জুম’আর দিন একটি ফজিলতপূর্ণ দিন হিসেবে ইসলাম ধর্মে প্রসিদ্ধ। হাদিস শরিফে এ দিনের ফজিলত ও মর্যাদা নিয়ে অনেক সহিহ বর্ণনা রয়েছে৷ অর্থাৎ এ দিনের আলাদা কিছু স্পেশাল আমল আছে, যা সহিহ বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে আমাদের উপমহাদেশে জুম’আর দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর প্রতি তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় না। কিন্তু একটি আমল, আসরের নামাজের পর আশিবার দরুদ পাঠের মাধ্যমে ‘আশি বছরের গুনাহ মাফ‘ পাওয়ার হাদিসটি খুবই বিস্তার লাভ করেছে।
তাই আমাদের একটু পর্যালোচনা করে দেখা উচিত, ‘আশি বছরের গুনাহ মাফ’ পাওয়ার যে আমলটি আমরা করছি, সে সম্পর্কিত হাদিসটি সহিহ কিনা? মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসটি সম্পর্কে কি মন্তব্য করেছেন? হাদিসটি আমল করা যাবে কিনা? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন হাদিসটি নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মন্তব্য জেনে আশা যাক, ইংশাআল্লাহ্।
আশিবার দরুদ পাঠের মাধ্যমে জুম’আর দিনে গুনাহ মাফের হাদিসটি হলো নিম্নরূপ-
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,“যে ব্যক্তি জুম’আর দিন আসর নামাজের পর না উঠে, ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরিফ পাঠ করবে, তার আশি বছরের গুনাহ মাফ করা হবে এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। দোয়াটি হলো-
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লিম তাসলীমা।”
এখন আমাদের জানার বিষয় হলাে, এ হাদীসটি সহীহ কিনা? এ হাদীসের ওপর আমল করা যাবে কিনা? যেহেতু অনেক মানুষকে হাদীসটির ওপর আমল করতে দেখা যায়! যেহেতু, শরিয়তে সওয়াব বা ইবাদতের উদ্দেশ্যে যাই আমল করা হোক না কেন, তার সহিহ দলিল থাকা বাধ্যতামূলক৷
ইবনে শাহীন ‘আত-তারগীব ফি ফাযায়েলীল আমাল’ পৃ. ১৪ তে আওন ইবনে উমারাহ থেকে এবং তিনি সাকান আল-বুরজুমী থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবন সিনান থেকে, তিনি আলী ইবনে যায়েদ থেকে, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব এবং তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
তিনি উল্লেখ করেন রাসূল (সা.) বলেন- “আমার ওপর দুরূদ পড়া, পুলসিরাতের উপর নূর। যে ব্যক্তি জুমু’আর দিন আমার ওপর ৮০ বার দরুদ পড়বে, তার আশি বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”
আলেমগণের কেউ কেউ হাদীসটি সম্পর্কে নমনীয়তা ও উদারতা প্রদর্শন করেণ এবং হাদীসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেণ। কিন্তু সঠিক কথা হলাে, হাদীসটি দুর্বল, শুধু দুর্বল নয়, খুবই দুর্বল।
কারণ, এই হাদিসটির সনদে তিনজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। যথা: আলী ইবনে যায়েদ ইবন জাদ’আন আল বাসরী, হাজ্জাজ ইবনে সিনান,আওন ইবনে উমারা আল-কাইসী।
আমরা জানি একটি হাদিস সহিহ, দয়িফ, কিন্বা জাল হওয়ার ক্ষেত্রে হাদিসের সনদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সহিহ হওয়ার ক্ষেত্রে হাদিসের সনদে রাবীগণের মধ্যে কোন সমস্যা থাকতে পারবে না। তাই এখন আমরা এই তিনজন ব্যক্তি সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য জানার চেষ্টা করবো, ইনশাল্লাহ্।
একঃ আলী ইবন যায়েদ ইবন জাদ’আন আল বাসরী:
[দেখুন: ইমাম আয যাহাবী রহ.-এর ‘আল মুগনী ফীদ দু’আফা’ পৃ. ৪৪৭/২ ]
দুইঃ হাজ্জাজ ইবনে সিনান:
তার সম্পর্কে আযদী (রহ.) এর মন্তব্য পাওয়া যায়। তিনি বলেন- সে মাতরুক, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী।
তিনঃ আওন ইবনে উমারা আল-কাইসী:
[আরো দেখুন: তাহযীবুত তাহযীব, পৃ. ১৭৩/৮]
ইমাম দারা কুতনী (রহ.), হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) স্বীয় কিতাব ‘নাতায়েজুল আফকার’ (৫৬/৫); আল্লামা সাখাবী (রহ.) স্বীয় কিতাব ‘আল কাওলুল বাদী’ পৃ. ২৮৪; আল্লামা মুনাবী, ফাইযুল কাদীর’ পৃ. ২৪৯/৪; কামাল ইউসুফ আল-হুত আল- বাইরূতি (রহ.) তাঁর কিতাব ‘আসনাল মাতালেব’ পৃ. ১৭৫ এবং শাইখ আল-আলবানী (রহ.) স্বীয় কিতাব ‘সিলসিলাতুদ দ্বা’য়ীফা’ পৃ.২৭৪/৮
জুম’আর দিনে আসরের পর ৮০ বার দরুদ পাঠ করে ‘আশি বছরের গুনাহ মাফ’ পাওয়ার এই হাদীসটির সমর্থনে আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে অপর একটি হাদীসে তিনি উল্লেখ করেন, আমি রাসূল (সাঃ) সম্মূখে দাঁড়ানাে ছিলাম, তখন তিনি বলেন-
“জুমু’আর দিন যে ব্যক্তি আমার ওপর ৮০ বার দুরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা’আলা তার আশি বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।”
আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহ.) এই হাদীসটিকে বানােয়াট বলেছেন। তিনি আরও বলেন- হাদীস বানানাের বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট। রাসূল (সা.) ওপর দরুদ পাঠ করার ফজিলত বিষয়ে বিশুদ্ধ হাদীসগুলাে যথেষ্ট। এ ধরনের মাওদু হাদীসের কোনাে প্রয়ােজন নেই।
যেমন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-
“যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দুরূদ পড়ে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দশবার দুরূদ পড়েন।” (সহীহ মুসলিম)
[দেখুনঃ সিলসিলাতুল আহাদীস আদ্ব দ্বয়ীফাহ ওয়াল মাওদু’আহ’ ৩৮৩/১]
জুম’আর দিন একটি ফজিলতপূর্ণ দিন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এ দিনের আমল সম্পর্কে সহিহ অনেক বর্ণনা হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) বলেছেন। আর সব আমলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো সকাল ও বিকালে বেশি বেশি করে রাসূল (সাঃ) এর প্রতি দরুদ পাঠ করা। ফজরের সালাত জাম’আতে আদায় করা, তাড়াতাড়ি জুম’আর মসজিদে নামাজের জন্য যাওয়া।
আমরা সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরীফ সহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে সহিহ সনদে এ সকল আমলের কথা দেখতে পাই।
সুতরাং আমরা দেখলাম ৮০ বার দরুদ পাঠের মাধ্যমে আশি বছরের গুনাহ মাফ পাওয়ার আমলটি সঠিক নয়। এ ধরণা ও বিশ্বাস তাই ত্যাগ করা উচিত। কেননা, ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) ও সাহাবিদের সহিহ দলিল ব্যতিত আমল করা বৈধ নয়। তাই স্কলারদের মন্তব্য অনুযায়ী এই আমলটি গ্রহণযোগ্য বলা যাচ্ছে না। আর যেহেতু, জুম’আর দিনের ফজিলত সম্পর্কে সহিহ অনেক বর্ণনা বা আমল রয়েছে৷ তাই এ দিনের ফজিলত বা আমলের জন্য কোনো দুর্বল অথবা জাল হাদিসের অনুসরণ প্রশ্নই আসে না৷
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দ্বীনের সহিহ বুঝ দান করুক, আমিন।
তথ্যসুত্রঃ
মন্তব্য লিখুন