জোকার বলতে ভাড় বোঝালেও আমরা প্রায় সকলেই জোকার নামটি শুনলে ডিসি কমিক্সের জনপ্রিয় খলচরিত্র বা ভিলেন জোকারের কথাই মাথায় এনে ফেলি।
কমিকবুক ফ্যান বা টিভি সিরিজ ফ্যান অথবা লাইভ একশন মুভি ফ্যান সকলের কাছেই জোকার চরিত্রটি অনেক আকর্ষণীয় এবং পছন্দের।
আপনি ডিসি কমিক্স এর ফ্যান হন বা মারভেল কমিক্স এর, জোকার চরিত্রটি আপনার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবেই। ডিসি কমিক্সের অন্যতম জনপ্রিয় সুপারহিরো ব্যাটম্যানের আর্চ এনিমি বা চির শত্রুর নাম হলো জোকার।
জোকার চরিত্রের আগমনও ঘটে ব্যাটম্যান কমিক ইস্যু-১ থেকে ১৯৪০ সালে “ব্যাটম্যান” নামে এই কমিক সিরিজটি বের হয়। এই কমিক ইসুতেই জোকারের বিকৃত মনস্তাত্ত্বিকতা এবং নিষ্ঠুরতার সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
জোকার চরিত্র টি সৃষ্টির পেছনে অবদান রয়েছে বব কেন, বিল ফিঙ্গার এবং জেরি রবসনের।
মূলত তারা এই চরিত্রের অনুপ্রেরনা নিয়েছিলো ১৯২৮ সালে মুক্তি পাওয়া ভিক্টর হুগোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা “দ্যা ম্যান হু লাফস” এর একটি চরিত্র থেকে। এভাবেই জোকার চরিত্রটির সৃষ্টি হয়।
“দ্যা ম্যান হু লাফস” সিনেমার প্রধান চরিত্র গুইনপ্লেইন;যার থেকে অনুপ্রানিত হয়ে জোকার চরিত্রের সৃষ্টি হয়।
১৯৪০ সালে জোকার এর সৃষ্টি হলেও জোকারের অরিজিন কখনো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেনি ডিসি কমিক্স। বেশ কিছু কমিক্স এ তার অরিজিন স্টোরি বা তার জোকার হয়ে ওঠার গল্প ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখানো হয়েছে।
জোকার তার নিজের অতিত সম্পর্কেই বলেন -“অতীত যদি থাকতেই হয়,আমি চাই আমার পছন্দ করে নেওয়ার মতো একাধিক অতীত”১৯৮৮ সালে এলান মুর তার লেখা “দা কিলিং জোক” কমিক বইয়ে জোকারের অতীত জীবনের কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন ।
THE KILLING JOKE:এই কমিক বইটিতে জোকারের আসল নাম জ্যাক হিসেবে জানানো হয়। জ্যাক একটি রাসায়নিক কারখানায় অল্প বেতনে চাকরি করতো । কিন্তু সে স্ট্যান্ড আপ কমিডিয়ান হওয়ার সপ্ন দেখতো । এজন্য সে কারখানার চাকরি ছেড়ে দেয় এবং কমিডিয়ান হয়ে কাজ শুরু করে।
কিন্তু মানুষকে হাসানোর দক্ষতার অভাবে সে কমিডিয়ান ক্যারিয়ারে চরম ব্যর্থ হয় তার। আর্থিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়। তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে চিকিৎসা করানোর মতো টাকাও তার কাছে থাকে না।
এসব নিয়ে চরম হতাশায় জ্যাক এক বারে বসে থাকার সময় পরিচয় হয় দুই ডাকাতের সাথে,এই ডাকাতেরা আগের থেকেই জ্যাক এর পুরাতন কাজ করার জায়গায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করছিলো।
তারা তখন জ্যাক কে তাদের এই ডাকাতিতে যুক্ত হতে বলে,জ্যাক তার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে রাজী হয়ে যায়।
ডাকাতেরা খুশি হয় কারণ জ্যাক কারখানার সব বিষয় সম্পর্কে অনেক ভালো জ্ঞাণ রাখে । অপর একদিন ডাকাত দুজন ও জ্যাক যখন ডকাতির পরিকল্পনাইয় মগ্ন তখন জ্যাক খবর পায় তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। জ্যাকের জীবন যেনো অন্ধকারে ছেয়ে যায় ।
সে তখন ডাকাত দের কে জানায় যে, সে আর এই ডাকাতিতে তাদের সাথে থাকতে চায় না । কিন্তু ডাকাতরা তখন তাকে বাধা দেয় এবং এই ডাকাতিতে তাদের সাথে না থাকলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ায়র হুমকি দেয়। তখন জ্যাক রাজি হতে বাধ্য হয় । সেই রাতে তারা রাসায়নিক কারখানায় ডাকাতি করতে যায় ।
কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত কিছুদিন যাবত কারখানার নিরাপত্তা দিগুন করা হয়েছিলো, তারা যখন কারখানার ভিতরে ডাকাতি করতে যায় তখন নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে।
জ্যাক বাদে বাকি দুইজন গুলিতে মারা যায়। জ্যাক ভীত হয়ে রাসায়নিক পদার্থ রাখার বড় বড় পাত্র গুলোর দিকে ছুটতে থাকে ।
তখন কারখানায় ব্যাটম্যান এর আগমন ঘটে, ব্যাটম্যান নিরাপত্তা কর্মীদের গুলি চালাতে নিষেধ করে এবং নিজে আচমকা জ্যাক এর সামনে চলে আসে ।
জ্যাক বিচলিত হয়ে পিছু হটতে যেয়ে পড়ে যায় তীব্র রাসায়নিক পদার্থ মেলানো বড় একটি পাত্রে , এই পাত্রের সাথে যুক্ত এক অপসারন নলের মধ্য দিয়ে সে এক নদীর পাড়ে এসে পড়ে।
নদীতে যখন তার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়ে, তখন দেখতে পান রাসায়নিক পদার্থের তীব্রতা তার গায়ের চামড়া মৃত ব্যাক্তির মতো সাদা করে দিয়েছে ।
চুলের রং সবুজ হয়ে গেছে আর ঠোটের রং অতিরিক্ত লাল। স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুশোক আর আকস্মিক ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং কান্না করতে থাকে। জ্যাক কান্না করতে করতে কান্না অট্টহাসিতে পরিনত হয়ে যায়। এই অট্টহাসি থামার নয় ,জ্যাক পরিনত হয় জোকারে ।
“দা কিলিং জোক” বইটিতে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে জোকারের উত্থানের গল্প। এই বইটির উপর ভিত্তি করে ২০১৬ সালে “ব্যাটম্যান: দা কিলিং জোক” নামে একটি এনিমেশন মুভি বের করে ওয়ারনার বরষ। যদিও এই অরিজিন টিকেও অফিশিয়াল অরিজিন হিসেবে ধরা হয় না।
কমিকবুক বাদেও বিভিন্ন সময় এনিমেশন সিরিজে বা লাইভ একশন মুভিতে আমরা জোকারের দেখা পেয়েছি । বিভিন্ন মুভিতে একটু ভিন্ন ভাবে জোকার কে দেখানো হলেও সকল ক্ষেত্রেই জোকারের মূল বৈশিস্ট একই রখম রাখা হয়।
কমিকে বা সিনেমায় সবখানেই জোকারকে তুলে ধরা হয়েছে স্যাডিস্টিক সেন্স অফ হিউমার বিশিষ্ট এক বিকৃত মানসিকতার মানুষ হিসেবে।
বাহ্যিক কোনো সুপার পাওয়ার না থাকলেও, জোকার অনেক বুদ্ধিসম্পন্ন একজন ভিলেন। জোকারের ইচ্ছা হলো ব্যাটম্যানকে তার আদর্শ থেকে সড়িয়ে আনা।
চলুন বিভিন্ন সময় ছোট স্ক্রিনে বা লাইভ একশন মুভিতে জোকার চরিত্রকে কিভাবে দেখানো হয়েছে জেনে আসি;
Batman 66’: ১৯৬৬ সালে প্রথম বারের মতো জোকারকে সিনেমাটিক রুপ দেয়া হয়। এই মুভিতে অভিনয় করেন সিজার রোমারিও। মুভিতে জোকার সম্পর্কে বলা হয়েছিলো তিনি ছিলেন একজন মনস্তত্ত্ববিদ ।
পরে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ,গোথামের অন্যান্য ভিলেনদের সাথে মিলে গোথাম ধংসের পরিকল্পনা করেন। এই মুভিতে চরিত্রটিকে তেমন ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়নি ।
Batman 89’: ১৯৮৯ সালে বের হওয়া এই সিনেমাটিতে জোকার হিসেবে অভিনয় করেছিলেন অস্কার জয়ী জ্যাক নিকলসন । জ্যাক নিকলসন ছোট বেলা থেকেই জোকার চরিত্রের ভক্ত ছিলেন । জ্যাক নিকলসন তার অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক দের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
এই সিনেমায় দেখা যায় জ্যাক নেপিয়ার নামক একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত গ্যাং স্টার। যিনি ব্রুস ওয়েন (ব্যাটম্যান) এর পিতামাতাকে খুন করে ,গোথামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়।
এক দুর্ঘটনায় তার চেহারার বিকৃতি ঘটে এবং তিনি জোকারের মতো বেশ ধরা শুরু করেন । এরপর থেকে জোকার নামে পরিচিত হন।
The Dark Knight (2008): ক্রিস্টোফার নোলানের ডারক নাইট ট্রিলজির ২য় সিনেমা ছিলো এটি। এই মুভিতে জোকার হিসেবে অভিনয় করেন হিথ লেজার ।
তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নিজেকে একটি হোটেল রুমে ২ মাস বন্দী করে রেখে ছিলেন। অনেকের কাছে হিথ লেজার এর অভিনিত জোকার বড় পর্দায় অভিনিত শ্রেষ্ঠ জোকার ।
আরো পড়ুনঃ জনি ডেপ চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
এই মুভিতে দেখা যায় জোকার ব্যাটম্যানকে তার আদর্শ হতে সড়ীয়ে নিতে চায় ,দেখাতে চায় যে ব্যাটম্যান আর জোকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই ।
জোকার আরো প্রমান করতে চায় যে, ভালো মানুষরা সবাই ভালো মানুষের ভান ধরে আছে, কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লেই মানুষের আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।
এই কমিক চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার পাওয়া প্রথম অভিনেতা হন হিথ লেজার।
এই চমৎকার সিনেমাটি দেখতে বোরিং লাগবেনা একমুহূর্তও ।আর স্পার হিরো ফ্যানদের কাছে সিনেমাটি একটি মাস্টার পিস।
Joker(2019): ২০১৯ সালে বের হওয়া সিনেমাটিতে জোকার হিসেবে অভিনয় করেছেন জোয়াকিন ফিনিক্স। এই মুভিটিতে জোকারের এক ভিন্ন গল্প দেখানো হয়েছে । সিনেমাটি পুরোই আরথার ফ্লেক নামক এক ব্যাক্তির জোকার হয়ে উঠার কাহিনি নিয়ে তৈরি । মানসিক সমস্যায় ভোগা একজন কমেডিয়ান আরথার ফ্লেক ।
যে সমাজের মানুষ দাড়া সবসময় নিপীড়িত । পারিবারিক সমস্যা ,সমাজের তার সাথে ব্যবহার ,সব কিছু তাকে মানসিক এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে সে জোকারে পরিনত হন ।
পুরো কাহিনী জানতে হলে সিনেমাটি দেখে নিন । এই সিনেমার জন্য জোয়াকিন ফিনিক্স অস্কার জিতেছেন।
MARK HAMIL: এখানে মুভির নাম না দিয়ে একজন মানুষের নাম দেয়ার কারণ হচ্ছে ,মারক হ্যামিল নামক এই ব্যক্তি একাধারে বিভিন্ন এনিমেটেড সিরিজ এবং এনিমেটেড মুভিতে জোকারের ভয়েস দিয়েছেন ।
এছাড়াও তিনি ব্যাটম্যন আরকাহাম সিরিজের গেমগুলায় জোকারের ভয়েস দিয়েছেন । ভয়েস এক্টর হিসেবে জোকার এর ভয়েস দিয়ে প্রচুর পরিমান খ্যাতি লাভ করেছেন এই ভয়েস এক্টর।
এছাড়া সুইসাইড স্কোয়াডে জ্যারেড লেটো জোকার হিসেবে অভিনয় করেছিলেন । তার স্ক্রিনটাইম অনেক কম থাকায় তাকে নিয়ে লেখলাম না।
“All it takes is one bad day to reduce the sanest man alive to lunacy.
That’s how far the world is from where I’m… Just one bad day”.
বাস্তবেও অনেক ক্ষেত্রে উক্তিটি সত্য বলে মনে হয়। একটা খারাপ দিনই মানুষের জীবন পালটে দিতে পারে । ভালো মানুষকে বানিয়ে ফেলতে পারে মানসিক ভারসাম্যহীন অপরাধী হিসেবে।
“Hahaha! Jokes on you!”
মন্তব্য লিখুন