে লেফ্রা’ নামে গোল্ডেন লেডি। দেশটিতে প্রায় ২১ মিটার স্মৃতি স্তম্ভের উপর এর রয়েছে সোনায় তৈরি গোল্ডেন লেডি ভাস্কর্যটি।
পৃথিবী খ্যাত এক ক্যাথেড্রাল এখানে রয়েছে । এর নাম “নটর ডেম”চার্চ। এর স্থাপত্যধারা কারণে এটি একটি আকর্ষণীয় ল্যান্ডমার্ক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছ। এর ভিত্তি প্রস্তর ১৬১৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিল এবং পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে এর নির্মাণ কাজ চলে। তবে এর নির্মাণ কাজ ১৯৩৮ সালের শেষ পর্যন্ত চলে। তাই এটিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নের স্মারকও বলা হয়।
চিত্রঃ নটর ডেম চার্চ , লুক্সেমবার্গ
প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যের আধাঁর:
লুক্সেমবার্গ সিটি হলো ছবির মতো সুন্দর। যেন সুনিপুণ শিপ্লীর আঁকা কোনো বাস্তব, জীবন্ত ছবি। মধ্যযুগে নির্মিত শহরের কেন্দ্রটি ছোট, পুরনো বিল্ডিং এবং এর মধ্যযুগীয় অতীতের অবশিষ্টাংশে পরিপূর্ণ।
শহরের মাঝামাঝিতে রয়েছে সবুজ রঙে ঘেরা উপত্যকা এবং একেবেকে বয়ে চলা নদী।শহরের অন্যান্য অংশ, যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান, কিচবার্গে রয়েছে কাঁচঘেরা আকাশচুম্বী সব বড় বড় দালানকোঠা, ব্যাংক ও বহুজাতিক সংস্থার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য।
রাজধানী লুক্সেমবার্গ সিটি দেশটির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু এবং সেখানে অনেকগুলি যাদুঘর, আর্ট গ্যালারী, বার এবং বিশ্বসেরা রেস্তোঁরা রয়েছে।এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশে পর্যাটকদের কাছে খুবই আকর্ষনীয়।তাই তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে।
পাওয়ার হাউস অফ ইউরোপ:
লুক্সেমবার্গ নামক ছোট দেশটি ব্রাসেলস এবং স্ট্র্যাসবার্গের সাথে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রু পাওয়ার সেন্টার হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব অডিটরস, দ্য সেক্রেটারিয়েট অব দ্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড এই দেশে অবস্থিত। তাই একে পাওয়ার হাউস অফ ইউরোপ বলা হয়।
প্রসাদ ও দুর্গের দেশ:
দেশটিতে প্রায় বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় ১০০টির বেশি দুর্গ ও প্রাসাদ রয়েছে। তাই লাক্সেমবার্গকে দুর্গ বা প্রাসাদ এর রাষ্ট্র দেশও বলা হয়। ৯৬৩ সালের দিকে লুক্সেমবার্গে সর্বপ্রথম দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। দেশটির বৃহত্তম তিনটি দুর্গ হলো- বোর্সচেডে, ভায়েনডেন এবং ক্লারভাক্স।এছাড়াও এখানে আছে ভূ-গর্ভস্থ টানেল যা প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহৃত হত।
প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের তুললায় এখানে ফুয়েল ও জ্বালানির মূল্য অনেক কম। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে অনেক ফুয়েল টুরিস্ট আসেন এখানে ফুয়েল কিনতে।
লুক্সেমবার্গের প্রায় ৯৯% শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। এখানে ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রতিটি ছেলে-মেয়ের শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
লাক্সেমবার্গের অর্থনীতি অনেকটা ব্যাংকিং সেবা,ইস্পাস এবং শিল্পখাতের উপর নির্ভরশীল। এখানকার ব্যাংকিং সেবা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সেরা।ইউরোপ এর অন্যান্য দেশগুলোর মতো এখানেও খেলাধুলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আরও পড়ুনঃ
স্বপ্নের ভূবণ গ্রীনল্যান্ড এর আত্ম পরিচিতি
সাজেক ভ্যালি: লাল পাহাড়ের দেশে প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য
প্রযুক্তি ও আর্থিক সেবা শিল্পকে আর ও বৈচিত্র্যময় করার জন্য দেশটি প্রতিনিয়ত নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে এই দেশ বিশ্বের এক নাম্বার। লাক্সেমবার্গের সরকারী মুদ্রা হলো “ইউরো”। এক ইউরো সমান বাংলাদেশী ৯৪ টাকা ও ভারতীয় ৭৯ রুপী। দেশটির জিডিপি মোট $৬৯. ৪৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু আয় $ ১,১৩,১৯৬ মার্কিন ডলার। এই দেশের ডায়েলিং কোড +৩৫২।
আপনি ঘুরে আসতে পারেন এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর লীলাভূমি ও বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র লুক্সেমবার্গে।এদেশ তাদের এই ক্রমধারা অবহত রাখতে বদ্ধ পরিকর। নাগরিকদের আর ও কি কি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা যায় তা দিয়ে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করছে।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া