সৃষ্টিতে মানুষ, অন্যান্য অনেক প্রাণীর তুলনায় নিঃসন্দেহে উন্নত এবং অনন্য। মানুষ তার স্বতন্ত্র যেসকল গুণাবলির জন্য অন্যদের থেকে ভিন্নতর তার মধ্যে প্রেম অন্যতম। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রতিজন স্বাভাবিক পুরুষ এবং স্বাভাবিক নারী তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হন। এই আকর্ষণে প্রকৃতিগতভাবে প্রাণিজগতের অন্যসব প্রজাতির মতো যৌন আকাঙ্ক্ষাও থাকে। তবে মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এই আকাঙ্ক্ষার ধরন, অন্য প্রাণীর মতোন শুধুই যৌনতা কেন্দ্রিক নয়; সেখানে প্রেম থাকে, থাকে ভালোবাসা- যা মানুষের এই চাওয়াকে করে তোলে আরো বেশি শৈল্পিক, পবিত্র এবং আবেগময়।
বয়স এবং বিবেচনার মাপকাঠিতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং নারীর, আধুনিক পৃথিবীতে পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সংস্পর্শে যাওয়াটা অধিকাংশ রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে কোনো দন্ডনীয় অপরাধ নয়। কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব শুধুই যৌনতা দ্বারা তাড়িত হয় না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতোন দেশে- নারী পুরুষের সম্পর্কে অনেক চাওয়া থাকে। এখানে যৌথ জীবনের স্বপ্ন থাকে, বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সাথে আরো যোগ হয় প্রেম; যা ছাড়া বিবাহিত জীবনে সুখ অসম্ভব।
বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহ একটি অতি পবিত্র বিষয়। মূলত এখনো বিবাহই হচ্ছে এঅঞ্চলে এক জোড়া নারী-পুরুষের সম্পর্ক গড়ে দেবার স্বীকৃত স্বাভাবিক পন্থা। বিয়ের ক্ষেত্রে এখানে এখনো পরিবারের সমর্থনই মুখ্য। বর্তমানে যদিও প্রেম পরবর্তী বিয়েই বেশি দেখা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে, পরিবারও সেখানে মত দিয়েছে। পরিবারের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিবাহ এখনো সম্ভব নয়, আর সম্ভব হলেও এই রকম বিয়ে, পরিবার এবং সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না।
জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের বেলায় পারিবারিক বা ব্যক্তিগত- যে ভূমিকাই প্রধান থাকুক না কেন, সেখানে অনেকগুলো বিষয়ই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে ছেলের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য, ছেলের ক্ষমতা, মেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছেলে এবং মেয়ের পারিবারিক অবস্থান প্রভৃতি। তবে এসব ছাড়াও একটি বিষয় সব সময় বিয়ে বা সম্পর্ককে প্রভাবিত করে রাখে; তা হচ্ছে বয়স।
বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে সঙ্গীর বয়স সব সময় একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাবক হিসেবে থেকেই যায়। সত্যি বলতে, বয়সের অনেক দূরত্ব রয়েছে এমন মানুষের সাথে সাধারণত আমরা কেউ সম্পর্কের কথা ভাবিই না। যদিও এমন সম্পর্ক যে আমাদের সমাজে নেই তা কিন্তু নয়। খুজলে দেখা যাবে আমাদের অনেকের দাদা-দাদি, নানা-নানির বয়সের পার্থক্য অনেক বেশিই ছিলো। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় দ্বারা একটি সামাজিক পরিবর্তন সম্পাদিত হয়ে গিয়েছে এবং আমাদের মস্তিষ্কেও বিবাহিত দম্পতির বয়সের পার্থক্য কত হবে তার একটি মানদণ্ড ঠিক হয়ে আছে। তাইতো অধিকাংশ মেয়ে কোনো পুরুষকে স্বাভাবিক চিন্তায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার বেলায় তার বয়স নিয়ে দুই বার ভাবেন।
একই ভাবনা পুরুষদের মধ্যেও সমপরিমাণে থাকে। যদিও আমাদের দেশের পুরুষদের মধ্যে কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চাওয়ার ব্যাপক প্রবণতা দেখা যায়; কিন্তু সে বয়সের পার্থক্যেরও মোটামুটি একটা মানদণ্ড থাকে। আর নারীও চায় তার চেয়ে স্বামী বয়সে বড় হোক। তবে তা অনেক বেশি নয়। অন্তত জেনারেশনই আলাদা এমন কেউ মোটেও নয়। তাই হঠাৎ যখন আমরা বয়সে অসম কোনো দম্পতির কথা শুনি বা তাদের দেখি একটু অবাক হই।
বয়সে ছোটদের বিয়ে করার প্রবণতা শুধুমাত্র ছেলেদের মধ্যেই দেখা যায় না। এমন অনেক মেয়ে রয়েছে যারা নিজের চেয়ে বয়সে ছোট পুরুষদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়েন তারা নিশ্চই তাদের পরিচিতদের মধ্যে এমন প্রেমের খবর নিশ্চই শুনে থাকবে। এখানে গুণের প্রতি আকর্ষণ যেমন থাকে, তেমন থাকে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তাও। বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সাম্প্রতিক তার চেয়ে ১০ বছরের ছোট আমেরিকান গায়ক নিক জোনাসকে বিয়ে করেছেন। এখনো পর্যন্ত তারা সুখে শান্তিতে সংসার করছেন।
আবার কিছু নারী থাকেন যারা তাদের চেয়ে বেশি বয়সের ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হন। অনেক সময় পুরুষের গুণ, পুরুষের ব্যক্তিত্ত্ব কিংবা অন্য কোনো কিছু সেই নারীর মনে এমন মুগ্ধতা তৈরি করে যে তা থেকে সে আর বের হতে পারেন না। তখন সেই বয়সে অনেক বড় মানুষটাকেই তার ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, এমন আর কেউ হবে না।
এই বিষয়টির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা রানুর চিঠি। রবীন্দ্রনাথকে রানু চিঠি লিখেছিলেন যখন, তখন রানুর বয়স ১২। রবীন্দ্রনাথ তখন শুধুই ৫৭ বছরের নয়; তাঁর চুলে-দাঁড়িতে পাক ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন, দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা আমাকে দেখলে তুমি ভয় পাবে। রানু জবাব দিয়েছিলেন, আমার কাছে আপনার বয়স ২৭। কবিদের বয়স বাড়ে নাকি! তাছাড়া অতিসম্প্রতি বলিউডের নামকরা পরিচালক মহেশ ভাট ও রিয়া চক্রবর্তীর প্রেমের সম্পর্কের কথা সামনে এসেছে। অভিনেত্রী আলিয়া ভাটের বাবা ৭০ বছর বয়সী এই অভিনেতার সাথে তার চেয়ে ৪৪ বছর ছোট রিয়া চক্রবর্তী’র এই প্রেমও- বয়স বা সমাজের নিয়মকে তোয়াক্কা করে নাই।
আবার আসি সেই প্রেমের কথায়। প্রেমের এমন অদ্ভুত ক্ষমতা দেখা যায়, যার সাহসে মানুষ স্বাভাবিক নিয়মকে তোয়াক্কা না করে অনেক সময় এমন জীবনসঙ্গীকে বেছে নেন যা সচারাচর দেখা যায় না। প্রেমের প্রবল আকর্ষণ কাউকে কাউকে এমনভাবে ভেঙে দেয় যে তার কাছে ঐ মানুষটাই মুখ্য হয়ে ওঠেন, ঐ মানুষের মন বা বিশেষ কোনো গুণের প্রভাবে বয়সের ব্যবধান চিন্তা থেকে মুছে যায়। অসম বয়সের সম্পর্কও প্রেমের জন্য স্বাভাবিক হয়ে যায়, স্থায়ীভাবে টিকে থাকে।
এ সংক্রান্ত একটি ইতিবাচক উদাহরণ হচ্ছে চ্যাপলিন। ওনা ও’নীলকে বিয়ে করার আগে চ্যাপলিন তিনটি বিয়ে করেছিলেন। তার একটি বিয়েও টেকেনি। সবগুলোই দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ভেঙে যায়। অনেকে বলে থাকেন, চ্যাপলিনের এই বিয়ে ও সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার কিছুই বলতে গেলে ছিলো না। চ্যাপলিনের খ্যাতি আর অর্থবিত্তের প্রতিই তাঁদের টান ছিলো বেশি। ৫৪ বছর বয়সে চ্যাপলিনের সঙ্গে যখন তাঁর চতুর্থ স্ত্রী বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নীলের কন্যা ওনা ও’নীলের পরিচয় হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। এই ৩৭ বছর বয়সের ব্যবধান নিয়েই বিয়ে করেন দু’জন। এ সংসার আর ভেঙে যায়নি। এরপর ৮৮ বছর বয়সে চ্যাপলিন যখন মারা যান, তখন চ্যাপলিনকে ঘিরে রেখেছিলেন এই ওনা, তাঁদের আট সন্তান ও নাতি-নাতনিরা। এই অসম সম্পর্কের একটি জবাব ছিল মেয়েটির কাছে। তিনি বলতেন, ‘আমি চ্যাপলিনকে তরুণ করেছি আর চ্যাপলিন আমাকে করেছে পরিপক্ব। এভাবেই আমরা দু’জন কাছাকাছি এসেছি।
আবার আমাদের দেশে এমন অনেক ছেলে আছে যারা নিজেদের চেয়ে বয়সে বড় মেয়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বেশি আগ্রহী হয়। কিছু পুরুষ সমবয়সীর চেয়ে তার চেয়ে বয়সে বড় নারীদেরকেই সঙ্গী হিসেবে যোগ্য মনে করেন। এক্ষেত্রে সৌন্দর্যবোধ এবং মানসিক পরিপক্কতা একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মেয়েরা যতো বড় হন, তারা নিজেকে ততো বেশি সুন্দর করে প্রকাশ করা শেখেন। এছাড়াও তাদের বিবেচনা বা অন্য কোনো গুণ দ্বারাও ছেলেরা মোহিত হয়ে পড়তে পারেন যার পরিণতি হিসেবে বিবাহের সূচনা হয়।
খেয়াল করলে, নামি বা কমনামি মানুষের এমন অসংখ্য অসম সম্পর্ক আমরা দেখতে পাবো। তবে সম্পর্কগুলো টিকে থাকবে, কি থাকবে না- এটা এই ধরনের বিয়ে পরবর্তী একটা জোরালো আলোচনার বিষয় হয়ে যায়। বয়সের বেশি ব্যবধান হওয়া মানে একজন তার বয়সের জেষ্ঠতায় সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করবেন বলে ধরে নেওয়া হয়। এছাড়া বেশি বয়সের পার্থক্য মানে দুইজন মানুষ দুইটি আলাদা সময় বা জেনারেশনকে ধারণ করেন। ফলে তাদের বোঝাপড়া কতটা মিলবে তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। তবে একেবারে নিম্ন মানসিকতার আরেকটা ধারণা, প্রকাশ না করলেও অনেকের মনেই তা এসে উপস্থিত হয়।
সেটা হচ্ছে এই দম্পতির যৌন জীবন। কিছু মানুষ ভাবেন- মেয়েটা অর্থ কিংবা যশের লোভে তার অন্যান্য সুখ উপেক্ষা করে এই বিয়েটা করেছেন; নিশ্চই কোনো স্বার্থ রয়েছে ইত্যাদি। তবে অধিকাংশের চোখই যেটা এড়িয়ে যায় তা হচ্ছে ভালোবাসা। হ্যা! এটা সত্য যে অনেক ক্ষেত্রে অর্থকড়ির লোভ থাকে। কিন্তু সেসব বিশেষ ঘটনাকে উদাহরণ করে সামগ্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও উচিত নয়। প্রত্যেক মানুষ এক-একটি স্বতন্ত্র স্বত্ত্বা ধারণ করেন। তাই আমাদের চিন্তা, আমাদের প্রেমের ধরন, আমাদের ভাবনার পদ্ধতি সবারই যে একই রকম হবে এমনটা নয়। যার যার চিন্তা দ্বারা সে সে পরিচালিত হয়ে থাকেন। আর এই চিন্তারই একটা স্তর প্রেম; যে প্রেমের বিশালতায় বয়স কিংবা অন্যকোনো পার্থক্যকে যৌথ জীবন গড়ার ক্ষেত্রে আর বাঁধা মনে হয় না। তখন বয়সকে মনে হয় শুধুমাত্র একটি সংখ্যা।
মন্তব্য লিখুন