পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিজগতের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা বিস্ময় যা আমাদের মু্গ্ধ করে প্রতিনিয়ত। তার মধ্যে পিঁপড়া এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি ।
অতিক্ষুদ্র এ প্রাণীটির সাথে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত থাকলেও এর গঠন ও জীবনপদ্ধতি, এতটাই চমকপ্রদ যা আমরা অনেকেই জানিনা।
এমনকি এই প্রাণীটির থেকে আমাদের মানুষেরও অনেক কিছু শেখার আছে যা কাজে লাগিয়ে আমরা অনেক উপকৃত হতে পারি। তাইতো সেসব চমৎকার বিষয়গুলো জানতেই আজকের এই আয়োজন।
পিঁপড়া
পিঁপড়া hymenoptera পর্বের Formicidae গোত্রের একটি পোকা বা কীট । বিশ্বে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে । মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সমস্ত পিঁপড়ার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান !! অতিক্ষুদ্র এ প্রাণীটি সেই ডাইনোসরের সময় থেকে এখন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে টিকে রয়েছে ।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, হযরত আদম (আঃ) এর জন্মেরও কয়েক কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীতে পিঁপড়া ছিলো। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় এই পিঁপড়া সম্পর্কে জানা যাচ্ছে অবাক করা নানা তথ্য।
পিঁপড়ার অনন্যসাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য
- সমস্ত পোকামাকড়ের মধ্যে পিঁপড়া সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী।
- পিঁপড়ার কোন কান নেই। এর হাটুঁ ও পায়ে অবস্থিত বিশেষ ধরণের সেন্সিং ভাইব্রেশনের সাহায্যে এরা শুনতে পারে।
- এদের ২ টি পাকস্থলী রয়েছে । যার একটিতে নিজের জন্য ও অপরটিতে অন্যের জন্য খাদ্য জমা করে রাখে।
- পিঁপড়ার কোন ফুসফুস নেই। এদের দেহে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে যার সাহায্যে বাতাস এদের ভেতরে-বাইরে চলাচল করে।
- এদের ৬ টি পা রয়েছে যার সাহায্যে এরা চলাফেরা করে ।
- পিঁপড়াদের শুঁড় খুব সংবেদনশীল। এই শুঁড় বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় তাপমাত্রার হ্রাস অনুধাবন করতে এবং সেজন্য যথাযথ পতিক্রিয়া দেখাতে সাহায্য করে ।
- পিঁপড়া তাদের দেহের চেয়ে ২০ গুণ ওজন বহন করতে সক্ষম।
- এদের দৈহিক গঠন এমন যে একটি পিঁপড়াকে যদি উড়োজাহাজ থেকে ফেলে দেয়া হয় তাও একটুও ব্যাথা পাবে না।
পিঁপড়ার সামাজিক বৈশিষ্ট্য
পিঁপড়া সামাজিক জীব। এরা কলোনী আকারে একতাবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে।তাদের দেহ থেকে ফেরোমন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয় যার সাহায্যে তারা পারস্পরিক যোগাযোগ করে।
এছাড়া কিছু প্রজাতি নিয়ার ফিল্ড নামক শব্দ তৈরি করতে পারে তার মাধ্যমেও যোগাযোগ করে। এতে একটি পিঁপড়া একসাথে অনেককে নির্দেশ দিতে পারে।
একটি কারখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যেমন পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক, শ্রমিক থাকে তেমনি পিঁপড়াদের মধ্যেও রয়েছে উন্নতমানের শ্রম বিভক্তি।
আরও পড়ুনঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল -পৃথিবীতে ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে নাকি পুরোটাই মিথ
পিঁপড়াদের একটি কলোনীতে সাধারণত এক বা একাধিক রাণী, কয়েকটি পুরুষ এবং অসংখ্য স্ত্রী শ্রমিক পিঁপড়া থাকে। পুরুষ পিঁপড়াদের কাজ শুধু রাণীর সাথে মাধ্যমেও দৈহিক মিলনে অংশ নিয়ে প্রজননে অংশ নেয়া।
নতুন শাবক জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই পুরুষ পিঁপড়াটি মারা যায়। বাসা নির্মাণ,খাদ্য সংগ্রহ,নতুন শাবকদের লালন-পালন এসব কাজ স্ত্রী শ্রমিক পিঁপড়াই করে থাকে।
যে পিঁপড়ার বড় মাথা বা ম্যান্ডিবল থাকে তাকে বলা হয় সেনা পিঁপড়া । এরা শত্রুর আক্রমণ থেকে কলোনীর পিঁপড়াদের রক্ষা করে। প্রত্যেকের নিজ নিজ কাজ সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে পিঁপড়া প্রাণিজগতে অনন্য স্থান দখল করে আছে।
আমাদের জন্য শিক্ষা
পিঁপড়া খুব ক্ষুদ্র একটি জীব হলেও এর জীবনপদ্ধতি, কর্মকৌশল ও বুদ্ধিদীপ্ত পথচলায় আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় দিক। পিঁপড়ার জীবন থেকে আমরা সুশৃঙ্খল ও একতাবদ্ধ জীবনযাপনের শিক্ষা পাই।
পিঁপড়াদের কেউ কোন বিপদের আভাস পেলে তা মুহূর্তেই আশেপাশের পিঁপড়াদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সতর্ক করে। এছাড়া তারা পরস্পর খাদ্য আদান-প্রদান করে একে অপরকে সাহায্য করে।
এর থেকে আমরা সমস্ত আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা পরিহার করে পরস্পর সাহায্যকারী ও উপকারী বন্ধু হিসেবে বসবাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
পিঁপড়া শীতকালে খাদ্য মজুদ করে রাখে। তা থেকে মুকুল বের হলে পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তারা মুকুল কেটে ফেলে। আবার বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তা শুকাতে দেয়।
সামান্য একটি প্রাণীর এমন কর্মকৌশল আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুর্দিনের জন্য পাথেয় সংগ্রহের শিক্ষা দেয়। পিঁপড়া সবসময় সারিবদ্ধভাবে চলাচল করে। কোন বিপদ সংকেত পেলে তাদের অল্প সংঘর্ষে দ্রুত গৃহে প্রবেশ উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থার ধারণা দেয়।
অলসতা পরিহার করে পিপড়াদের পরিশ্রম, কর্মোদ্দীপনা ও যথাযথ পন্থায় কর্ম সম্পাদনের নীতি গ্রহণ করে আমরা সাফল্যের শিখরে আরোহন করতে পারি। তাইতো বলা যায়, পিঁপড়া ক্ষুদ্র হলেও তুচছ নয়, সামান্য জীব হলেও মূল্যহীন নয়।