বনরুই হলো প্রানীকূলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। বনরুই এর ইংরেজি নাম ‘Pangolin’। চায়না বনরুইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Manis pentadactyla’। দাঁত নেই বলে আগে দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীর দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার (Pholidata) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুই।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। স্বভাবেও অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, লম্বা লেজ গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে।
বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে, বলের মতো করে নেয়।
একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে, শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এ নিরীহ প্রাণীটি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উঁইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে, শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে।
এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে। শীতকাল প্রজনন মৌসুম। সাধারণত একটি বা দুইটি বাচ্চা দেয়। বিশ্বে ৮ প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তারমধ্যে বাংলাদেশে মালয়, ভারতীয় ও চায়না বনরুই ছিল। এমন ধারণা থাকলেও বর্তমানে চায়না বনরুই ছাড়া অন্য প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মিলছে না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণি হচ্ছে বনরুই।
বিশ্বব্যাপি বন্যপ্রাণী পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। ‘ট্রাফিক’র সূত্রমতে, ২০১০-২০১৫ সালের মধ্যে বনরুই পাচারে ব্যবহৃত মোট ১৫৯টি ‘রুট’ পাওয়া গেছে। চায়না এবং ভিয়েতনামে এর প্রচুর চাহিদা। প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। এশিয়ায় এ প্রজাতি বর্তমানে অতি মহা বিপন্ন।
ডব্লিউডব্লিউএফ’র এক জরিপ মতে, ২০১১-২০১৩ সালে মাত্র দুই বছরে বিশ্বে প্রায় ২ লাখের মত বনরুই পাচারকারীদের হাত থেকে জব্দ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জব্দ করা বনরুই মোট পাচার হওয়া বনরুইয়ের মাত্র দশ শতাংশ। ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে গত ষোলো বছরে অন্তত ষোলো লাখ বনরুই পাচার করা হয়েছে।
বনরুই পাচারের অস্তিত্ব মিলেছে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বন ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে। সেখানে দেখা মেলে ৫-৬ মিটার মাটির নিচ থেকে গর্ত করে বনরুইয়ের বাসা থেকে ধরে এনে নিয়ে গেছে পাচারকারীরা। চলতি বছরের কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরে পাচারকারীদের হাত থেকে ১টি বনরুই উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। এছাড়া বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে চলতি বছর ৪টি বনরুই বিভিন্ন সময় পাচারকারীদের থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে, জানিয়েছে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
বনরুই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মপ্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ (আইইউসিএন)। তাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়, এতদিন বনরুই পাচারের ক্ষেত্রে এশিয়া ছিল পাচারকারীদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এশিয়ায় বনরুইয়ের সংখ্যা মারাত্মক আকারে কমে যাওয়ায় কালো-ব্যবসায়ীদের নজর এখন আফ্রিকার দিকে।
একসময় চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে নিয়মিত এদের দেখা মিললেও বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বনরুই হারিয়ে গেছে। আদিবাসী গোষ্ঠীদের শিকার এবং পার্বত্য এলাকা থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনে মাংস হিসেবে বনরুই পাচার করার কারণে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে আর এদের দেখা মেলে না। স্থানীয়দের ভাষায়, এরা এখন বিলুপ্ত।
‘প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ’ গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বছর পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে ১৯ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা গেলেও কোনো বনরুইয়ের দেখা মেলেনি।
প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ’র সহকারী গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন জানান, বাংলাদেশে মোট ১১টি সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে বনরুইয়ের ওপর জরিপ করা হয় ২০১৭ সালে। আশার কথা হলো, ১১টি বনাঞ্চলের মধ্যে ৮টিতেই পাওয়া গেছে বনরুইয়ের অস্তিত্ব। আশঙ্কার কথা হলো, এসব বনাঞ্চলে একইসাথে মিলেছে বনরুই শিকারের আলামত। মূলত বনরুইয়ের মাংস ও আঁশের জন্য এটি শিকার করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বনরুই শিকারের সাথে জড়িত। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে বনরুইয়ের এক কেজি মাংসের দাম ২০০-৪০০ ডলার ছিল। বর্তমানে যা ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। পার্বত্য অঞ্চলে শিকার করা বনরুই বিশেষত আলীকদম এবং থানচি হয়ে পাচার হয় মিয়ানমারে। সেখান থেকে চায়নায়। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে এই প্রাণীর তেমন দেখা মেলেনি। শুধু পার্বত্য এলাকা নয়। সারাদেশ থেকেই বনরুই পাচার হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় তা ধরা পড়লেও তা পাচারের তুলনায় অতি নগন্য। মাংসের উচ্চমূল্যের কারণে চোরাকারবারীদের কাছেও পছন্দের প্রাণী বনরুই।
কিছু ভণ্ড কবিরাজ বনরুই মেরে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে তথাকথিত ঔষুধ তৈরির নাম করে ব্যবসা ফাঁদছে।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কাজ হয়। বাংলাদেশের মত চীন এবং ভিয়েতনামেও লোকজ ঔষধ তৈরির জন্য বনরুই ব্যবহার করা হয়। কিডনির রোগ, অ্যাজমা বা রক্ত সঞ্চালন বাড়ানোর জন্য বনরুইয়ের আঁশ দিয়ে কবিরাজি ঔষধ তৈরি করা হয়। যদিও এসব ঔষুধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৬টি দেশের মধ্যে ‘কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জার্ড স্পেসিস’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে বনরুইয়ের বাণিজ্যের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বনরুইয়ের অবৈধ বাণিজ্য রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না এখনো।
চলতি বছরের সিঙ্গাপুরে বনরুইয়ের নাইজেরিয়া থেকে আসা দুটি চালান আটক করা হয়। দুই চালানে প্রায় আটাশ টনের মত বনরুইয়ের আঁশ ছিল। যা অন্তত বাহাত্তর হাজার বনরুই হত্যা করে সংগ্রহ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ আট প্রকারের সব বনরুই বা প্যাঙ্গলিনকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে।
এরমধ্যে তিন প্রকার বনরুই অতি বিপন্ন তালিকায় রয়েছে।
সবশেষ আইইউসিএন’র লাল তালিকা অনুসারে বিশ্বব্যাপী চায়না বনরুইকে ‘মহা বিপন্ন’ ও ভারতীয় বনরুইকে ‘বিপন্ন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ উভয় প্রাণীকে বাংলাদেশের জন্য ‘মহা বিপন্ন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার শেষ সংকেত।
বনরুইয়ের মতো প্রাণীগুলো প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ। কেননা প্রতিনিয়ত এরা পিঁপড়া ও উইপোকা খেয়ে প্রকৃতির সুস্থতা রক্ষা করছে, অর্থের সাশ্রয় করছে। এদের নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতার কারণেই উইপোকার বিস্তার ও আক্রমণ বেড়ে গেছে। বাড়ি-ঘরে চৌদ্দতলায়-পনেরোতলায়ও উইপোকার আগ্রাসন।
বিশ্বজুড়ে যেসব দেশে বনরুই আছে সেসব দেশকে সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে, বন্ধ করতে হবে চোরাচালান। মানুষই এদের একমাত্র শত্রু। প্রকৃতিতে এদের জীবনসংহার করে এমন প্রাণী নেই বললেই চলে। কেননা শত্রুর আভাস টের পেলে এরা নিজেকে গুটিয়ে বলের আকার বানিয়ে ফেলে। শত্রু শক্ত আঁইশে আবৃত বনরুইকে খুলতেও পারে না আর দাঁতও বসাতে পারে না।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আমাদের কঠিন আইন থাকলেও তার প্রয়োগ অনেকটা উপেক্ষিত। এখন সময় এসেছে জনগণের জোড়ালো পদক্ষেপের। এসব পাচারকারীদের জনসম্মুখে নিয়ে আসার। আমাদের তথা বিশ্বের সজাগ দৃষ্টিই পারে, বনরুইকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে।
এখনই সংরক্ষণের মহা পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রাণীটি যেমন অজানা থেকে যাবে; তেমনি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে সুন্দর আরও একটি বন্যপ্রাণী। ইতোমধ্যে হায়েনা, শোল, নীলগাইসহ অনেক প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মন্তব্য লিখুন