অরিজিৎ সিং এমন একজন সংগীত শিল্পী, যিনি তার জাদুকরি সুরের মাধ্যমে শ্রতার মনে অনুভুতি ও মানসিক সস্তি দুটই খুব সহজে নিয়ে আসতে পারেন। ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় গায়কের মধ্যে অরিজিৎ অন্যতম। খুবই কম বয়সে তিনি সংগীত জগৎ-এ পা রাখেন। ভারতের বড় বড় শিল্পীদের পাশে নিজের আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। নিজের মনমুগ্ধকর সুরের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় সংগীত জগৎ-এ আলাদা একটি ধারা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
বর্তমানে অনেক মানুষের মুখে তার গানের সুর শোনা যায়। বলিউড এর যতগুলো নতুন মুভি প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশ মুভিতে অরিজিৎ সিং এর গাওয়া কোন না কোন একটি গান থাকে। ২০১৩ সালের অরিজিৎ এর গাওয় গান ‘তুম হি হো’ এখন পর্যন্ত সর্বাধিক জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গান। তিনি মুলত বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান করেন । অরিজিৎ ভারত সহ অন্য দেশগুলতেও সমান জনপ্রিয়তা অজর্ন করেছেন ।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
অরিজিৎ ১৯৮৭ সালের ২৫ শে এপ্রিল পশ্চিম বঙ্গের মুরসিদাবাদে জিয়াগঞ্জ-এ জন্মগ্রহন করেন । অরিজিৎ এর বাবা পাঞ্জাবী এবং মা বাংঙ্গালি ছিলেন। অরিজিৎ এর পরিবারের প্রায় সকল সদস্য মিউজিকের সাথে যুক্ত ছিলো । তার নানী ভারতীয় সংগীতের উপর আগে থেকেই প্রশিক্ষিত ছিলেন। তার মামা তবলা বাদক ছিলেন এবং মাও গান গাইতেন । পরিবারের সকল সদস্য মিউজিকের সাথে যুক্ত থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই তিনিও সংগীতে নিজের আত্নপ্রকাশ করা শুরু করেন । অরিজিৎ প্রথমে ‘রাজা বীযায় সিং হাই স্কুল’ এবং এরপরে ‘স্রিপাত সিং কলেজ’ থেকে নিজের পরাশুনা শেষ করেন ।
অরিজিৎ এর ক্যরিয়ার
পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না অরিজিৎ এর। মিউজিকের প্রতি তার বেশি আকর্ষন ছিল । যার কারনে অরিজিৎ এর বাবা মা মিউজিকের প্রতি তার এই আকর্ষন দেখে, তাকে পেশাদার সংগীত প্রশিক্ষন দেওয়া শরু করেন । পন্ডিত রাজেন্দ্র প্রসাদ হাজারী এর থেকে তিনি ইন্ডিয়ান ক্লাসিক মিউজিক এর উপর প্রশিক্ষন নেওয়া শুরু করেন । দ্রিরেন্দ্র প্রসাদ হাজারী এর কাছে তবলা বাজানো শেখেন এবং বিরেন্দ্র প্রসাদ হাজারীর কাছ থেকে রবিন্দ্র সংগীত ও পপ মিউজিক শেখেন ।
রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহন
বিজ্ঞ পন্ডিতদের কাছ থেকে মিউজিকের উপর তিনি ভালই প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। কিন্তু তার এই দক্ষতাকে প্রকাশ করার জন্য তার একটি প্লাটফর্ম প্রয়োজন ছিলো । সৌভাগ্যক্রমে তিনি সে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন । ২০০৫ সালে অরিজিৎ ভারতের একাটি রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহন করেন ।
এখানে অংশগ্রহন করার জন্য তিনি নিজের শহর ছেড়ে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান । এই রিয়েলিটি শো-তে অংগ্রহন করতে তাকে অনেকগুল অডিশন দিতে হয়েছে । অডিশন এতই কঠিন ছিল যে, মাঝে মাঝে সে ঘুমানোর সুযোগও পেত না । বিচারক ও অন্যান্য প্রতিযোগীদের কাছে তিনি পছন্দের শিল্পী হয়ে ওঠেন । কিন্তু সবার পছন্দের তালিকায় থাকার পরও অরিজিৎ সেরা ৫ জনের মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারেন নি ।
এই সুযোগ পেয়ে তিনি যতটা খুশি হয়েছিলেন, পরাজয়ের কারনে তার থেকেও কয়েকগুন বেশি কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু ঐ রিয়েলিটি শো-তে একজন বিচারক ছিলেন যিনি অরিজিৎ এর পারফর্ম এ সন্তুষ্ট ছিলেন । এবং তিনি ছিলেন সংকর মহাদেবান । তিনি অরিজিৎ কে বলেন ,‘সামনে অনেক কিছু রয়েছে একসাথে করা যাবে’। এর কিছুদিন পরেই সংকর মহাদেবান এর হাই স্কুল মিউজিক্যাল-২ এলবাম এর গান ‘আজা নাচলে’ গাওয়ার সুযোগ করে দেন ।
পরবর্তীতে অরিজিৎ আরও একটি রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহন করেন । যার নাম ছিল, ‘দশ কে দশ লে গেয়া দিল’। এবারে তিনি এই শো এর প্রথম স্থান অর্জন করেন। এই শো-টিতে প্রথম হওয়ার পর, ভারতের জনপ্রিয় পর্যায়ে গান গাওয়ার অনেকগুল কন্ট্রাক পেয়ে যান । কিন্তু মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের পা রাখতে তাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হয় ।
সংগীত শিল্পী থেকে প্রডিউসার
সাধারনত সবাই জানেন মুম্বাই আসার পর তিনি প্লে-ব্যক সিংইং শুরু করেন । কিন্তু শুরুতেই এমনটা করেন নি । ঐ সময় ভারতে অনেক ভাল গায়ক থাকার পরও ভাল গানের অনেক কমতি ছিল । তাই অরিজিৎ নিজের ক্যারিয়ার প্লেব্যাক সিংইং থেকে মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে পরিবর্তন করেন ।
একজন মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে জনপ্রিয় কয়েকজন মিউজিক ডিরেক্টর এর সাথে কাজ করেন। এরমধ্যে প্রিতম চক্রবর্তী, বিশাল শেখর ও মিথুন দে অন্যতম। ঐ সময় এটাই একমাত্র পথ ছিল যার মাধ্যমে তিনি মুম্বাইতে নিজে আয় নির্ভর ভাবে থাকতে পারতেন । এখন বর্তমানের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় এই সিদ্ধান্ত তার ক্যারিয়ার এর জন্য একটি মাইলফলক ছিল । কারন মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে তার এই র্চচা তাকে একজন সফল সংগীত শিল্পী হতে সাহায্য করেছে ।
অরিজিৎ মিউজিক ও প্লেব্যাক এর উপর সম্যক ধারনা অর্জন করেন। ২০১০ সালে মিউজিক ডিরেক্টর প্রিতম এর সাথে ১৬টি মুভির মিউজিকের উপর কাজ করেছিলেন । তখন অরিজিৎ এক দিনে ৫ থেকে ৬ টি গানের রাফ কাট গাইতেন । অরিজিৎ এর এই দক্ষতা দেখে ডিরেক্টর প্রিতম এর অরিজিৎ এর উপর কনফিডেন্স আরও বেড়ে যায় । এর ফলে প্রিতম অরিজিৎকে দিয়ে নিজের মুভিতে গান গাওয়ানো শুরু করেন।
আরও পড়ুনঃ দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী কাজল আগারওয়াল এর জীবনী
যখন এই গানগুলো প্রকাশ পায় তখন অন্য মিউজিক ডিরেক্টরদের থেকে গানের অফার আসতে শুরু করে । এরপর ধীরে ধীরে অরিজিৎ এর সুর দর্শকদের কাছে পৌছতে শুরু করে । খুব তারাতারি তিনি ইন্ডিয়ান মিউজিক ইন্ডাসট্রিতে নিজের আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করেন। শ্রোতার কাছে তার গানগুলো দিন কে দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে । তিনি প্রায় সব ধরনের গান গেয়ে দর্শকের মনে
জায়গা করে নিয়েছেন ।
তবে গান গাওয়ার তুলনায় তিনি গান কম্পোজ করায় বেশি উপভোগ করেন। একটি ইন্টারভিউতে বলেন, ‘অদুরভবিষ্যৎ এ তিনি নিজেকে একজন গয়ক নয় বরং একজন মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে দেখতে পছন্দ করবেন’।
অরিজিৎ সিং এর ব্যক্তিগত জীবন
অরিজিৎ এর বেলায় যে তথ্যটি খুবই কম মানুষ জানে তা হলো অরিজিৎ অনেক আগে থেকেই বিবাহিত। একটি রিয়েলিটি শো এর মাধ্যমে একজন সহ-প্রতিযগীর সাথে তার বিয়ে হয় । কিন্তু দূর্ভাগ্য ক্রমে তার প্রথম বিয়ে ভেঙ্গে যায় ।
এরপর তিনি তার ছোট বেলার বান্ধবী কোয়েল রয়কে বিয়ে করেন । কোয়েল রয়ও বিবাহীতা ছিলেন । প্রথম সংসারে জটিলতা আসায় কোয়েল ডিভোর্স নেয় ও অরিজিৎকে বিয়ে করেন । কোয়েলের প্রথম বিয়েতে একটি ছেলে রয়েছে। অরিজিৎ এর পছন্দের শিল্পী হচ্ছেন কিশোর কুমার , গোলাম আলি , জগৎ জিৎ সিং, মোহাম্মাদ রাফি, লতা মুঙ্কেষগর , কে কে।
বর্তমানে এমন অনেক শিল্পী আছেন যারা অরিজিৎ-কে তাদের পছন্দের শিল্পীদের তালিকায় প্রথম স্থানে রেখেছেন। ভবিষ্যতে তিনি একটি মিউজিক স্কুল খুলবেন বলে জানিয়েছেন । এছাড়াও তিনি একটি বাংলা ফিচার মুভি ‘ভালবাসার রোজনাম চা’ এ বিশেষ নির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন ।
অরিজিৎ তার সাফল্যর যাত্রায় বেশ কিছু এওয়ার্ড পেয়েছেন । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২০১৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত আশিকি-২ মুভির গান ‘তুম হি হো’ এবং ২০১৬ সালে মুক্তি প্রাপ্ত রয় মুভির গান ‘সুরাজ ডুবাহে ইয়ারো’এর জন্য ‘ফ্লিম ফেয়ার এওয়ার্ড’ পান । তিনি র্বতমানে অন্য অন্য দেশের মত বাংলাদেশেও ব্যপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ।
অরিজিৎ এর গান সমূহ
- অল ফর ওয়ান- হাই স্কুল মিউজিকাল ২
- ফির মহাব্বাত- মার্ডার ২
- ঝুম ঝুম -প্লেয়ারস
- রাবতা-এজেন্ট ভিনদ
- দুয়া- সাংহাই
- ঈয়ারিয়া- কক্টেইল
- ফির লে আয়া দিল ,সাওআলি সি রাত- বারফি
- এ খুদা- ১৯২০এভিল রিটার্নস
- খাল্বালি – ৩জি
- তুম হি হো, আসান নেহি ইয়াহা আশিক হো জানা, মিলনে হে মুঝছে আয়ি, হাম মার জায়েঙ্গে , চাহু মে ইয়া না- আশিকি ২
- দিল্লিওয়ালি গারলফ্রেন্ড, ইলাহি, কাবিরা – ইয়ে জাওয়ানি হে দিওয়ানি
- কাশ্মীর মে তু কানইয়া কুমারী – চেন্নাই এক্সপ্রেস
- হার কিসি কো – বস
- বেপারওয়া – শাহীদ
- তোছে ন্যায়না – মিকি ভাইরাস
- অ্যা দিল বাতা – ইশ্ক একচুয়ালি
- লাল ইশক – রাম লীলা
- পাল পাল- ক্লাব ৬০
- ধোঁকা ধারি – আর… রাজকুমার
- কাভি জো বাদাল বারসে – জ্যাকপট
- মন মাঝি রে- বস (বাংলা)
- কি করে তোকে বলব-রংবাজ(বাংলা)
- বেচে থেকে লাভ কি বল -রংবাজ(বাংলা)
- নাশেসি চার গায়ি – বেফিকরে
- বারিশ, ফিরভি তুমকো – হাফ গার্লফ্রেন্ড
- হাওয়ায়ে – জব হ্যারি মেট সেজাল
- পল – মনশুন শ্যুটআউট
- সাফার – জব হ্যারি মেট সেজাল
- তেরে বিনা – হাসিনা পার্কার
- সুবাহ সুবাহ – সোনুকে টিটু কি স্যুইটি
- তেরা ইয়ার হুঁ ম্যায়- সোনু কে টিটু কি সুইটি
- বিনতে দিল – পদ্মাবত
- বান্দেয়া – দিল জাঙ্গলি
- বোঝে না সে বোঝে না- বোঝে না সে বোঝে না
- সুরাজ ডুবাহে ইয়ারো- রয়