জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প, তথা শাদ্দাদের কল্পিত কাহিনির ভিক্তি কি?

জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প তথা শাদ্দাদের কল্পিত কাহিনির ভিক্তি কি?

আমাদের উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত একটি কাহিনি হলো শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প। ওয়াজ-মাহফিলে কিন্বা বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠানে শাদ্দাদ নিয়ে এই কাহিনি একটি বিরাট রেওয়াজ এখনও ধরে রেখেছে এবং মানুষও তা শুনছে।  সাধারণ মানুষও প্রচলিত এই মিথ্যা ও ভিক্তিহীন কাহিনী শুনে অনেক সময় আবেগঘন হয়ে পরেন। আর যদি বক্তাগণ কথিত এই জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প করুণ সুরে শুনিয়ে থাকেন, তাহলে ইমোশনাল হয়ে চোখের কোনে দুফোঁটা পানি আসাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা শাদ্দাদের এই প্রচলিত কাহিনিকে জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প বলে কেন আখ্যায়িত করছি ? ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এর কি তাহলে কোন ভিত্তি নেই? ভিক্তি না থাকলে, এর রেওয়াজ এতো ব্যাপক বিস্তার কেন লাভ করলো? আলোচ্য প্রবন্ধে এসকল প্রশ্নের উত্তর আমরা খুজে দেওয়ার প্রচেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্।

শাদ্দাদের জান্নাত বানানো মিথ্যা গল্পঃ

প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা আলিফ লায়লা বা আরব্য রজনী হয়তো অনেকেই দেখেছেন৷ এই আরব্য রজনী গল্পগ্রন্থের আলোচিত এক কাহিনি হচ্ছে শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর গল্প। এছাড়াও বিভিন্ন বর্ননায় কাহিনীটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে –

শাদ্দাদ ছিল বিশাল এক রাজত্ব ও ধন-সম্পদের মালিক। তার কওমের নবী হযরত হুদ (আ.) তাকে আল্লাহর দাওয়াত দিয়েছিল। তখন সে বলল, ঈমান আনলে এর বদলে সে কী লাভ করবে? নবী হুদ (আ.) বললেন, পরকালে তাকে পরম শান্তির স্থান জান্নাত দেওয়া হবে।

এরপর হুদ (আ.) তার কাছে জান্নাতের নিয়ামত ও সুখ-শান্তির বিবরণ দিতে থাকেন৷ কিন্তু তখন সে দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলল, সে নিজেই তো এমন একটি জান্নাত বানাতে পারে৷ পরকালে কেন? দুনিয়াতে বসেই সে তার তৈরি জান্নাত বা বেহেশতে পরকালের সুখ-শান্তি ভোগ করবে।

এরপর প্রায় ১২০ একর বা এরও বেশি জমির উপর, ৩০০ বছর ধরে সে জান্নাত বানায়। সেখানে বিভিন্ন ফল-ফুলের গাছ লাগায়। মানুষের ব্যবহার্য স্বর্ন-রূপা লুন্ঠন করে তার প্রাসাদ সাজ্জিত করেন এবং সেখানে নহরও খনন করেন ইত্যাদি।

এরপর সে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তার বানানো জান্নাতের দিকে রওনা হয়। বর্ননায় বলা হয়েছে, সেখানে প্রবেশ করতে যখন এক দিন এক রাতের রাস্তা বাকি, তখন আল্লাহ তাকে তার সৈন্য-সামন্তসহ ধ্বংস করে দিয়েছিল।

শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প এর কোথাও বলা হয়েছে- তার তৈরি করা জান্নাত দেখতে যাওয়ার পথিমধ্যে, সে একটি সুন্দর হরিণ দেখতে পায়। হরিণটি শিকার করতে সে উদ্যত হয়ে একটু দূরে চলে যায়। এই মুহূর্তে মালাকুল মাউত তার সমানে হাযির হয় এবং তার রূহ কবয করে।

আবার কোথাও শোনা যায়- সে যখন তার বানানো জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য এক পা দিল, তখন দ্বিতীয় পা রাখার আগেই মৃত্যু হয়। অথবা তার ঘোড়া থেকে এক পা নামানোর মাত্রই মালাকুল মাউত তার রূহ কবয করে ফেলে ইত্যাদি।

জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প এর ঘটনায় কারো কারো মুখে এও শোনা যায়- তার রূহ কবযের পর আল্লাহ তা’আলা শাদ্দাদের ঐ জান্নাত জমিনে ধ্বসিয়ে দেন অর্থাৎ মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। আর এখন বালুর মধ্যে যে অংশ চিকচিক করতে দেখা যায়, তা নাকি শাদ্দাদের বানানো বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ।

এ ছাড়াও শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প কেন্দ্রিক আরো অনেক কথা সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন, সে তার জান্নাত কীভাবে বানালো,  শ্রমিক কতজন ছিল, দেয়াল কিসের ছিল, ফটক কিসের ছিল, মেঝে কিসের ছিল, ইত্যাদি কাহিনি।

শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প বা কাহিনীতে কোন শিক্ষা রয়েছে কি?

একটা কথা চিন্তা করুন, আমরা অনেক সময় আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে নানা ধরনের উদাহরণ বা গল্প শুনে থাকি। কোনো একটি বিষয়ে পাঠ দানের সময় বুঝানোর তাগিদে তারা এসব গল্প আমাদের বলে থাকেন৷ কিন্তু এসব গল্পের প্রায় বেশি ভাগেরই কোন দলিল হয় না!

যেমন আমরা শিয়াল পন্ডিতের গল্প, কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প সহ অসংখ্য গল্প পড়েছি। কিন্তু পৃথিবীতে অর্থাৎ বাস্তবে এসব ঘটনা বা গল্প কি সত্যি কোথাও হয়েছিল বা ঘটেছিল? উত্তর হবে, না। এগুলো বুঝানের তাগিদে বিভিন্ন উদাহরণ সরূপ মাত্র। আর বিভিন্ন ধরনের উপমা বা উদাহরণ দিয়ে, কোনো একটি বিষয় বুঝানোর চেষ্টা করা ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়।

ঠিক তেমনি আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ শিক্ষিত কিছু আলেমরা, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে উদাহরণ সরূপ শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প শুনিয়ে থাকেন। তবে এখানে একটি সুক্ষ্ম বিষয় লক্ষ্যনিয়, তা হলো আমাদের এই সাধারণ শিক্ষিত আলেমগণ, এই ঘটনা বা গল্পটিকে প্রায় সবাই সত্যি বলে বিশ্বাস করে থাকে।

আমাদের সাধারণ আলেমগণের এই বিশ্বাসের রেশ ধরে উপমহাদেশে শাদ্দাদের বেহেশত বানানোর কাহিনি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। যার দরুন মানুষ ইসলামের নামে, একটি ভ্রান্ত কিসসা বা কাহিনি হৃদয়ে  বস্তাবন্দি করে ফেলেছে।

এখন প্রশ্ন,আমাদের আলেমগণ এই কাহিনি কোথা থেকে পেল?

মূলত শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্পটি বিভিন্ন ইসরাইলি বর্ননা থেকে আমাদের উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। আর ইসরাইলি বিভিন্ন বর্ননা উদাহরণ সরূপ বুঝানোর তাগিদে বলা যেতে পারে৷ কিন্তু সেটাকে দলিল ছাড়া বিশ্বাস করা, একেবারেই তাদের অজ্ঞতার পরিচয়।

কিভাবে সম্ভব সহিহ দলিল ব্যতিত একজন নবী হুদ (আ.) এর সাথে এমন একটি অবাস্তব কাহিনি জুড়ে দেওয়া। একজন নবীকে মহান আল্লাহ তাঁর হেদায়েতের বানী প্রচার করার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। তাই নবী-রাসূলদের নিয়ে যেকোনো কিসসা-কাহিনি শরিয়তে সহিহ দলিল বা প্রমান ব্যতিত বাতিল বলে গন্য করা হইবে, এটাই হক কথা।

কেননা নবী-রাসুলের নিয়ে যেকোনো উদাহরণ পেশ করা হলেও তার সহিহ দলিল বা প্রমান থাকতেই হবে।  বুঝানোর তাগিদে বা উদাহরণ সরূপ হলেও তাদের নিয়ে কোন শিক্ষনীয় মিথ্যা গল্প রচনা করা শরিয়তে জায়েজ নেই। কেননা নবীগণ হলেন সত্যের পথের দিশারী, তাদের নিয়ে গল্প বা মিথ্যা কিসসা হয় না।

সূতরাং হুদ (আ.) এবং শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প ইসলাম ও জাতির জন্য কখনো কল্যানের হতে পারে না। এখান থেকে শিক্ষা নেওয়াও কোনো ভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। ইসলাম একটি বাস্তব ও সৌন্দর্য মন্ডিত জীবন ব্যবস্থা, এখানে মিথ্যার কোনো আশ্রয় নেই।

শাদ্দাদের কাহিনি সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আলেমগনের মন্তব্যঃ

বাংলাদেশ সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞ আলেম ও মুহাদ্দিস স্যার ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) তাঁর ‘হাদিসে নামে জালিয়াতি গ্রন্থে’ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আপনারা যে কেউ বইটি পড়লে এ সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পেয়ে যাবেন।

সেখানে ড.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) উল্লেখ করেন-

শাদ্দাদের জন্ম কাহিনী, তার সাথীদের মৃত্যু কাহিনী, শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প-এর লাগামহীন বিবরণ, বেহেশতে প্রবেশের পূর্বে তার মৃত্যু ইত্যাদি যা কিছু কাহিনী বলা হয় সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন কথা। এসব কিছু ইহূদীদের বর্ণনা ও কিছু জালিয়াগণের কাল্পনিক গল্প কাহিনী।

এ বিষয়ক কোনো কিছুই রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। অনেকে আবার এ মিথ্যাকে আল্লাহর নামেও চালিয়েছেন। এক লেখক লিখেছেন-

‘‘সে বেহেশতের কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাও কোরআনে পাকে উল্লেখ করেছেন যে, হে মুহাম্মাদ! শাদ্দাদ পৃথিবীতে এমন বেহেশত নির্মাণ করেছিল, দুনিয়ার কোনো মানুষ কোনোদিনই ঐরূপ প্রাসাদ বানাতে পারে নাই…।’’ [ছহী কাসাসুল আম্বিয়া, আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া]

আসতাগফিরুল্লাহ, আল্লাহর কালামের কি জঘন্য বিকৃতি করা হয়েছে !! এখানে কুরআনের সূরা ফাজরের ৬-৭ আয়াতের অর্থকে বিকৃত করে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মূলত অনেক মুফাস্সির এ আয়াতের তাফসীরে সনদ বিহীনভাবে এ সকল বানোয়াট কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। আবার ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় গ্রন্থে সনদ বিহীনভাবে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সবই মিথ্যা বানোয়াট।

এ বিষয়ে ইবনু কাসীর (রহ.) বলেন: ‘‘অনেক মুফাস্সির এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইরাম শহর সম্পর্কে এ সকল কথা বলেছেন। এদের কথায় পাঠক ধোঁকাগ্রস্থ হবেন না।…এ সকল কথা সবই ইহূদীদের কুসংস্কার ও তাদের কোনো কোনো যিনদীকের বানোয়াট কল্পকাহিনী। এগুলো দিয়ে তারা মুর্খ সাধারণ জনগণের বুদ্ধি যাচাই করে, যারা যা শোনে তাই বিশ্বাস করে…।’’ [কাসীরে ইবনে তাফসীর, আল-ইসরাঈলিয়্যাত]

মন্তব্য ও সিদ্ধান্তঃ

প্রিয় পাঠকগণ, শাদ্দাদের জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প সম্পর্কে আমরা প্রসিদ্ধ আলেম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তারপরও আপনারা আরও বিস্তারিত জেনে নিবেন আশা করি।

কিন্তু বিশেষ করে আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসরাইলি বিভিন্ন কিসসা-কাহিনি উদাহরণ সরূপ পেশ করা হলেও, দলিল ব্যতিত তা কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। আর সকল প্রকার ইসরাইলি বর্ননাও বলা বা গ্রহন করা যাবে না। আগে আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, সে সম্পর্কে সালফে সালেহীনগণ, প্রসিদ্ধ ইমাম, ফকিহ বা মুজতাহিদগণ কি মন্তব্য করেছেন।

সুতরাং আমরা শাদ্দাদের কল্পিত বেহেস্ত বা জান্নাত বানানোর মিথ্যা গল্প সম্পর্কে অবিহিত হলাম অর্থাৎ তা মিথ্যা ও বানোয়াট। ইসলামে এর কোনো ভিক্তি নেই, ইহা বাতিল ও বিভ্রান্তি। তাই আমাদের সকলের উচিত দ্বীন ইসলামের সহিহ বানী ও ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহন করা এবং সকলের কাছে সহিহ বানী পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের সহিহ বুঝ দান করুক,আমিন

তথ্য সহায়তাঃ

Exit mobile version

Fatal error: Uncaught TypeError: fclose(): Argument #1 ($stream) must be of type resource, false given in /home/digilshq/public_html/wp-content/plugins/wp-super-cache/wp-cache-phase2.php:2381 Stack trace: #0 /home/digilshq/public_html/wp-content/plugins/wp-super-cache/wp-cache-phase2.php(2381): fclose(false) #1 /home/digilshq/public_html/wp-content/plugins/wp-super-cache/wp-cache-phase2.php(2141): wp_cache_get_ob('<!DOCTYPE html>...') #2 [internal function]: wp_cache_ob_callback('<!DOCTYPE html>...', 9) #3 /home/digilshq/public_html/wp-includes/functions.php(5464): ob_end_flush() #4 /home/digilshq/public_html/wp-includes/class-wp-hook.php(324): wp_ob_end_flush_all('') #5 /home/digilshq/public_html/wp-includes/class-wp-hook.php(348): WP_Hook->apply_filters('', Array) #6 /home/digilshq/public_html/wp-includes/plugin.php(517): WP_Hook->do_action(Array) #7 /home/digilshq/public_html/wp-includes/load.php(1279): do_action('shutdown') #8 [internal function]: shutdown_action_hook() #9 {main} thrown in /home/digilshq/public_html/wp-content/plugins/wp-super-cache/wp-cache-phase2.php on line 2381