মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিস্ময়কর এক অলৌকিক ঘটনা হলো মেরাজ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর ঘটনা যতটুকু বর্ণনা করা হয়েছে, প্রত্যেক মুসলিম উম্মাহর জন্য ততটুকু বিশ্বাস করা বাধ্যতামূলক। কেননা এই ঘটনা বিশ্বনবী (সা.) জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুজিজা ও মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় একটি শিক্ষা ও নেয়ামত।
যেহেতু পবিত্র মেরাজ সম্পর্কে সহিহ আকিদা রাখা ও জ্ঞান অর্জন করা বাধ্যতামূলক অর্থাৎ ফরজ। তাই আজ আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইং শা আল্লাহ।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনা, যা আমরা মেরাজ হিসেবে জানি। মূলত এই ঘটনাকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে।
১) ‘ইসরা’ যা পৃথিবীতে ঘটেছিল।
২) ‘মিরাজ’ যা ঊর্ধ্ব আকাশে ঘটেছিল।
পবিত্র কুরআনে সূরা আন-নাজম (১৩-১৮) আয়াতে মেরাজের কথা এবং সূরা বনি ইসরাইলে ‘ইসরা‘ সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“মহান পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে (সে রাতে) আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।” (সুরা ইসরা: ০১)
আয়াতের এ ঘটনাটি ইসলামি পরিভাষায় ‘ইসরা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে৷‘ইসরা’ অর্থ রাতে ভ্রমণ করানো। মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত রাসূল (সা.)-এর বিশেষ ভ্রমণ ইসরা হিসেবে পরিচিত। অধিকাংশ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের বর্ণনা অনুসারে এ ঘটনাটি হিজরতের এক বছর আগে সংঘটিত হয়৷ হাদিস ও সীরাতের বইগুলোতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মি’রাজ বা মেরাজ শব্দের অর্থ আরোহণের মাধ্যম বা ঊর্ধ্বগমন করা। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে নভোমণ্ডলে ভ্রমণ করা। এককথায়, বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সাত আসমানের ওপর সিদরাতুল মুনতাহায় গমন এবং সেখান থেকে আবার বাইতুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসা ইসলামে মেরাজ হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বনবী (সা.)-এর নবুওয়ত লাভের ১১তম বছরের কোনো এক রাতে মেরাজ সংঘঠিত হয়েছিল। সে হিসেবে ২৬ রজব দিবাগত রাতকে মেরাজের রাত বলা হয়ে থাকে। যদিও সঠিক সময় মহান আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। তবে বর্তমানে ও তৎকালিন সময়ে এই ঘটনা ছিল সৃষ্টিজগতের সেরা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা।
মেরাজের অলৌকিক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি (সা.)-এর সম্মান, উচ্চ মর্যাদা ও মাকাম প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা বা বিশ্বাসের অংশ। মেরাজের ঘটনায় শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তাই সহিহ হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর ঘটনা বিশ্বাস করা এবং জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলও বটে।
হযরত মালিক ইবনে সাসা’আহ (রা.) এর হাদিসে আল্লাহর রাসূল, বিশ্বনবি (সা.)-এর মেরাজের বর্ননা করা হয়েছে। সেখানে মেরাজের রাতের ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-
এক সময় আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার কাছে এলেন এবং আমার এ স্থান থেকে সে স্থানের মাঝের অংশটি (হলকুমের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত) চিরে ফেললেন। তারপর আগন্তুক আমার হৃদপিণ্ড বের করলেন। এরপর আমার কাছে একটি সোনার পাত্র আনা হল যা ছিল ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ । জমজমের পানিতে আমার হৃদপিন্ডটি ধৌত করা হল এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে আবার রেখে দেয়া হল।
তারপর আমার কাছে সাদা রং এর একটি জন্তু আনা হল। যা আকারে খচ্চর হতে ছোট ও গাধা হতে বড় ছিল। সে এক এক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ সীমায়। আমাকে তার উপর সওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরিল (আ.) চললেন। প্রথমে বায়তুল মুহাদ্দিসে (মসজিদুল আকসা) নিয়ে গেলেন। সেখানে সকল নবিগণ উপস্থিত ছিলেন। তাদের সাথে দুই রাকআত নফল নামাজ আদায় করলাম এবং সেখান থেকে বুরাকে চরে ঊর্ধ্বগমনে যাত্রা শুরু হয়।
সহিহ হাদিসের বৈচিত্র্যে মেরাজ এর ঘটনায় রাসূল (সা.) বলেন- আমাকে প্রথম আসমানে নিয়ে এসে জিবরিল প্রথম আসমানের দ্বার রক্ষী ফেরেশতা কে দরজা খুলে দিতে বললেন। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? জিবরিল বললেন, মুহাম্মাদ (সা.)। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যা’। তখন বলা হল মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।
তারপর আসমানের দরজা খুলে দেয়া হল। আমি যখন প্রথম আসমানে পৌঁছলাম, তখন সেখানে আদম (আ.)-এর দেখা পেলাম। জিবরিল (আ.) বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক পুত্র ও নেক নবীর প্রতি খোশ আমদেদ।
হাদিসের বৈচিত্র্য মেরাজ সম্পর্কে আরও পাওয়া যায়, রাসূল (সা.) কে প্রথম আসমান পরিদর্শন শেষে তাঁকে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় আসমানে নিয়ে আসা হয়। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন-
জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রথম আসমানের মত পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় আসমানে দাড় প্রান্তে নিয়ে আসলেন এবং দ্বার রক্ষী ফেরেশতাকে দরজা খুলে দিতে বললেন। জিবরাঈল জিজ্ঞাসা করা হল কে? তিনি বললেন, জিবরিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সা.) জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? জিবরিল (আ.) উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর বলা হল – মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে। এরপর দ্বিতীয় আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হল।
দ্বিতীয় আসমানে আমি ইয়াহ্ইয়া (আ.) ও ‘ঈসা (আ.)-এর দেখা পেলাম। তাঁরা দুই জন ছিলেন একে অপরের খালাত ভাই। তিনি (জিবরিল) বললেন, এরা হলেন ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আ.) তাদের প্রতি সালাম করুন। তখন আমি সালাম করলাম।
তৃতীয় আসমানে আমি পৌঁছে ইউসুফ (আ.) কে দেখতে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি ইউসুফ আলাইহিস সালাম। আপনি তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তাঁরা সবাই জবাব দিলেন এবং বললেন, নেককার ভাই, নেককার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ।
রাসূল (সা.) আরও বলেন, তৃতীয় আসমানের পর জিবরিল (আ.) আমাকে নিয়ে উপর দিকে চললেন এবং যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম আসমানে পৌঁছলেন। তিনি আসমানের দরজা খুলে দিতে বললেন। দ্বার রক্ষী ফেরেশতার সাথে জিবরিলের পূর্বের মত একই কথোপকথন হল।
এরপর বলা হল, তাঁর (রাসূল সা.) প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে। তারপর ৪র্থ আসমানের দরজা খুলে দেয়া হল। আমি সেখানে ইদরিস (আ.) কে দেখতে পেলাম। তাঁর কাছে পৌঁছালে জিবরিল বললেন, ইনি ইদরিস (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম।
তারপর ৫ম আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমি সেখানে পৌঁছে হযরত হারূন (আ.) কে পেলাম। জিবরিল বললেন, ইনি হারূন (আ.) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম; তিনিও উত্তম জবাব দিলেন। তাঁরা দুজনই বলেছিল, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি মারহাবা।
পঞ্চম আসমানের পর রাসূল (সা.) কে নিয়ে জিবরিল পর্যায় ক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম আকাশে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। একই ভাবে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরিল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ (সা.)। প্রশ্ন করা হল, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? জিবরিল বললেন, ‘হ্যা’। ফেরেশতা বললেন, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে ৬ষ্ঠ আসমানে রাসূল (সা.) হযরত মূসা (আ.) দেখতে পেলেন। জিবরিল (আ.) বললেন, ইনি মূসা (আ.) তাঁকে সালাম করুন। রাসূল (সা.) তাঁকে সালাম করলাম। তিনি জবাব দিলেন এবং বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি মারহাবা।
সেখান থেকে রাসূল (সা.) যখন অগ্রসর হলেন তখন হযরত মুসা (আ.) কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কিসের জন্য কাঁদছেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, যাঁর উম্মত আমার উম্মত হতে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর ঘটনায় বর্ণনা করা হয়েছে, এরপর রসূল (সা.) সপ্তম আসমানে পৌঁছে ইবরাহিম (আ.) কে দেখতে পেলেন। জিবরিল (আ.) বললেন, ইনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। তিনি তাঁকে সালাম করলেন। ইবরাহিম (আ.) সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেককার পুত্র ও নেককার নবির প্রতি মারহাবা।
হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র পবিত্র মেরাজ এর বর্ননায় পাওয়া যায়, ৭ম আসমান পরিদর্শন শেষে রাসূল (সা.) কে নিয়ে জিবরিল (আ.) সিদরাতুল মুহতাহায় গমন করেন।
[‘সিদরাহ’ শব্দের অর্থ কূল বৃক্ষ আর মুনতাহা শব্দের অর্থ শেষসীমা। হাদিসে বলা হয়েছে, পৃথিবী হতে উর্ধ্বলোকে ফেরেশতাগণ এই সীমায় উপনীত হয়ে, এখানে গিয়েই থেমে পড়ে। এরপর এর অপর পাড়ে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সেখান হতে তাদের তথ্য গ্রহণ করে উপরে নিয়ে যান। শেষ সীমানায় চিহ্নস্বরূপ ঐ স্থানটিতে একটা কূল বৃক্ষ থাকায়, ঐ সীমান্ত চিহ্নকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বলা হয়।]
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-
“আর অবশ্যই তিনি তাকে (জিবরাইল) আরেকবার দেখেছিলেন, ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ তথা প্রান্তবর্তী কুল গাছ এর কাছে।যার কাছে জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত। যখন কুল গাছটিকে যা আচ্ছাদিত করার তা আচ্ছাদিত করেছিল। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। অবশ্যই তিনি তার রবের মহান নিদর্শনাবলীর কিছু দেখেছিলেন।”(সূরা আন-নজমঃ১৩-১৮)
রাসূল (সা.) বলেন- তারপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে দেখতে পেলাম, তার ফল ‘হাজার’ অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি হাতির কানের মত। আমাকে বলা হল, এ হলো এটা সিদরাতুল মু্নতাহা।
আমি সেখানে বিশেষ চারটি নহর দেখতে পেলাম। যাদের দুইটি ছিল অপ্রকাশ্য, আর দুইটি ছিল প্রকাশ্য। তখন আমি জিবরাঈল (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম, এ নহরগুলি কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য দুইটি হল জান্নাতের দুইটি নহর। আর প্রকাশ্য দুইটি হল নীল নদ ও ফুরাত নদী।
হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ সম্পর্কে আরও জানা যায়, রাসূল (সা.) বলেন- তারপর আমার সামনে ‘আল-বায়তুল মামুর’ প্রকাশ করা হল। এরপর আমার সামনে ৩টি পাত্র পরিবেশন করা হলো, একটি শরাবের পাত্র, একটি দুধের পাত্র ও একটি মধুর পাত্র রাখ হল। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তখন জিবরিল বললেন, এটিই হচ্ছে ফিতরাত। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত।
মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে রাসূল (সা.)-এর পর্দার অন্তরাল থেকে সাক্ষাৎ হয়। মনে রাখতে হবে রাসূল (সা.) আল্লাহকে সরাসরি কখনো দেখনি৷ কেননা ‘চর্ম দৃষ্টিশক্তি দ্বারা সরাসরি আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়’ এ কথা পবিত্র কুরআনে সূূূূরা আনআমের ১০৩ আয়াতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) ফিরে আসার সময় মহান আল্লাহ তায়ালা, তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত সালাত উপহার দেন। হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর এই ঘটনা উল্লেখ করে রাসূল (সা.) বলেন-
আমার উপর দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল। এরপর আমি ফিরে আসলাম। মুসা (আ.)-এর সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- আল্লাহ তা’আলা আপনাকে কী আদেশ করেছেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন,আমাকে দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ দেয়া হয়েছে।
মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে সমর্থ হবে না। আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদের পরীক্ষা করেছি এবং বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। তাই আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের বোঝা হালকা করার জন্য আরজ করুন।
রাসূল (সা.) বলেন, আমি ফিরে গেলাম। ফলে আমার উপর হতে দশ ওয়াক্ত কমানো হলো। আমি আবার মূসা (আ.)-এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবার আগের মত বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম। ফলে আল্লাহ তা’আলা আরও দশ (ওয়াক্ত) কমিয়ে দিলেন। ফেরার পথে মূসা (আ.)-এর কাছে পৌঁছলে, তিনি আবার আগের কথা বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ তা’আলা আরো দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন।
আমি মূসা (আ.)-এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবারও একই কথা বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আমাকে প্রতিদিন দশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়। আমি ফিরে এলাম। মূসা (আ.) ঐ কথাই আগের মত বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম, তখন আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হয়।
তারপর মূসা (আ.) কাছে ফিরে এলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কী আদেশ দেয়া হয়েছে? আমি বললাম, আমাকে দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে। মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করতেও সামর্থ হবে না।
আপনার আগে আমি লোকদের পরীক্ষা করেছি। বনি ইসরাইলদের হেদায়াতের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছি। আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য আরো সহজ করার আরজি পেশ করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি আমার রবের কাছে আরজি করেছি, এতে আমি লজ্জাবোধ করছি। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং তা মেনে নিয়েছি।
তারপর রাসূল (সা.) বললেন, আমি যখন মুসা (আ.) থেকে বিদায় গ্রহণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম, তখন এক ঘোষণাকারী (আল্লাহ) ঘোষণা দিলেন-“আমি আমার অবশ্য প্রতিপাল্য নির্দেশ জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের উপর হালকা করে দিলাম।”
আমরা এই পর্যন্ত বর্ননা সহিহ বুখারী শরীফের তাওহীদ অধ্যায় থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।
(০১) “এ রাতে বিশ্বনবি জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান।” (মুসলিম)
(০২) “এমন এক দল লোকের পাশ দিয়ে নবীজী গমন করেছিলেন, যাদের নখ ছিল তামার। এই নখ দ্বারা তারা স্বীয় মুখমন্ডল ও বক্ষ আচঁড়াচ্ছিল। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, জিবরিল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জানালেন, এরা সেই লোক যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত।
অর্থাৎ একে অপরের গীবত ও মানহানি করত। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায় বরং দুনিয়াতে গীবতকারী এসব লোকদেরকে মৃত ভক্ষণ করতে দেখেছিলেন নবীজী।” (মুসনাদে আহমাদ)
(০৩) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ রাতে জান্নাত দেখার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন।” (তিরমিজি)
(০৪) “নবীজী (সা.) জান্নাতে প্রবেশ করে একপাশে একটি হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের আওয়াজ? জিবরিল বললেন, মুয়াযযিন বেলালের কণ্ঠ। মি’রাজ থেকে ফিরে নবীজী (সা.) সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, বেলাল সাফল্য অর্জন করেছে। আমি তাঁর জন্য এমন সব মর্তবা দেখেছি।” (মুসনাদে আহমাদ)
হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ অর্থাৎ এ মহিমান্বিত রাত সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা আরও জানা যায়-
“নবী করীম রাসুলুল্লাহ (সা.) বায়তুল মাকদিসে যাওয়া বা আসার পথে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাও দেখতে পেয়েছিলেন।” (মুসান্নেফে ইবনে আবি শায়বা)
হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর রাতি শেষে সকালের রাসূলে সাঃ এর সাথে কাফিরদের ঘটনাঃ
“নবীজী হাতীমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাত্রে সংঘটিত মেরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করবে নাতো? ইতিমধ্যে তাঁর কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জাহেল। নবীজীর কাছে বসে বিদ্রোপের ছলে বলল, কোনো ব্যাপার আছে নাকি? নবীজী (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ’। সে বলল কী?
রাসূল (সা.) জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মেরাজ হয়েছে। সে বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল? নবীজী বললেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত এবং এরপর ঊর্ধ্ব আকাশে। সে আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে? তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘হ্যাঁ’।
এরপর আবু জাহেল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজী আরও সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই। আবু জাহেল লুয়াই ইবনে কা’ব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সকলে এসে উপস্থিত হলে আবু জাহেল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে,পারলে তা এদের কাছেও ব্যক্ত করো।
রাসূল (সা.) পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে। কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিল। তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।” (তিরমিজি)
নবীজী (সা.) বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম। আমি তখনও কাবার হাতীমে পুরো কওমের সামনে দণ্ডায়মান। ইতিমধ্যেই আল্লাহ হুকুমে পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হল।
আকীলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মাকদিস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিসংকোচে বলতে লাগলাম। বিশ্বনবির (সা.)-এর বর্ণনা শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে। ( সহিহ বুখারি)
হযরত আবু বকর (রা.) কে মক্কার কাফেররা এ বিস্ময়ের কথা বলে সুধাল, তবুও কি তুমি তাঁকে বিশ্বাস করবে? আবু বকর ( রা.) হৃদয়ে ঈমানের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল।
তিনি এক আকাশ আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানী বার্তাসমূহের উপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। (মুসতাদরাকে হাকেম)
আমরা হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিস্ময়কর এক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আপনাদের আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানার জন্য মি’রাজ ও আধুনিক বিজ্ঞান বইটি পাঠ করার পরামর্শ রইলো। অবশ্যই আপনারা বইটি পড়ে নিবেন। ড. আবুল কালাম আজাদ (হাফি.) বইটিতে চমৎকার ভাবে সহিহ হাদিস আলোকে মেরাজের ঘটনা ব্যাখা করেছেন।
আর বিশ্বনবি (সা.)-এর মেরাজ নিয়ে, এখন অনেক বই বাজারে আছে। যার মধ্যে রয়েছে অনেক বাড়াবাড়ি, মতবিরোধ ও ভ্রান্ত আকিদা। এমনকি এর মধ্যে এমন কিছু ভ্রান্ত আকিদা রয়েছে যা মারাক্তক ভাবে ইমান বিধ্বংসী। এসব আকিদা মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়, এমনকি কাফের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
তাই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, সহিহ হাদিসের বৈচিত্র্যে পবিত্র মেরাজ এর ঘটনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ইতিহাস জেনে নেওয়া এবং সহিহ আকিদা লালন করা।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহিহ আকিদা তথা তাওহীদের উপর অবিচল থাকার তৌফিক দান করুক।আমিন।
মন্তব্য লিখুন