কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের নাম আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এ নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণারও কোনো অন্ত নেই। কিছুদিন আগেই বিজ্ঞানীরা একটি ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে ফেলেছিলেন। কিন্তু আজ আমরা আলোচনা করবো শ্বেত গহ্বর বা হোয়াইট হোলে নিয়ে।
শ্বেত গহ্বর কি?
শ্বেত গহ্বর কি তা জানতে হলে আগে কৃষ্ণ গহ্বর কি তা জানা প্রয়োজন। কৃষ্ণ গহ্বর হলো এমন এক মহাজাগতিক বস্তু যেখানে ক্ষুদ্র আয়তনে বিশাল ভর কেন্দ্রিভূত থাকে। এই বিশাল ভরের কারনে এখানে মহাকর্ষ বলের প্রভাব থাকে অত্যধিক বেশি। তাই এর ঘটনা দিগন্তের সীমার মধ্যে আসা যেকোনো বস্তু এরা শোষণ করে নেয় এবং এর আকর্ষণ থেকে আর কোনো কিছুই এমনকি আলোও আর বের হয়ে আসতে পারে না। আর যেহেতু কোনো আলোও এটি নির্গত বা প্রতিফলিত করে না শুধুই শোষন করে তাই এটিকে ব্ল্যাক হোল বলা হয়।
এখন, অনেকের মাথায়ই এই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ব্ল্যাক হোল দ্বারা শোষিত এই বিশাল ভরের বস্তুগুলো আসলে কোথায় যায়? কৃষ্ণ গহ্বর আলোর ফোটন কণা সহ সব কিছু গ্রাস করে, তাই একে কালো দেখায়। কিন্তু এই এত সব ভর তো কোথাও বেমালুম হারিয়ে যেতে পারে না! এগুলোর সন্ধানেই শ্বেত গহ্বর ধারণার জন্ম।
ধারণা করা হয়, ব্ল্যাক হোল দ্বারা শোষিত এই বিশাল ভর অতি ক্ষুদ্র আয়তনে কেন্দ্রীভূত হয় যা, স্থানকালের চাদরে একটি হোল বা সুড়ঙ্গ তৈ্রি করে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে উক্ত ভর সম্পূর্ণ অন্য একটি স্থানে নিঃক্ষেপিত হয় (এমনকি ভিন্ন কালেও হতে পারে!)।
কৃষ্ণ গহ্বর যেমন সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়, শ্বেত গহ্বর থেকে ঠিক তেমনি সবকিছু তীব্র বেগে নির্গত হয়ে যায়। ঠিক যেন বিপরীত। অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল সম্পূর্ণ অন্ধকার হলেও এর বিপরীত পাশ তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে, ফলে এটি আলোকোজ্জ্বল হতে পারে। আর তাই একে শ্বেত গহ্বর বা হোয়াইট হোল নামকরণ করা হয়।
শ্বেত গহ্বর ধারণার জন্ম
শ্বেত গহ্বর ধারণার পথিকৃৎ হিসেবে প্রথমেই যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ ও গণিতবিদ কার্ল শোয়ারজশ্চাইল্ড ও বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক, নোবেলজয়ী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইন-শোয়ারজশ্চাইল্ড তত্ত্বেই মূলত ব্ল্যাক হোলের ধারণা পাকাপোক্ত হয়। আর ঠিক এসময়েই ব্ল্যাল হোলের ক্ষুদ্রায়তন কেন্দ্রবিন্দুতে যেখানে বিশাল ভর জমা হয় সেখানে স্থান-কালের চাদরে ছিদ্র হওয়ার ধারনা পোষণ করেন বিজ্ঞানীরা। পরবর্তীতে এই ছিদ্র ওয়ার্ম হোল নামেও পরিচিতি পায়।
তাদের ধারণা মতে এই ওয়ার্ম হো্ল স্থান-কালের চাদরে এক সুড়ঙ্গের ন্যায় সৃষ্টি করে যেখান দিয়ে ব্ল্যাক হোল দ্বারা শোষিত সমস্ত ভর পরিবাহিত হয়। কিন্তু এই সুড়ঙ্গ তো আর অসীম হতে পারে না। তাই সুড়ঙ্গের শেষ যেখানে হয় সেখানেই সমস্ত শোষিত ভর সবেগে নিঃক্ষিপ্ত হয়। আর সুড়ঙ্গ যেহেতু স্থান-কালের চাদরে তাই এই ওয়ার্ম হোল ভরসমূহকে নিশ্চয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্থান ও কালেও নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে। আর এই ধারণা থেকেই শ্বেত গহ্বর ধারণার জন্ম।
এছাড়াও শোয়ারজশ্চাইড তার যে গাণিতিক সমস্যার ধণাত্বক সমাধানের জন্য ব্ল্যাক হোলের ব্যাখ্যা চমৎকার ভাবে দিয়েছেন সেখানেই সেই সূত্রের ঋণাত্বক সমাধানও সম্ভব। এক্ষেত্রে ঋণাত্বক উত্তরের ব্যাখ্যা কি হবে তা ভাবতে গেলে ব্ল্যাক হোলের বিপরীত কিছুর ব্যাখ্যাই প্রথমে মাথায় আসে। আর এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সবচেয়ে জনপ্রিয় উত্তর হয়তো হোয়াইট হোল।
শ্বেত গহ্বর কি শুধুই তাত্ত্বিক?
শ্বেত গহ্বরের পক্ষে যতই গাণিতিক যুক্তি শক্ত হোক না কেন, এর বাস্তব অস্তিত্ত্ব কিন্তু এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। কেউ, এমনকি এত এত শক্তিশালী টেলিস্কোপও আজ পর্যন্ত কোনো হোয়াইট হোলের হাদিস পায় নি। তা ছাড়াও এই তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতাও পাওয়া যায়। এখন জানবো সেগুলো কি।
ধরা যাক, ব্ল্যাক হোলে পতিত ভরসমূহ ওয়ার্ম হোল দিয়ে গিয়ে অন্য মহাবিশ্বে গিয়ে পতিত হয়। ফলে সেই মহাবিশ্বের ভর বৃদ্ধি পাবে এবং এই মহাবিশ্বের ভর ক্রমেই হ্রাস পাবে। কিন্তু শক্তির সংরক্ষন নীতি অনুযায়ী এটি কখনোই সম্ভব না। কারন এই নীতি অনুসারে মহাবিশ্বের ভরের কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। তাই এক মহাবিশ্বে ভরের ক্রম সংকোচন ও অন্য মহাবিশ্বে ভরের ক্রম প্রসারন কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়।
আরও পড়ুনঃ
মহাকর্ষীয় লেন্সিং কি? মহাকর্ষীয় লেন্সিং থেকে ডার্ক ম্যাটারের খোঁজ
ব্ল্যাক হোল -মহাজাগতিক বস্তুর এক বিস্ময়কর জগৎ
এভিলিন ম্যাকহেল: যার মৃত্যুকে বলা হয় ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা!
আরো কিছু কথা
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে যে ‘বিগ ব্যাং’ কি তাহলে এরকমই কোনো শ্বেত গহ্বর ছিল, যেখান থেকে আমাদের এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি? এই প্রশ্নের যুক্তি আছে। কারন হোয়াইট হোলের বৈশিষ্ট্য সমূহের সাথে ‘বিগ ব্যাং’এর যে ধর্ম আমরা জানি তা বহুলাংশেই মিলে যায়। সেক্ষেত্রে বলা যায় আমাদের মহাবিশ্বের ভরসমূহ সময়ের সাথে সাথে নবায়িত হয় এবং আমরা একটি চক্রের মধ্য দিয়ে পুনঃপুনঃ আবর্তিত হচ্ছি।
আবার অনেকে শক্তির সংরক্ষনশীলতা নীতির সাথে মিলাতে গিয়ে বলছেন হোয়াইট হোল কোনো ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বে ভরকে নিঃক্ষেপ করে না, বরং ওয়ার্ম হোল এমন দুটি স্থানকে সংযুক্ত করে যারা মূলত একই মহাবিশ্বের অংশ। বর্তমানে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে, ব্ল্যাক হোলের কোয়াসারগুলো হতে পারে হোয়াইট হোল।
পরিশেষে
এত কিছুর পরেও বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেমে নেই। শ্বেত গহ্বরের রহস্য উন্মোচণের চেষ্টায় মহাবিশ্বের আরো অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে। জানা যাচ্ছে মহাবিশ্বের আরো অনেক রহস্যময় দিক। এটির সমাধান করতে গিয়ে স্থান-কালের নতুন নতুন মডেল প্রস্তাবিত হচ্ছে।
যদিও শ্বেত গহ্বর সত্যিই আছে কি নেই এর পরিপূর্ণ উত্তর মানুষের কাছে এখনো অজানাই রয়ে গেছে তবুও এবিষয়ে গবেষণা মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সাথেই হয়তো জড়িয়ে আছে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল রহস্য!
তথ্য সূত্রঃ
- https://bn.quora.com
- https://bn.wikipedia.org