বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানী সংকট। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবচেয়ে ভালো, পরিবেশ-বান্ধব এবং সবদিক থেকে নিরাপদ সমাধান হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। নবায়নযোগ্য শক্তির নতুন প্রযুক্তি হলো ভাসমান সান ট্র্যাকিং সোলার প্যানেল।
জ্বালানী সংকট থেকে উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত – পৃথিবীর কোন দেশই মুক্ত নয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের দেখিয়েছে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণে জ্বালানী সংকট কতটা তীব্র হতে পারে।
জীবাশ্ম ভিত্তিক জ্বালানী ব্যবস্থা, অর্থাৎ খনিজ তেল ও গ্যাস একদিকে জলবায়ু দূষণ তো করছেই, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্যদিকে দিনকে দিন এইসব ভূ-গর্ভস্থ জ্বালানীর মজুদও কমে আসছে। ফলে যেসব দেশের কাছে তেল ও গ্যাসের মজুদ বেশী তারা এই জ্বালানীকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে নানারকম রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ারও চেষ্টা করে থাকে।
সৌর বিদ্যুৎ -জ্বালানী সংকটের কার্যকর সমাধান
জ্বালানী সংকটের এই সময়ে সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ। মাটির নিচে থাকা তেল ও গ্যাস এক সময় ফুরিয়ে যাবে, খুব বেশী দিন আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু আকাশে দেদিপ্যমান এই সূর্য খুব দ্রুত নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানী হিসাবে সৌর বিদ্যুতের চেয়ে ভালো আর কোন বিকল্প হয় না।
পৃথিবীর বহু দেশেই বর্তমান জ্বালানী সংকটের মোকাবেলায় এবং ভবিষ্যতের জ্বালানী ব্যবস্থা হিসাবে সৌর বিদ্যুৎ ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। উন্নত বিশ্ব তো বটেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। আমাদের দেশে ধীরে হলেও বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল: স্থান সমস্যার সমাধান
সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো স্থান সংকট। সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের জন্য বিশাল আকারের খোলা স্থান প্রয়োজন হয়।
ইউরোপের বিভিন্ন ছোট ছোট দেশের মত বাংলাদেশেও ভূমির অপর্যাপ্ততা একটি বড় সমস্যা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সোলার প্যানেল স্থাপনের মত প্রচুর খালি জমি পাওয়া একদিকে কঠিন, অন্যদিকে এর ফলে চাষযোগ্য আবাদী জমি হ্রাস পায় এবং বনাঞ্চলও বিনষ্ট হয়।
তবে আশার কথা হচ্ছে এই সমস্যারও সমাধান পাওয়া গেছে। বড় আকারের ও অধিক সংখ্যক সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য বর্তমানে অনেক দেশেই পানির উপর ভাসমান সোলার প্যানেল স্থাপন করা হচ্ছে। বড় জলাধার, লেক বা উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের ভাসমান সোলার প্যানেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
এই আর্টিকেলে আমরা এমন একটি বিশেষ সোলার প্যানেল নিয়ে আলোচনা করবো, যা এর চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। নেদারল্যান্ডর দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের Oostvoornse Meer নামক লেকে স্থাপন করা গোলাকৃতি এই ভাসমান সোলার প্যনেলটি সাধারণ কোন ভাসমান সোলার প্যানেল নয়। প্রাচীন গ্রীসের সাগর দেবতা প্রোটিয়াসের নামে নামকরণ করা এই বিশেষ সোলার প্যানেলটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন একটি ঝলমলে ভাসমান দ্বীপ।
সান ট্র্যাকিং ভাসমান সোলার প্যানেল
এই ভাসমান সোলার প্যানেলটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর সাথে সমন্বয় করা হয়েছে সূর্য-অনুসরণকারী প্রযুক্তি (Sun Tracking Technology- সান ট্র্যাকিং প্রযুক্তি) । এই প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমাণ পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এই প্রযুক্তিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সূর্যের সাথে সাথে প্যানেলটিও নির্ভূলভাবে দিক পরিবর্তন করতে থাকে, সূর্য আকাশের যে দিকেই যাক না কেন প্যানেলগুলো তাকে অনুসরণ করে এবং সূর্য থেকে সর্বাধিক পরিমান রশ্মি আহরণ করার চেষ্টা করে।
SolarisFloat নামের একটি ডাচ কোম্পানী কর্তৃক নির্মিত নবায়নযোগ্য শক্তির এই অত্যাধুনিক স্থাপনায় রয়েছে মোট ১৮০টি চলনশীল (movable) সোলার প্যানেল, যার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৩ কিলোওয়াট (kWp)। এই ভাসমান সৌর শক্তি স্থাপনা প্রোটিয়াস হলো সূর্য-অনুসরণকারী প্রযুক্তির সাথে ভাসমান সৌর প্যানেলকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বে এ ধরনের প্রথম প্রকল্প।
SolarisFloat এর মতে ভূমির উপর স্থাপিত প্যানেলের তুলনায় ভাসমান সৌর প্যানেলের মাধ্যমে ৪০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন অধিক হয়। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা এবং কীভাবে এটি পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে নিয়ে তা গবেষণা করার জন্য পাইলট প্রকল্প হিসাবে SolarisFloat এই ভাসমান সৌর প্যানেল প্রোটিয়াস তৈরি করেছে।
প্রোটিয়াসের একক-পার্শ্বযুক্ত প্যানেলগুলি প্রতি কয়েক ঘণ্টায় দুটি অক্ষে ধীরে ধীরে ঘোরে – যান্ত্রিক, ভূ-স্থানিক এবং আলোক সেন্সর ব্যবহার করে সূর্যের পথের উচ্চতাকে সঠিকভাবে অনুসরণ করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দিক পরিবর্তন করে।
সৌর প্যানেলের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এখন নতুন নতুন নানান কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে – সূর্যমুখী ফুল যেমন দিনের বেলায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে সূর্যকে অনুসরণ করে, সেভাবে আকাশে সূর্যের পথ অনুসরণ করার জন্য প্যানেলগুলোকে সূর্যের দিকে কাত করা হয়। এই কৌশলের মূল বিষয়টি হচ্ছে ট্র্যাকিং প্রযুক্তি (Tracking technology)। ইতিমধ্যে কিছু ভূমি ভিত্তিক সৌর প্যানেলে এই কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্যানেলগুলো ক্রমাগত সূর্যের মুখোমুখি হয়ে সমন্বয় করে থাকে।
ভাসমান সৌর প্যানেলগুলি পানির উপর ভেসে থাকা ও ঘোরাফেরা করায় তার শীতল প্রভাবের কারণে তারা অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন করে। সৌর প্যানেল সূর্য থেকে আলোর রশ্মি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে – সূর্যের তাপ থেকে নয়। কিন্তু বেশি গরম হয়ে গেলে তাদের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এর কারণ হল অতিরিক্ত তাপ প্যানেলের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে তোলে, উচ্চ শক্তি এবং বিশ্রাম অবস্থার মধ্যে সময়কে কমিয়ে আনে, যার ফলে ভোল্টেজ এবং উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ হ্রাস পায়।
সৌর প্যানেলগুলি (solar photovoltaic PV) সাধারণত ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে সর্বোচ্চ দক্ষতায় কাজ করে। ভাসমান সোলারের ক্ষেত্রে পানির সান্নিধ্য থাকায় তা প্যানেলগুলিকে আরও দক্ষতার সাথে কাজ করতে সাহায্য করে এবং তাদের বিদ্যুতের উৎপাদন ১৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি করে।
Solar Energy Research Institute of Singapore (Seris) এর এক গবেষণা অনুসারে, সূর্যকে অনুসরণ করে এমন উভয়-পার্শ্বযুক্ত (Double-sided) প্যানেলগুলি ৩৫% শক্তি উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং প্রচলিত সিস্টেমের তুলনায় বিদ্যুতের গড় খরচ ১৬% কমাতে পারে। এই দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে ২০২২ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে সৌর প্যানেলের জন্য ট্র্যাকিং প্রযুক্তির চাহিদা প্রতি বছর ১৬% বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সৌর শক্তির বিপ্লব : ভবিষ্যত শক্তির উৎস
ব্রাজিলের অ্যামাজন থেকে শুরু করে জাপান পর্যন্ত পৃথিবীর বহু দেশেই ভাসমান সোলার প্যানেল খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এক দশকে এই প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ব্যাপকভাবে, ২০১৫ সাথে যা ছিল মাত্র ৭০ মেগাওয়াট, ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৩০০ মেগাওয়াটে! আগামী এক দশকে আশা করা হচ্ছে এই প্রযুক্তির বাজার বৃদ্ধি পাবে প্রায় ৪৩% এবং ২০৩১ সাল নাগাদ তা ২৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
Seris এর প্রধান নির্বাহী থমাস রিন্ডল বলেন, ‘‘নবায়নযোগ্য শক্তিগুলোর মধ্যে ভাসমান সোলার পদ্ধতি নতুন হলেও এর সম্ভাবনা অনেক বেশী।” Seris এর এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষ নির্মিত সব জলাধারের মাত্র ১০ ভাগও যদি এই ভাসমান সোলার পদ্ধতির আওতায় আনা হয় তাহলে তা দিয়ে ২০ টেরাওয়াট (TW) বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, যা বর্তমানে সারা বিশ্বের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অন্তত ২০ গুণ অধিক হবে।
বৈশ্বিকভাবে গত এক দশকে সৌর বিদ্যুৎ সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২ গুণ, ২০১১ সালে ৭২ গিগাওয়াট থেকে বেড়ে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৪৩ গিগাওয়াট (GW)। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রযুক্তি সারা বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৩.৬%, ২০০৬ সালে যা ছিল আরও অনেক কম, মাত্র ০.০৩%।
বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানো এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্যই সৌর শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সিংগাপুর ও জাপানে ভূমি স্বল্পতা থাকায় ভাসমান সোলার পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সীর মতে ২০৩০ সাল নাগাদ দূষণ নির্গমণ (net zero emission) শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য সৌর শক্তির সক্ষমতা অন্তত ৬ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনেতিক কারণেও সৌর শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল-গ্যাস সরবরাহ নিয়ে সারা বিশ্বে যে বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছে
ভাসমান সোলারের পরিবেশ বান্ধব উপযোগীতা
ভাসমান সোলারের সাথে ট্র্যাকিং প্রযুক্তিকে যুক্ত করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে তা থেকে আরও কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। ভাসমান সোলার বাষ্পীভবন কমাতে সাহায্য করে এবং বিষাক্ত দূষণের বিস্তার রোধ করতে পারে। ভাসমান সৌর স্থাপনাগুলি সূর্য থেকে পৃষ্ঠকে রক্ষা করে পানির তাপমাত্রাকে ঠান্ডা করে। এটি নীল-সবুজ শেত্তলাগুলির বিষাক্ত ফুলের বৃদ্ধিকে বাঁধা দেয়, যা উষ্ণ পানিতে বিস্তার লাভ করে এবং ক্ষতিকারক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা চোখ এবং ত্বকের জ্বালা, গুরুতর অসুস্থতা বা এমনকি মৃত্যুও ঘটায়।
শীতল তাপমাত্রা পানির বাষ্পীভবনকেও বাঁধা দেয় – শুষ্ক অঞ্চলে এটা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা, বিশেষ করে যেখানে পানি একটি মূল্যবান সম্পদ। ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে জর্ডান, যা কিনা বিশ্বের অন্যতম জল-অপ্রতুল দেশ, সেখানে একটি জলাধারে ভাসমান সৌর প্যানেল ৪২% বাষ্পীভবন কমিয়েছে এবং সেখানে বার্ষিক ৪২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে।
ভাসমান সৌর প্যানেলের এই পদ্ধতিকে অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানী প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করে এর থেকে আরও অনেক বেশী সুবিধা অর্জন করা সম্ভব। বিদ্যমান জলবিদ্যুৎ পরিকাঠামোর সাথে ভাসমান সৌর প্যানেলকে একত্রিত করার মাধ্যমে করে আরও কার্যকর করে তোলা যায়। এটি নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির একটি মোকাবেলা করতে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সময় বিদ্যুৎ সরবরাহে তা খুবই কার্যকর হবে। দুইটি প্রযুক্তির এই স্মার্ট সম্মিলনের মাধ্যমে দিনের বেলা সৌর শক্তি এবং রাতের বেলা হাইড্রো শক্তি ব্যবহার করা যাবে এবং এর ফলে জলাধারটিকে একটি বিশাল ব্যাটারি হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব।
হাইড্রো ড্যামগুলি বিশ্বের বৃহত্তম নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। তবে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে, যেমন আফ্রিকা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান খরা তাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আফ্রিকার জলবিদ্যুৎ জলাধারের মাত্র ১% এর উপর ভাসমান সৌর প্যানেলগুলি মহাদেশের জলবিদ্যুৎ সক্ষমতাকে দ্বিগুণ করতে পারে এবং বাঁধ থেকে ৫৮% বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান জলবিদ্যুৎ পরিকাঠামোর সাথে প্রোটিয়াসের মতো স্থাপনার সমন্বয়ের মাধ্যমে খুবই কার্যকর সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র
ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশও আর পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশেও এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাগেরহাট জেলা মোংলা বন্দর পৌরসভায় নির্মিত হতে চলেছে দেশের প্রথম ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাংলাদেশের সোলার ইপিসি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এবং ভারতের প্রিমিয়ার সোলার পাওয়ারটেক প্রাইভেট লিমিটেড যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
মোংলার কুমারখালীতে পানি শোধনাগার কেন্দ্রের দুটি পুকুর ও পুকুর পাড়ে ১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ভাসমান ও পুকুর-ধার সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রথম পর্যায়ে ৬ মাসের মধ্যে ৫ মেগাওয়াট ও পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে আরও ১০ মেগাওয়াটসহ সর্বমোট ১৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এই ১৫ মেগাওয়াট ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ মোংলা পোর্ট পৌরসভা ব্যবহার করার পর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে তা থেকে পরিবেশবান্ধব ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের এই উদ্যোগ নিকটবর্তী সুন্দরবন এবং পরিবেশ রক্ষায় একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হবে। বিশেষ করে সুন্দরবন সুরক্ষায় এই ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জিইএম)-এর এক সমীক্ষা দেখা যায় বিশ্বের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাময় ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে বর্তমানে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে এমন শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ কাছাকাছি অবস্থানেও নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা যথাক্রমে ৫৫৪.১৭ এবং ২.৯ মেগাওয়াট। আমাদের দেশে বিপুল সম্ভাবনাময় এই সৌর শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও প্রসারের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় সরকারী নীতি গ্রহন এবং তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ।
এটা এখন স্পষ্ট যে, বিশ্বে জ্বালানী সমস্যার সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তির মধ্যে ভাসমান সৌর প্যানেল পদ্ধতির সম্ভাবনা সামগ্রিকভাবে খুবই উজ্জ্বল ৷ বর্তমানে পরিবেশের বিপদজনক মাত্রার উষ্ণতা এড়াতে বিশ্বকে দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তি বাড়াতে হবে, আর এক্ষেত্রে ভাসমান সান ট্র্যাকিং সোলার সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য রাখার জন্য আমাদেরও সেই পথে হাঁটতে হবে।