দা গ্রেট রেড স্পট: তিনশো বছর ধরে ঘুরতে থাকা অতিকায় দানবীয় ঘূর্ণিঝড়

দা গ্রেট রেড স্পট হল বৃহস্পতিতে চলতে থাকা একটি ঘূর্ণিঝড় যা তিনশো বছরের ও বেশি সময় ধরে চলছে । চিন্তা করুন একটি ঘূর্ণিঝড় যা বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ! বৃহস্পতির বিশাল আকার এবং এর ভিতরে থাকা প্রচণ্ড তাপ বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে এক চরম আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে । এই গ্রহটির দানবীয় ভর আর নিজ অক্ষে ঘুরতে থাকা প্রচণ্ড গতি যা সোলার সিস্টেমের সকল গ্রহ কে হার মানায়। প্রচণ্ড তাপ আর গতিই এই রকম দানবীয় ঘূর্ণিঝড় গ্রেট রেড স্পটের জন্ম দেয় ।

দা গ্রেট রেড স্পট সম্পর্কে আমাদের জানতে হলে আগে বৃহস্পতি গ্রহ সম্পর্কে এবং এটি কি দিয়ে তৈরি সেটা জানা দরকার । প্রথমেই বৃহস্পতি গ্রহ সম্পর্কে জানা যাক-

বৃহস্পতি গ্রহ:

বৃহস্পতি (Jupiter) এক অতিকায় দানবীয় গ্রহ যা আমদের সৌরজগতে পঞ্চমতম স্থানে অবস্থান করছে । এটি রাতের আকাশে খালি চোখে অন্যতম তৃতীয় উজ্জ্বলতর বস্তু। এর নাম রোমান দেবতা জুপিটার এর নাম অনুসারে রাখা হয়। এর ৭৯ টি উপগ্রহ আছে । এটি পৃথিবীর থেকে ৩১৮ গুন বেশি ভাড়ি এবং সূর্যের ভরের এক হাজার ভাগের এক ভাগ । শনি গ্রহের থেকে অনেক গুন ভাড়ি হওয়া সত্তেও এর আকার কিন্তু শনি গ্রহের থেকে অতটা বড় না । এর পিছনে কারনও আছে , গ্রহ যত ভাড়ি হয় তার আকার তত ছোট হয়ে আসে মাধ্যাকর্ষণ বলের কারনে । যদি কয়েক ডজন বৃহস্পতি গ্রহ কে একত্রে করা যায় তাহলে এর কেন্দ্রে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়ে এটি একটি জ্বলন্ত তারায় পরিনত হবে । মাধ্যাকর্ষণ বল সকল গ্রহকে তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে । সব দিক থেকে সমান ভাবে আকর্ষণ করে বলে গ্রহ গুলোর আকার গোলাকার হয় ।

বৃহস্পতি গ্রহের উপাদান:

যাই হোক , দা গ্রেট রেড স্পট কি এটা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের বৃহস্পতি গ্রহ কি দিয়ে তৈরি সেটা ভালভাবে জানা দরকার । অনেকের মনে হতে পারে বৃহস্পতি আমাদের পৃথিবীর মতই একটি গ্রহ । মোটেও তাই না কারন বৃহস্পতিকে বলা হয় গ্যাস জায়েন্ট । সূর্য যেমন পুরোটাই হাইড্রজেন আর হিলিয়ামে তৈরি ঠিক সেরকম । আমাদের পৃথিবীর যেমন সলিড সারফেস (ভূপৃষ্ঠ) আছে বৃহস্পতিতে কিন্তু তা নেই । এর বলতে গেলে পুরটাই হাইড্রজেন আর হিলিয়াম গ্যাসে তৈরি । আপনাকে যদি বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে আপনি এর নিচে পড়তেই থাকবেন কোন কিছু বাধা দেয়ার মতো থাকবে না ( যদি বেঁচে থাকেন তবে ) । যদিও যত নিচে যাবেন ততই এর অভিকর্ষ বল কমতে থাকবে এবং এর কেন্দ্রে অভিকর্ষ বল শুন্য । কেন্দ্রে মোট ভরের খুবই অল্প এবং খুবই ছোট একটি রকি(rocky) কোর আছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন । তাই বৃহস্পতির পুরটাই বায়ুমণ্ডল বলা যায়। আর বায়ুমণ্ডল থাকলেই সেখানে ঘূর্ণিঝড় থাকবে এটাই স্বাভাবিক ।

গ্রেট রেড স্পট:

কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে যেমন ঘূর্ণিঝড় কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় , বৃহস্পতি গ্রহে কিন্তু সেটা হয় না । একবার ঘূর্ণিঝড় শুরু হলে সেটা চলতেই থাকে । কারন পৃথিবীর মতো বৃহস্পতির কোন সলিড সারফেস নেই প্রায় পুরটাই হাইড্রজেন আর হিলিয়াম গ্যাস । পৃথিবীতে যখন ঘূর্ণিঝড় ভূপৃষ্ঠ বা সলিড সারফেসে স্পর্শ করে তখন এটি শক্তি হারাতে থাকে । শক্তি হারায় কারন ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করার সাথে সাথে গাছপালা, ঘরবাড়ি আশপাশে যা আছে সব উড়িয়ে নিতে থাকে আর এর জন্যই তাকে কিছুটা শক্তি হারাতে হয় এবং এক সময় সব শক্তি হারিয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু বৃহস্পতির কোন সারফেস নেই তাই এটি শক্তি হারায় না। দা গ্রেট রেড স্পট হল তেমনি একটি ঝড় যেটি কিনা বৃহস্পতিতে টানা তিনশো ষাট বছর ধরে চলছে !

আরও পড়ুনঃ ‘এরিয়া-৫১’ রহস্যে মুড়ানো দুর্বোধ্য ঘাটির আত্মকথন! (পর্ব-১)

এতো বছর ধরে চলতে থাকা এই ঘূর্ণিঝড়ের পিছনে অনেক গুলো কারন আছে । প্রথমত বৃহস্পতি গ্রহের ঘূর্ণন গতি গোটা সৌরজগতের সমস্ত গ্রহগুলোর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে বেশি । প্রায় প্রতি ৯ ঘণ্টায় একবার এটি নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘোরে । সৌরজগতের কোন গ্রহই এতো দ্রুত নিজের অক্ষে ঘুরে না । এর ২৯০০০ মাইল প্রতি ঘণ্টায় বেগ সোলার সিস্টেমের সকল গ্রহ কে ছাড়িয়ে গেছে। এই অস্বাভাবিক আর ভয়ানক গতিই গ্রেট রেড স্পট বা ঘূর্ণিঝড়টির ফুয়েল হিসেবে কাজ করে ।

আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়া সূর্য দ্বারা পরিচালিত হয় । সূর্যের আলোকে আসতে বাধা দিলে পৃথিবীর আবহাওয়া থেমে যাবে। কিন্তু বৃহস্পতির আবহাওয়া সূর্য থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না । এর আবহাওয়া পরিচালিত হয় এর গভিরে থাকা প্রচণ্ড উত্তপ্ত ঘুরতে থাকা গ্যাসের সুপ থেকে । গ্রহটির সারফেস থেকে যতই কেন্দ্রের দিকে যাওয়া যাবে এটি ততই উত্তপ্ত হতে থাকে । এই গভিরে থাকা উত্তপ্ত গ্যাস থেকে এর সারফেসে উত্তাপ চলে আসে । এই প্রচণ্ড উত্তপ্ত ঘুরতে থাকা গ্যাস বৃহস্পতির আবহাওয়াকে পরিচালিত করে এবং একটি অস্থিতিপূর্ণ বিভিন্ন ব্যান্ডে ঘুরতে থাকা গ্যাস ক্লাউড তৈরি করে। বিভিন্ন ব্যান্ডে গাসের গতি বিভিন্ন হয়।

Gas Sup The Gread red spot, দা গ্রেট রেড স্পট

চিত্রঃ ভিতরে প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা গ্যাস সুপ

মজার ব্যাপার হল আমাদের পৃথিবীতে যেমন মেঘে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখা যায় বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলেও এই রকম বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে অনবরত । ভিতরে টক্সিক গ্যাস উৎপন্ন হয় বলে এইরকম টা দেখা যায় ।

চিত্রঃ বিভিন্ন ব্যান্ডে আলাদা ঘুরতে থাকা গ্যাস ক্লাউড

বৃহস্পতির এই নিজের অক্ষে প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা গতি এবং প্রচুর উত্তপ্ত ঘুরতে থাকা গ্যাস এই সাইক্লোন তৈরি করে। এবং একবার সাইক্লোন শুরু হলে এটা সহজে থামে না । কারন নিজ অক্ষের গতি এবং উত্তাপ এর জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।

গ্রেট রেড স্পট কাঠামো ও অভিজানঃ

দা গ্রেট রেড স্পট সাইক্লোন ঘড়ির কাটার বিপরীতে ২৫০ মাইল প্রতি ঘণ্টায় ঘুরছে। এটি পৃথিবীর প্রতি ৬ দিনে একবার পুরো ঘুরে আসে। এর প্রস্থ ১৬৩৫০ কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ১.৩ গুন । ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে ভয়েজার ১ স্পেসক্রাফট দ্বারা ৯২০০০০০ কিমি দূর থেকে সর্ব প্রথম এর বিস্তারিত ছবি তোলা হয়। রেড স্পট এর বাম দিকে (পশ্চিম ) কালারফুল ওয়েভ প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়। এরপর জুনো স্পেস ক্র্যাফট ১১ জুলাই ২০১৭ সালে মাত্র ৮০০০ কিলোমিটার দূর থেকে ছবি তোলা হয়। জুনো মিশনটি এরপর বৃহস্পতির অ্যাটমোস্ফিয়ারের কম্পজিসন নিয়ে অভিজান চালায়।

চিত্রঃ ভয়েজারের ৮০০০ কিমি দূর থেকে তোলা গ্রেট রেড স্পট এর ছবি

গ্রেট রেড স্পট রঙের উৎপত্তি:

গ্রেট রেড স্পটের লালচে কালারের কারন এখন ও জানা যায় নি । তবে বিভিন্ন ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট থেকে ধারনা করা হয় এক ধরনেরে কেমিক্যাল থেকে এই রেড কালারের উৎপত্তি । ধারনা করা হয় অ্যামনিয়াম হাইড্রসালফাইড এবং জৈব যৌগ অ্যাসিট্যাঁলিন এর বিক্রিয়ার সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাবে থলিন্স নামক এক মেটারিয়ালের জন্য এর রঙ লাল দেখায়।

চিত্রঃ হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে বিভিন্ন তরঙ্গের আলোয় তোলা ছবি

বিজ্ঞানীদের বৃহস্পতি গ্রহ ও এর বায়ুমণ্ডলে চলতে থাকা গ্রেট রেড স্পট নিয়ে বিস্ময় ও কৌতূহলের শেষ নেই । বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন আরও খুঁটিয়ে এটিকে পর্যবেক্ষণ করতে , এর রহস্য ভেদ করতে । বৃহস্পতির ভিতরে কি চলছে তার সামান্যই জানেন বিজ্ঞানীরা । যেহেতু বাহির থেকে এর ভিতরে কি চলেছে তা বুঝা কষ্টসাধ্য তাই দানবীয় এই গ্যাস জায়েন্টের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য । বিজ্ঞানীরা ব্যাবহার করছেন বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি যাতে এর ভিতরের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করা যায় ।

Jupiter is a Jerk

কিন্তু জুপিটার তার ভিতরের গোপন তথ্যকে গোপন করে ভেসে চলেছে বিশাল দেহি ভর নিয়ে। হয়ত ভবিষ্যতে আরও জানতে পারবেন এমনটাই আশা করছেন বিজ্ঞানীরা ।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ছবিঃ সংগৃহীত

Exit mobile version