গল্প বা সিনেমায় সিরিয়াল কিলিং এর কাহিনী আমরা অনেকই পড়েছি বা দেখেছি। যেখানে কেউ একজন একই কায়দায় একের পর এক খুন করতে থাকে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী সেই খুনীর খোঁজ করতে থাকে। এই সকল গল্প বা সিনেমা অনেক ক্ষেত্রে কল্পনা নির্ভর হয় আবার কখনো কখনো সত্যি কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। অধিকাংশ সিরিয়াল কিলিং এর গল্প বা সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় যে সেই সিরিয়াল কিলার ধরা পরেছে এবং তার সাজা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সবসময় এমনটা হয়না, “জ্যাক দ্য রিপার” হলো তার প্রমাণ।
জ্যাক দ্য রিপার হলো একজন সিরিয়াল কিলার। সে ১৮৮৮ সালে সিরিয়ালি বেশ কিছু খুন করে কিন্তু সাজা তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি কে এই “জ্যাক দ্য রিপার”? এজন্য ইতিহাসের কুখ্যাততম সিরিয়াল কিলারের খেতাব জুটে যায় জ্যাক দ্য রিপারের কপালে। কে ছিল এই জ্যাক দ্য রিপার? চলুন ডুব দিয়ে আসি সেই অমীমাংসিত রহস্যে।
প্রথমেই বলে রাখি যে কে এই জ্যাক দ্য রিপার তা কেউ জানে না। এমনকি এটি তার আসল নাম কিনা তাও জানা নেই। একজন সিরিয়াল কিলার, যাকে কেউ কখনো দেখেনি তার নাম পরিচয় কি করে জানবে?
১৮৮২ সাল, ব্রিটেন তখন প্রচুর আইরিশ ও ইহুদী অভিবাসীর আগমনে ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল অঞ্চলে জনসংখ্যার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
লোকের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে চাকরির সংখ্যা না বাড়ায় অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যায়। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি আর মাতলামি ছিল অহরহ। মেয়েদের কাজের অভাব ছিল আরও বেশি। কেবল পূর্ব লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল এলাকাতেই ৬২টি পতিতালয় ছিল যেখানে কাজ করতো অনেক নারী।
এরকমই এক সময়ে ১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট শুক্রবার রাত ৩টা বেজে ৪০ মিনিটে পূর্ব লন্ডনের লোকজন একটি মেয়ের লাশ আবিষ্কার করেন। মেয়েটির নাম মেরি অ্যান নিকোলস। পেশায় একজন পতিতা। তখনের হিসেবে খুন হওয়াটা খুব বড় কোনো ঘটনা বলা যায় না।
কিন্তু যে বিভৎস ভাবে খুন করা হয়েছিলো তা অবশ্যই নতুন এবং সবাইকে আতংকিত করে। তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে দুবার আঘাতে করে তার গলা কাটা হয়েছে। এবং খুবই নিখুঁতভাবে তার তলপেটের নিচ থেকে একটা বড় অংশ কেটে নিয়ে যায় জ্যাক দ্য রিপার। এই খুনের মাধ্যমে শুরু হয় এক সিরিয়াল কিলিং।কিন্তু এটা যে সিরিয়াল কিলিং হতে পারে সে চিন্তা তখনও কারো মাথায় আসে নি।
কে এই খুনী ( জ্যাক দ্য রিপার)? মেরি অ্যান নিকোলস এর সাথে তার কি সম্পর্ক এবং কি কারণেই বা তাকে এতটা বিভৎস ভাবে হত্যা করা হলো? সবাই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলো।
৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮। শনিবার। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ প্রায় ঐ একই এলাকায় আরোও একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। নাম অ্যানি চ্যাপম্যান। পেশায় তিনিও একজন পতিতা। খুনের ধরন একই।
তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে দু’বার আঘাত করে গলা কাটা হয়েছে এবং তলপেটের নিচ থেকে পুরোটা ফাঁড়া। ভেতর থেকে জরায়ু কেটে নিয়ে গিয়েছে।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,মারা যাবার আধা ঘণ্টা আগেও উসকোখুসকো কালো চুলের এক ভদ্রলোককে দেখা গিয়েছে চ্যাপম্যানের সাথে। সিরিয়াল কিলার দ্বারা পর পর এমন দুটো বিভৎস খুনের পর পূর্ব লন্ডনের অধিবাসীদের মাঝে ভয় ছড়িয়ে পড়ে।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮, রবিবার। ভোরবেলায় এলিজাবেথ স্ট্রাইড এবং ক্যাথারিন এডোজ নামের দুজন মহিলার এর লাশ পাওয়া যায়।যদিও দুজনকে দু’জায়গায় পাওয়া যায়, কিন্তু দুজনই ছিল পতিতা।
ক্যাথারিনের খুনের ধরন মেরি অ্যান নিকোলস এবং অ্যানি চ্যাপম্যান এর খুনের ধরনের সাথে মিলে যায়। ছুরি দিয়ে গলা কাটা।তলপেটের নিচ থেকে কেটে ভেতরে বাম কিডনি আর জরায়ুর বেশিরভাগ অংশই কেটে নিয়ে গিয়েছে জ্যাক দ্য রিপার। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এক উসকোখুসকো চুলের লোককে ক্যাথারিনের সাথে দেখেছিলো।
কিন্তু এলিজাবেথের মৃত্যুটা একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। গলা কাটার সাথে মিল ছিলো কিন্তু তলপেটের নিচে কোন আঘাত নেই।ধারণা করা হয়, হয়তো তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যাবার জন্য তলপেটে আঘাত করতে পারেনি জ্যাক দ্য রিপার। একই রাত্রে এই জোড়া খুনের পর সমস্ত লন্ডনে সিরিয়াল কিলারের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
৯ নভেম্বর ১৮৮৮, শুক্রবার সকাল পৌনে এগারোটায় আরোও একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতের নাম মেরি কেলি। মেরি কেলির লাশটি উদ্ধার করা হয় তার নিজের রুম থেকে। তার নিজের বিছানায় খুব যত্নের সাথে তার গলা কাটা হয়েছে। তলপেটের নিচে তো কাটা হয়েছেই এছাড়াও মেরুদণ্ড এবং হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কেটে নিয়ে গেছে জ্যাক দ্য রিপার।
এরপর ১৮৯১ সাল পর্যন্ত হোয়াইটচ্যাপেলের আরো ১১ টি খুনের অপরাধী ধারণা করা হয় জ্যাক দ্য রিপার কে।কিন্তু বাকি খুনগুলোর ধরন প্রথমে উল্লিখিত পাঁচ খুন থেকে আলাদা। তাই ধারণা করা হয় এই বাকি খুন গুলো জ্যাক দ্য রিপার করেনি।
অনেকের ধারণা, এই মেরি কেলির খুনের পর হয়তো এই সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপার হোয়াইটচ্যাপেল ছেড়ে চলে যায়,অথবা মারা যায়, কিংবা খুন করা থামিয়ে দেয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না।
প্রথমে উল্লিখিত পাঁচটি খুনকে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা হয় যে এগুলো তার কাজ। এগুলোকে ক্যানোনিকাল ফাইভ বলে।
একের পর এক খুনের কারণে হোয়াইটচ্যাপেলের সকল নাগরিক আতঙ্কিত হয়েছিলো। সবার মনে একটিই আতঙ্ক এর পর কে খুন হবে। কারো জানা নেই কে এই খুনী বা তার নাম কি। তখন এই সিরিয়াল কিলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হতে থাকে “হোয়াইটচ্যাপেলের খুনী” এবং “লেদার অ্যাপ্রন” নামে।
১৮৮৮ সালে যখন এই খুনের ঘটনা ঘটছিলো তখন জনমনে আরো আতঙ্ক বৃদ্ধির জন্য অনেকেই অঞ্জাত পরিচয়ে পত্রিকায় অথবা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে চিঠি দিয়ে নিজেকে হত্যাকারী বলে স্বীকার করে। যার অধিকাংশই মিথ্যা।
হোয়াইটচ্যাপেল ভিজিলেন্স কমিটির জর্জ লাস্ক একটি চিঠি পায় “ফ্রম হেল”।চিঠিতে লেখক নিজেকে হত্যাকারী বলে স্বীকার করে এবং দাবী করে বলেন যে তার কাছে জনৈক মৃতের কিডনির অর্ধাংশ সংরক্ষিত আছে। এই চিঠির নিচে নাম লেখা ছিল জ্যাক দ্য রিপার। সেই থেকে এই সিরিয়াল কিলার এর নাম হয় জ্যাক দ্য রিপার। এরপর থেকে জ্যাক দ্য রিপার কে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়।
কে এই জ্যাক দ্য রিপার এ নিয়ে অনেক গবেষণা চালানো হয়।কিন্তু কেউই তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। জ্যাক দ্য রিপারের উপর গবেষণাকে বলা হয় “রিপারোলজি”। [“রিপ” মানে ছিঁড়ে বা কেটে নিয়ে যায় যে]। খুনগুলোর ধরন দেখে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় খুনী হয়তো একজন শল্যচিকিৎসক বা শরীরতত্ত্ব বিষয়ে তার ঞ্জান আছে। অনেকেই তার বিষয়ে অনেক তত্ত্ব দিয়েছেন অর্থাৎ কে ছিলেন বা কে হতে পারে এই জ্যাক দ্য রিপার। প্রচলিত এমন অসংখ্য তত্ত্বের মধ্যে বহুল প্রচলিত তত্ত্বটি হলো।
লিওনার্ড ম্যাটারস কোনাে প্রমাণ ছাড়াই ঘােষণা করেন যে স্ট্যানলি নামের এক ডাক্তারই জ্যাক দ্য রিপার। বিপত্নীক এই ডাক্তার তার ছেলেকে ভীষণ ভালােবাসত। সে ছেলে মেরি কেলির সংস্পর্শে এসে সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর তাই স্যার স্ট্যানলি তার জীবন উৎসর্গ করল মেরিকে খুঁজে বের করার জন্য।
সবগুলাে শিকারের কাছে জানতে চাইল মেরির কথা, তারপর সবাইকে হত্যা করল মুখবন্ধ রাখার জন্য, অবশেষে মেরি কেলিকে পাওয়ার পর তাকে হত্যা করে সিরিয়াল কিলিং বন্ধ করে দিল। লিওনার্ড ম্যাটারস বলেছে যে, স্ট্যানলি মারা গেছে বুয়েনেস এয়ারসে।এবং মৃত্যুশয্যায় এমন স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে। কিন্তু এই তত্ত্বের সত্যতা কতটা তা বলা যায় না।
এমন আরো অনেক তত্ত্ব প্রচলিত আছে, গত ১৩২ (১৮৮৮-২০২১) বছরেও সঠিকভাবে বলা যায় না যে, সিরিয়াল কিলারের ছদ্মবেশে কে ছিলো এই জ্যাক দ্য রিপার। কোথা থেকে এসেছিলো এবং কেনইবা পাঁচজন নিরীহ পতিতাকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করলো। তাই জ্যাক দ্য রিপার আজও এক অমীমাংসিত রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
মন্তব্য লিখুন