আমরা অনেকেই মনে করি তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এটি মোটেই ঠিক নয়। বিভিন্ন রকমের তেলে রয়েছে বিভিন্ন রকম পুষ্টিগুণ। রান্নায় ও রূপচর্চায় পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বিভিন্ন তেলের পরিমাণ মতো ব্যবহার আমাদের দিতে পারে সুস্থ ও সুন্দর জীবন। বাজারে এখন নানা রকমের তেল পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে অলিভ অয়েল, রাইস ব্রান অয়েল, সানফ্লাওয়ার সীড অয়েল, আমন্ড অয়েল এবং সয়াবিন, সরিষা তো আছেই। এতো তেলের মাঝে কোনটা কোন রান্নার জন্য উপযুক্ত, কোনটা রূপচর্চায় ভালো আর কোনটা স্বাস্থ্যের জন্য সর্বোচ্চ উপকারি তা জানা দরকার।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল এখন আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। রান্নায় এবং ত্বকের যত্নে এই তেলের জুড়ি মেলা ভার। গবেষণা থেকে জানা যায়, এই তেল ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমায় ও উপকারী কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি লিভার পরিষ্কার করে। যারা কোষ্টকাঠিন্য রোগে ভুগছেন এই তেলের ব্যবহার তাদের উপকার করে। এটি ত্বকের বলিরেখা প্রতিরোধ করে, বয়সের ছাপ কমায়। অনেকের মতে এই তেলে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার প্রতিরোধ হয় এবং ব্যাথানাশক হিসেবেও কাজ করে।
শীতকাল ত্বকে জলপাই তেল ব্যবহারের জন্য সবথেকে ভালো সময়। স্নানের পর এই তৈল মালিশ করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে। মেকআপ রিমুভার হিসেবেও এই তেল খুব ভালো কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের রান্নাতেও এখন এই তেলের ব্যবহার করা হয়। রান্না্র জন্য সাধারনত ভার্জিন অলিভ অয়েল ভালো। এই তেলের গুণাগুণ বেশি তাপে নষ্ট হয়ে যায়। তাই অল্প আঁচের রান্নায় এবং স্যালাড তৈ্রিতে এটি খুব ভালো কাজ করে।
সূর্যমুখী ফুলের বীজ যন্ত্রে মাড়াই করে তৈ্রি হয় এই তেল। এই তেলে কোলেস্টরলের মাত্রা খুব কম। তাই হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি এবং ই। এইসব ভিটামিনের উপস্থিতির কারনেই এটি আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য ভালো। এটি দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করে। এছাড়া বলা হয়ে থাকে যে, আমাদের রান্নায় ব্যবহৃত সাধারণ সয়াবিন তেলের তুলনায় এটি প্রায় ১০ গুন অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। এটি প্রায় সবরকম রান্নার জন্য উপযুক্ত। তাই মানুষের কাছে এই তেলের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে উঠছে।
বর্তমানে বাজারে প্রায়ই দেখা যায় নতুন এই তেল। রাইস ব্রান অয়েল তৈরি হয় ধানের তুষ থেকে বা ব্রাউন রাইসের ওপরের অংশ থেকে। এটি বেশ গাঢ় রঙের হয়। রান্নায়ও এই তেল আলাদা স্বাদ যোগ করে।
এই তেলে ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কম, রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ই, যা বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। রান্নায় এর ব্যবহার ত্বক ও চুলের জন্য ভালো। এই তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশি, তাই উচ্চ তাপের রান্নায় এই তৈল খুব ভালো। আবার স্যালাড তৈরিতেও এটি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যায়।
কিছু বছর আগেও আমাদের দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেলই মূলত ব্যবহার হতো। এখন বিশেষ কিছু রান্না ছাড়া এই তেলের ব্যবহার তেমন চোখেই পড়ে না। তবে গুণাগুণের দিক থেকে এই তেল অনন্য। এতে রয়েছে ফ্যাটি এসিড ওমেগা আলফা৩, ওমেগা আলফা৬ ও ভিটামিন ই, যা এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে এটি হৃদরোগের মাত্রাও কমায়। সরিষার তেলের গন্ধ শ্বাসযন্ত্রের কফ অপসারনেও কাজ করে। এটি পরিপাক ও রেচনতন্তের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
শুধু খাওয়ার জন্যই নয় এই তেল ত্বক ও চুলের জন্যেও ভালো। খুব ঘন হওয়ায় এটি প্রাকৃতিক সানস্ক্রিনও হিসেবে কাজ করে। এটি ত্বকের তামাটে ভাব দূর করে। স্কিন ক্যান্সার সহ বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। অকালে চুল পাকা ও চুল পড়া রোধ করে। চুলের বৃদ্ধিতেও ভালো কাজ করে। তবে ত্বকের ধরন বুঝে সব ধরনের তেল ব্যবহার করা ভালো।
অনেকে জানেন নারকেল তেল শুধু ত্বক ও চুলের যত্নেই ব্যবহার করা যায়, তবে কথাটি ঠিক নয়। পরিমিত ব্যবহারে এই তেলও আপনার খাবারে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় নারকেল তেল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। এতে রয়েছে ভিটামিন ই, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, বিভিন্ন মৌসুমী রোগব্যধী এবং ফাংগাল ইনফেকশানের হাত থেকেও আমাদের রক্ষা করে।
নারকেল তেল ত্বক ও চুলকে মসৃন করতেও খুবই কার্যকর। ছোটখাটো পোড়া স্থানে এই তেল লাগালে আরাম পাওয়া যায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের হাড় বা পেশীতে ব্যাথা হলে এই তেল মালিশ করা হয়। ভারতের দক্ষিন অঞ্চলে রান্নায় এই তেলের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
তিলের তেল রান্না এবং রূপচর্চা উভয় ক্ষেত্রেই বেশ ব্যবহৃত হয়। ভোজ্যতেল হিসেবে এটি খুব উপকারি কারণ এতে রয়েছে- ভিটামিন ই, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন ডি। এছাড়াও রয়েছে কপার, জিংক, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস।
রান্নায় এই তেলের ব্যবহার ব্লাড প্রেশার কমায়, আর্থ্রাইটিসের ব্যাথা কমায়। পাশাপাশি এটি ডায়বেটিস রোগীদের জন্য ভালো। রূপের চর্চায় যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই তেল। এই তেলে রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল প্রোপার্টিজ যা ত্বকের ফাংগাল ইনফেকশন রোধ করে, ত্বককে আরো উজ্জ্বল করে এবং উত্তম স্কিন ময়েশ্চারাইজার। এছাড়া সমুদ্র সৈ্কতে যাওয়ার ফলে হওয়া সানবার্ন, সুইমিংপুলের পানির জন্য হওয়া ক্লোরিন বার্ন থেকে বাঁচতেও ব্যবহার করতে পারেন তিলের তৈল।
চুলের জন্যেও এটি যথেষ্ট ভালো। চুলের অকাল পক্বতা রোধ করতে পারে এটি। তবে ঘনত্ব বেশি হওয়ায় অন্য তেলের সাথে মিশিয়ে এটিকে পুরো চুলে ব্যবহার করা হয়।
শরীর ও ত্বক উভয়ের জন্যই বাদাম থেকে উৎপন্ন তেল খুব ভালো। রান্নায় এই তেলের ব্যবহার খাবারে অতিরিক্ত শক্তি যোগ করা যায়। এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, রিবোফ্লাবিন, ফসফরাস ও কপার।
বাদাম তেলের মধ্যে কাঠবাদামের তেল সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ই, যা ত্বককে সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে। এই তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে মাংসপেশি মজবুত হয়। এটি চুলের জন্যেও খুব ভালো। এর ভিটামিন এ, ডি, ই, বি১, বি২, বি৬ চুলকে শক্ত, মসৃন ও সুন্দর করে। মেকাপ তোলার জন্যেও এই তেল ব্যবহার করা ভালো।
দেহের প্রয়োজনীয় স্নেহ পদার্থের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উৎস রান্নায় ব্যবহৃত তেল। দেহে স্নেহ উপাদানের ঘাটতি হলে মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়, নানারকম চর্মরোগও হতে পারে। তাই পুষ্টিগুণ বিবেচনায় রেখে রান্নায় ও রূপচর্চায় পরিমিত পরিমানে তেলের ব্যবহার করতে হবে। তবেই যে কোনো ঋতুতে আমরা থাকব সুস্থ, সতেজ ও সুন্দর।
মন্তব্য লিখুন