শ্বেতশুভ্র মেঘপুরীর রাজ্যকে স্বচক্ষে ভ্রমণ করতে অনেকেই দার্জিলিং, শিলং বা অন্য কোন দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু অপরুপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি আমাদের এই দেশেই যে মেঘদূতের বসবাস তা অনেকেরই অজানা। বলছি পাহাড়কন্যা, মেঘদূত আর সবুজের এক মিলনমেলা সাজেক ভ্যালি এর কথা।
লাল রঙের মাটির অন্ঞ্চল অর্থাৎ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক নামক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়নে (আয়তন ৭০২ বর্গমাইল) অবস্থিত এ স্বপ্নপুরী। শহুরে পরিবেশের বিষাক্ত ধোয়া, ইটের দেয়ালে বন্দী জীবনের একঘেয়েমিতা থেকে কিছুসময়ের জন্য নিস্তার পেতে উঁকি মেরে আসতেই পারেন সাজেক ভ্যালি থেকে।
সেখানে গেলে আধমরা মনটাও সহসাই চাঙা হয়ে উঠবে বিশুদ্ধ পরিবেশের খনি ও মেঘপুরীর দেখা পেয়ে। তো চলুন জেনে নেয়া যাক প্রকৃতির এ স্বর্গরাজ্য সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
সাজেক ভ্যালি রাঙামাটির সর্বউত্তরের মিজোরাম-ত্রিপুরা সীমান্তে। পার্শ্ববর্তী জেলা খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক ৭০ কিলোমিটার, দীঘিনালা হতে ৪৯ কিলোমিটার , বাঘাইহাট থেকে ৩৪ কিলোমিটার অথচ ভারতের মিজোরাম হতে মাত্র ৮ কিলোমিটার (মতান্তরে ১৫ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত। ভারত সীমান্তের কতটা কাছে এর অবস্থান তা সহজেই অনুমেয়।
অপরদিকে ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৩১ কিলোমিটার।এর পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য,পশ্চিমে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা,উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য এবং দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদুর অবস্থান। এখানেই দেখতে পারবেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং উঁচুতে অবস্থিত বিজিবি ক্যাম্প।
সাজেকে রয়েছে তিনটি পাড়া: রুনলুইপাড়া, হামারিপাড়া এবং কংলাক পাড়া। প্রতিটা পাড়া একেকটা গ্রাম। সাজেকে পৌঁছালে প্রথমেই রুইলুই পাড়া চোখে পড়বে যেটা ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৭২০ ফুট এবং কংলাক পাহাড়ে অবস্থিত কংলাক পাড়া ১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে।
‘সাজেক’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও বেশিরভাগের মতে কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকেই “সাজেক ভ্যালি” নামটির প্রচলন। একে “রাঙামাটির ছাদ” বলেও অভিহিত করা হয়। এর কারণ হলো সাজেক ভ্যালি থেকে রাঙামাটির অনেকটা অংশ দৃষ্টিগোচর হয়।
সাজেকের অধিবাসীদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। প্রধানত লুসাই ছাড়াও ত্রিপুরা ও পাংখোয়াদেরও আবাসভূমি এ সাজেক। টিনের চালা এবং বাঁশের বেড়া কিংবা মাচানের ওপর সাধারণত তারা ঘর তৈরী করে। রুনলুই পাড়াতে গেলে বাংলাদেশের পতাকার লাল সবুজ রঙটাই আপনার দৃষ্টিগোচর হবে ও মানসপটে ফুটে উঠবে।
কারণ এ পাড়ার জনগোষ্ঠীদের ঘরগুলোর চালা হয় সবুজ রঙের এবং বেড়া লাল রঙের। রুনলুই পাড়াতে পূর্বে ত্রিপুরাদের দেখতে পাওয়া গেলেও এখন আর তেমন দেখা যায় না।এর কারণ স্থানীয়মতে,তারা সরব স্থান পছন্দ করে না বলে গহীনের পাহাড়ে চলে গেছে।
আপনি যখন রুনলুই পাড়া কিংবা কংলাক পাড়ার চূড়ায় উঠবেন, নিমিষেই মেঘ, পাহাড় আর সবুজের মিতালী চোখে পড়বে। অবচেতন মন বলে উঠবে এ কি! সবুজ শাড়ি পড়া পাহাড়ী কন্যার যেন সাদা মেঘের পাড়। আর মেঘকে নদী, জলাশয় ভেবেও ভুল হতে পারে আপনার। এতটা স্নিগ্ধ, প্রশান্তিময় পরিবেশে যে কেউ নিজেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে ফেলবে কল্পনার রাজ্যে।
সাজেকে যেন সবসময়ই শরৎকাল! কেন বললাম? সাজেক বড্ড অভিমানী, ক্ষণে ক্ষণে তার রুপ বদলায়। একটু আগে মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ দেখে বের হওয়া আপনি রিমঝিম বৃষ্টির কবলে পড়ে অকস্মাৎই ভিজে যেতে পারেন। কিংবা হঠাৎ বৃষ্টি বা রোদের মতো হঠাৎই মেঘের চাদরে মুড়িয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে সে। এমনটা এখানে প্রায়শই ঘটে।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে পাখীরা যখন আপন নীড়ের উদ্দেশ্যে প্রস্থানে ব্যস্ত, সে সময় সূর্যের রক্তিম আভা সাদা মেঘকে যেন অপরুপ সাজে রাঙিয়ে দেয়। সহসাই একটা দুটো করে তারারা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে অন্ধকার আকাশকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে। আর পূর্ণিমা হলে তো কথাই নেই, আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অজস্র তারকারাজির সাক্ষাত পাবেন।
খুব ভোরে সূর্যি মামা জাগার আগেই উঠে বসে থাকতে হবে আপনাকে সাজেকে তাকে দেখতে কেমন লাগে তা দর্শনের জন্য। ভোর হচ্ছে ,পাখির কিচির মিচির শব্দ কানে ভেসে আসছে,সূর্যি মামার মুখ ভেসে উঠছে এবং আপনার প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে আপনি এ অপরুপ দৃশ্য অবলোকন করছেন-একটু কল্পনা করুন তো এমন দৃশ্যপট।সব বাঁধা ডিঙিয়ে বারংবার ছুটে যেতে ইচ্ছা করবে সাজেকের প্রাকৃতিক রুপ দেখতে।
তাছাড়া কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দূরের লুসাই পাহড়ের দেখা মিলবে যেখান থেকে কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি। আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় সুরেলা গানও শুনতে পাওয়া যায় সকালে ও সন্ধ্যায়।বছরের বিশেষ কিছু সময়ে গেলে লুসাই,ত্রিপুরা বা পাংখোয়াদের উৎসব ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায় এবং দেখা যায়।এছাড়া দীঘিনালা থেকে সাজেক যাবার পথে বাঘাইহাটে হাজাছড়া ঝর্ণার অবিরত ধারাও দেখে আসতে পারেন ট্রেকিং করে।
যদিও যেকোন সময় আপনি সাজেক ভ্যালি বেড়াতে যেতে পারেন কিন্তু বর্ষার শেষ থেকে শীতের শুরুতে যাওয়াটা সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ বর্ষার প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ের পথে ধ্বস নামতে পারে কিংবা পিচ্ছিল পথে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।আর তীব্র শীতে ঠান্ডা বেশি পড়ে।
ঢাকার গাবতলী বা অন্যান্য কিছু এলাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, সেন্ট মার্টিন পরিবহন, এস আলম, বিআরটিসি সহ আরও কিছু বাসে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যায়। সরাসরি দীঘিনালা পর্যন্ত যেতে পারবেন শুধুমাত্র শান্তি পরিবহনে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রোড হয়ে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম পার হবার পরে খাগড়াছড়ি যেতে ৮ ঘন্টা সময় লাগে। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া যায় ২ ঘন্টার মধ্যে। দীঘিনালা থেকে সব সদস্যদের তথ্য দিয়ে সকাল ১০ টা ও বিকাল ৩ টায় সেনাবাহিনীর এসকর্টের মাধ্যমে জিপে করে (স্থানীয় নাম চান্দের গাড়ি) বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সাজেক ভ্যালি পৌঁছে যাবেন। ১০ জন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫ জন এ গাড়িতে চড়ে যেতে পারেন।
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাজেক রিসোর্ট ও রুন্ময় রিসোর্ট নামে দুইটি রিসোর্ট রয়েছে সাজেক ভ্যালিতে। কিন্তু এ দুটো রিসোর্টে খরচ একটু বেশি পড়ে। এছাড়াও মেঘ মাচাং রিসোর্ট,লুসাই কটেজ,আলো রিসোর্ট,ইমানুয়েল রিসোর্ট,দীঘিনালা গেস্ট হাউজে আপনি থাকতে পারেন।কিন্তু স্বল্প ব্যয়ে ক্লাবঘরে কিংবা ঐখানকার অাদিবাসীদের বাড়িতেও থাকতে পারবেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে।
সিস্টেম রেস্টুরেন্ট, খাং মং নামে দুটো রেস্টুরেন্ট রয়েছে সাজেক ভ্যালি -তে। এছাড়া স্থানীয় আদিবাসীদের হোটেল ও তাদের বাড়িতেও খাবার খেতে পারেন। তবে,আগে থেকেই ফোন করে আপনাকে জানাতে হবে বিষয়টা তাদেরকে। বাঁশ কোড়লের সবজি, ব্যাম্বো চিকেন, লইট্টা ফ্রাই, হাসের মাংস, জুমের ভাত, পাহাড়ি নানা ভর্তা, ডাল, মুরগীর মাংস, পরোটা, বার বি কিউ ইত্যাদি খাবার খেতে পারবেন সাজেক ভ্যালির বিভিন্ন রিসোর্ট , রেস্টুরেন্টে।
১. সঠিক সময়ে (সকাল ১০ টায় ও বিকাল ৩ টায়) এসকর্টে যাওয়া।
২. কোনমতেই সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ছবি তুলতে যাবেন না।
৩. পাওয়ার ব্যাংক ও ফোনের চার্জার অবশ্যই নিয়ে যাবেন।
৪. রবি, টেলিটক ও এয়ারটেলের সিম সঙ্গে নিয়ে যান।তবে এক্ষেত্রে রবির নেটওয়ার্ক সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায় সাজেকে।
৫. বর্ষার দিনে না যাওয়াই নিরাপদ।
৬. জাতীয় পরিচয়পত্র অবশ্যই নিজের সাথে নিয়ে যাবেন।
৭. আদিবাসী বা ভ্রমণরত কারও ছবি তোলার আগে অনুমতি নিয়ে নিবেন।
৮. ঈদ বা অন্য কোন ছুটির দিনগুলোতে রিসোর্টে জায়গা পেতে চাইলে, একমাস আগেই বুকিং দিয়ে রাখবেন।
৯. মোটর সাইকেল বা সি.এন.জিতে খাগড়াছড়ি বা দীঘিনালা থেকে সাজেক না যাওয়াই ভালো। কারণ এ রাস্তাটা খুব আঁকাবাঁকা।
১০. বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবস্থা সাজেকে নেই।অল্প সময়ের জন্য সৌর বিদ্যুৎ ও জেনারেটর পেতে পারেন।
১১. সাজেকে পানি সংকট রয়েছে।তাই পানি ব্যবহারে যথেষ্ট মিতব্যয়ী হতে হবে আপনাকে।
১২. দুই বা তিন দিনের জন্য সাজেকে থাকতে চাইলে, রিজার্ভ না করে শুধু যাবার জন্য চান্দের গাড়ি নিন। আসার সময় দীঘিনালায় ফোন দিলে, গাড়ি সাজেক চলে যাবে নিয়ে আসার জন্য। ফেরার সময় খাগড়াছড়ি হয়ে ফিরলে, আলুটিলা গুহা ঘুরে আসতে পারেন।
বিষণ্নতায় থাকা রুক্ষ, ক্লান্ত মনে প্রাণের সন্ঞ্চার করতে পরিবার সহ একবার ঘুরে আসতে পারেন এ মেঘরাজ্যে। তারপরে পাহাড়ী কন্যা, সাজেক ভ্যালি নামটা শুনলেই আপনার মন আনমনে গেয়ে উঠবে “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে” রবীন্দ্র সঙ্গীতটি।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্য সূত্রঃ www.rangamati.gov.bd, www.prothom-alo.com etc.
মন্তব্য লিখুন