সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে শার’ঈ বক্তব্য ও সমাধান

সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি দৃশ্য। মহান আল্লাহর কাছে মনের কথা বা কোন আবদার জানানোর একটি প্রক্রিয়া মোনাজাত হতে পারে। কিন্তু শারঈ দলিল ব্যতিত, ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত সকল প্রকার কাজ কে ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করা হয়ছে৷ যেহেতু আমাদের উপমহাদেশে সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত একটি রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে, প্রসিদ্ধ ইমাম ও ফকিহদের বক্তব্যের আলোকে একটি পর্যালোচনা উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি, ইনশাআল্লাহ।

কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে বক্তব্য

পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত করা না করার ব্যাপারে আমাদের উপমহাদেশের লােকদের মধ্যে সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত দেখা যায়।

এক. সালাম ফিরানাের পর বসে বসে একদল কিছুক্ষণ বিভিন্ন যিকির-আযকার আদায় করেন।

দুই. কোনাে দল সালাম ফিরানোর পর যিকির-আযকার না করে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যান, সুন্নত সালাত আদায়ের জন্য।

তিন. অন্য দল সর্বদা ইমাম সাহেবদের সাথে সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত করেন। মুনাজাত শেষ হওয়ার পর সুন্নত সালাত আদায় করেন।

তবে এই তিন ধরনের দলের লােকদের এ সকল আমলের সমর্থনে কোনাে না কোনাে দলীল তারা প্রমান দিয়ে থাকেন। প্রথমে আসুন আমরা একটু পর্যালোচনা করে দেখি তিন দলের, কোনটার কি ভিক্তি বা প্রমান।

প্রথম দলের প্রমাণ:

আমরা যদি বুখারী ও মুসলিমসহ বহু হাদীসের কিতাবে সালাতের পর যিকির-আযকার অধ্যায় ভালো করে দেখি। তাহলে সেখানে বহু হাদিসে বিভিন্ন যিকিরের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে।

যেগুলো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণ আমল করেছেন। অনেক ইমাম ও উলামায়ে কেরাম এ যিকির-আযকার সম্পর্কে স্বতন্ত্র পুস্তকও সংকলন করেছেন। সুতরাং প্রথম দলের দলিল-প্রমাণ স্পষ্ট।

দ্বিতীয় দলের প্রমাণ:

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন-

“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন সালাম ফিরাতেন তখন ‘আল্লাহুম্মা আনতাসসালাম ওয়ামিনকাসসালাম
তাবারাকতা ইয়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম’ পড়তে যতটুকু সময় লাগে, তার চেয়ে বেশি সময় বসতেন না।” [সহিহ মুসলিম, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ]

একদল এ হাদীস দ্বারা বুঝে নিয়েছেন যে, এ যিকিরটুকু আদায় করতে যতটুকু সময় লাগে এর চেয়ে বেশি বসা ঠিক নয়। তাদের মতে, তাই তাড়াতাড়ি সুন্নত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে হবে।

মূলত হাদীসটির ব্যাখ্যা হলাে- রাসূল (সা.) যেহেতু ইমাম ছিলেন, তাই তিনি সালাম ফিরানাের পর উক্ত বাক্যটি পড়তে যত সময় লাগত, ঠিক এতটুকু সময় মাত্র কেবলামুখী হয়ে বসতেন। এরপর তিনি মুসল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। তিনি যে প্রত্যেক ফরয সালাতের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন, তা বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

সুতরাং এ হাদীস দ্বারা কখনাে এটা প্রমাণিত হয় না, যে রাসূল (সা) নামাজে সালাম ফিরিয়ে, ঐ দোয়া টুকু পড়ে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যেতেন। তাই ফরয সালাত আদায়ের পর তাড়াতাড়ি সুন্নত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া মােটেও সুন্নত সম্মত নয়।

বরং সুন্নত হলাে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যিকির, দোয়া, তাসবীহ, তাহলীল সাধ্য মত আদায় করে তারপর সুন্নত আদায়ের চেষ্টা করা।

তৃতীয় দলের প্রমাণ:

এই দলের লোকেরা ফরয সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত করেন। এদের দলিল হলাে ঐ সকল হাদীস, যাতে সালাত শেষে দো’আ কবুলের কথা বলা হয়েছে এবং দো’আ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

মূলত তারা একটি হাদিসও পেশ করতে পারবেন না, যে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক সালাত জামাতে আদায় শেষে সকলকে নিয়ে সর্বদা হাত তুলে মুনাজাত করেছেন।

তারা যে সকল হাদীস প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চান সেই হাদিসের ‘আকীবাস সালাতদুবুরাস সালাত’ অর্থ তারা মনে করে সালাম ফিরানাের পর’

আসলে তা নয়। এর সঠিক অর্থ হলাে ‘সালাতের শেষ অংশে’। অর্থাৎ সালাতের শেষ বৈঠকে বা শেষ বৈঠকে দুরূদ পাঠ করার পর, সালামের পূর্বে দো’আ করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের পরিভাষায় যা দো’আয়ে মাছুরা বলে থাকি।

সালাত শেষে দোয়া কবুল সম্পর্কে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলােই দোয়া মাছুরা সম্পর্কে। যার সঠিক সময় হলাে সালাম ফিরানাের পূর্বে। আর দো’আ মাছুরা শুধু মাত্র একটা দোয়া নয়, অনেক দো’য়া পড়া যেতে পারে।

ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সালাতের শেষে দোয়া সংক্রান্ত এ সকল হাদীসে “বা’দাস সালাত” বলা হয়নি। হাদীস গ্রন্থে এ সকল দোয়াকে (সালাত শেষের দোয়া) অধ্যায়ে দুটো বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যথা: সালাত শেষের দোয়া ও সালাত শেষের যিকির

ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) ও ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) সহ প্রমুখ উলামায়ে কেরামগণ এই মতটি পোষণ করেছেন যে, এখানে প্রথমটির স্থান হলাে সালাম ফিরানাের পূর্বে এবং দ্বিতীয়টির স্থান হলাে সালাম ফিরানাের পর।

এই মতটি কুরআন ও হাদীসের আলােকে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। কেননা বান্দা যখন সালাতে থাকে তখন সে আল্লাহর অতি নিকটে অবস্থান করে। তাই দো’আর সঠিক সময় তখনই হবে। যখন সালাতের সমাপ্তি ঘােষিত হয় তখন নয়।

সালাম ফিরানোর পরে সময় হলাে, আল্লাহর প্রতি যিকির করার সময়। যেমনটি মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“যখন তােমরা সালাত শেষ করলে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে।”(সূরা আন-নিসা: ১০৩)

তাই এ সম্পর্কিত হাদীসগুলাের ভাষা এবং এর সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমলসমূহ গভীরভাবে পর্যালােচনা করলে, এ বিষয়টিই বুঝে আসে। অর্থাৎ সালাম ফিরানাের পরের সময়টা দোয়া করার সময় নয় বরং যিকির করা ও যিকিরের মাধ্যমে দোয়া করার সময়।

রাসূল (সা.) কি সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত করেছেন?

নবীজি (সা.) সালাত শেষে দোয়া করেছেন। তবে তা সম্মিলিতভাবে নয়। যেমন হাদীসে এসেছে, আল-বারা ইবন আযেব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

“আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিছনে সালাত আদায় করতাম। আমরা তাঁর ডান দিকে সালাত আদায় করতে পছন্দ করতাম। তিনি আমাদের দিকে মুখ করতেন। আল-বারা বলেন,তখন তাকে বলতে শুনতাম,“হে আল্লাহ! আপনার শাস্তি থেকে আমাকে বাঁচান,যে দিন আপনি আপনার বান্দাদের উঠাবেন।” [সহীহ মুসলিম]

কিন্তু জামাতের সাথে তিনি মুসল্লীদের নিয়ে দলগত ভাবে মুনাজাতে দোয়া করেছেন এমন কোনাে বর্ণনা নেই। যা আছে তা ঠিক এর বিপরীত।

যেমন বর্ণিত হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য করুন! সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) একবচন শব্দ ব্যবহার করেছেন। বলেছেন “আমাকে বাঁচান…।” তিনি সকলকে সাথে নিয়ে দোয়াটি করলে বলতেন “আমাদেরকে বাঁচান।”

অন্য আরেকটি হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করুন! মু’আয ইবন জাবাল (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাত ধরে বলেন-

“হে মু’আয! আল্লাহর কসম, আমি তােমাকে ভালােবাসি, আল্লাহর কসম আমি তেমাকে ভালােবাসি। তারপর তিনি বলেন, তুমি অবশ্যই প্রত্যেক সালাতের পর বলবে, হে আল্লাহ! আপনার যিকির, আপনার শােকর ও আপনার জন্য উত্তম ইবাদত করতে আমাকে সাহায্য করুন।” [সুনানে আবু দাউদ]

লক্ষ্য করে দেখুন! প্রখ্যাত সাহাবী মু’আয ইবন জাবাল কাওমের ইমাম ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ইয়েমেনের গভর্নর, শিক্ষক ও ইমাম হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সালাতে ইমামতি করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে এ দোয়াটি সকলকে নিয়ে করার নির্দেশ দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা দেননি। তিনি তাকে একা একা দোয়াটি করার জন্য বলেছেন হাদীসের ভাষাই তার স্পষ্ট প্রমাণ।

সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত কি বিদআত?

একটা বিষয় লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাম ফিরানাের পর তিনবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলেছেন। তিনি যদি এটা সকলকে নিয়ে করতেন তাহলে নাস্তাগফিরুল্লাহ’ (আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলতেন।

তাই যারা ফরয সালাত শেষে কোনাে যিকির আযকার না করে উঠে গেল, তারা একটা সুন্নত (মুস্তাহাব) ছেড়ে দিল। কিন্তু বিদআত হবে না, কেননা তারা সেখানে নতুন কোনো কিছু আবির্ভাব ঘটায় নি।

তবে যারা সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত করে বসল, তারা একটা সুন্নত বাদ দিয়ে সে স্থানে অন্য একটি নতুন আমল করল। তাই সারকথা হলাে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের পর সব সময় জামাতের সাথে মুনাজাত করা একটি বিদআত। যা আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনো করেন নি, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ করেছেন বলে কোনাে প্রমাণ নেই।

তবে যদি কেউ জামাতে সালাত আদায়ের পর একা একা দোয়া মুনাজাত করেন তা সুন্নতের খেলাপ হবে না। এমনিভাবে ইমাম সাহেব যদি সকলকে নিয়ে বিশেষ কোনাে পরিস্থিতিতে কোনাে কোনাে সময় দো’আ-মুনাজাত করেন, তবে তাও নাজায়েয হবে না।

কেননা মুনাজাত সম্পর্কে প্রায় অর্ধ শত সহীহ হাদিস রয়েছে। তবে তা ফরজ নামাজের পর, এমন একটিও নেই। রাসূল (সা.) সম্মিলিত মুনাজাত করেছেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। যেমন: বৃষ্টির জন্য, বিপদের সময়, মহামারী পরিস্থিতি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে।

কিন্তু ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত তিনি কখনোই করেন নি। এরকম একটি হাদিসও নেই। আমাদের আপত্তি শুধু এখানেই, যেখানে রাসূল (সা.) সালাতের পর বিভিন্ন দোয়া ও জিকির শিখিয়েছেন।

সেখানে আমরা প্রথমে তাঁর সুন্নাহ অবলম্বন না করেই মুনাজাতকে প্রাধান্য দিচ্ছি৷ এমনকি এটাকে আমরা একটা রীতি বানিয়ে ফেলেছি। তাহলে এটি কি রাসূল (সা.) সুন্নাতের আগে আমাদের নিজেদের মতের প্রধান্য দেওয়া হলো না?

সুতরাং ইহা শরিয়ত বাতিল বলিয়া গন্য হইবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ইমাম ও ফকিহদের বক্তব্য

(১) ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) কে, ফরজ সালাতের পর ইমাম মুক্তাদি সম্মিলিতভাবে দু’আ করা জায়েজ কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন-

“সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত বা দু’আ, যা ইমাম ও মুসল্লিরা করে থাকে তা বিদআত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে এরূপ দু’আ ছিল না বরং তাঁর দু’আ ছিল সালাতের মধ্যে। কারণ, সালাতের মধ্যে মুসল্লি স্বীয় প্রতিপালকের সাথে নীরবে কথা বলে। আর নীরবে কথা বলার সময় দু’আ করাই যথাযথ।” [মাজমু’আ ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৯]

(২) ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন- “ইমাম পশ্চিমমুখী হয়ে অথবা মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে মুক্তাদীগণকে নিয়ে মুনাজাত করা কখনও রাসূল (সা.)-এর তরীকা নয়। এ সম্পর্কে একটিও সহীহ অথবা হাসান হাদিস নেই।” [ইবনুল কাইয়্যিম, যাদুল মাআদ যাদুল মাআদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৪৯]

(৩) শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) বলেন- “পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত ও নফল সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত বা দলবদ্ধভাবে দুয়া করা স্পষ্ট বিদআত। কারণ, এরূপ দু’আ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এবং তাঁর সাহাবীদের যুগে ছিল না।

যে ব্যক্তি ফরজ সালাতের পর অথবা নফল সালাতের পর দলবদ্ধভাবে দু’আ করে, সে যেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের বিরোধিতা করে।” [হাইয়াতু কিবারিল উলামা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৪৪]

(৪) মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী (রহ.) তাঁর ফাতাওয়া গ্রন্থে বলেন- “এতে সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে জামাআতে সালাত আদায় করার পর ইমাম ও মুক্তাদী মিলে যে নিয়মে দু’আ করেন, এ নিয়ম রাসূল (সা.) এর যামানায় প্রচলিত ছিল না। এ কারণে বহু সংখ্যক আলেম এ নিয়মকে বিদ’আত বলে আখ্যায়িত করেছেন।” [আহসানুল ফাতাওয়া,খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৬৯৮]

(৫) আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী (রহ) বলেন-“বর্তমান সমাজে প্রচলিত প্রথা যে, ইমাম সালাম ফিরানোর পর হাত উঠিয়ে দু’আ করেন এবং মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলেন, এ প্রথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল না।” [ফাতওয়া আব্দুল হাই কিতাব ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০০]

(৬) মুফতি মুহাম্মাদ শফী (রহ.) বলেন- “রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনদের থেকে এবং শরীয়তের চার মাযহাবের ইমামগণ হতেও সালাতের পরে সম্মিলিত মুনাজাত এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। সারকথা হল, এ প্রথা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের প্রদর্শিত পন্থা ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের পরিপন্থী।” [আহকামে দুআ, পৃষ্ঠা ১৩]

(৭) মুফতি ফয়যুল্লাহ হাটহাজারী বলেন-“ফরজ সালাতের পর দু’আর চারটি নিয়ম আছে।

  1. মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠানো ব্যতীত হাদীসে উল্লিখিত মাসনুন দু’আ সমূহ পড়া। নিঃসন্দেহে তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
  2. মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠিয়ে দু’আ করা, এটি কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে কিছু যঈফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
  3. ইমাম ও মুক্তাদীগণ সম্মিলিতভাবে দু’আ করা, এটি না কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, না কোন যঈফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
  4. ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত বা সর্বদা দলবদ্ধভাবে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করার কোন প্রমাণ শরীয়তে নেই। না সাহাবী ও তাবেঈদের আমল দ্বারা প্রমাণিত, না হাদীস সমূহ দ্বারা, সহীহ হোক অথবা যঈফ হোক অথবা জাল হোক। আর না ফিক্বাহ এর কিতাবের কোন পাতায় লিখা আছে। এ দুয়া অবশ্যই বিদআত। [আহকামে দুআ,পৃষ্ঠা ২১]

ফরজ সালাত শেষে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত কিছু দু’আঃ

১. সাহবী হযরত ছাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

“রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সালাত শেষ করতেন তখন তিনবার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি আরও বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা আনতাসসালামু, ওয়ামিনকাসসালামু, তাবারাকতা ইয়া যালযালালি ওয়ালইকরাম।’

অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময় এবং তােমার নিকট হতে শান্তির আগমন, তুমি কল্যাণময়, হে মর্যাদাবান, মহানুভব!

ওয়ালীদ বলেন, আমি ইমাম আওযায়ীকে জিজ্ঞেস করলাম (যিনি এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী) ক্ষমা প্রার্থনা কীভাবে করতে হবে?

তিনি বললেন, তুমি বলবে, আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি)।” [সহিহ মুসলিম]

২. আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) প্রত্যেক সালাতের শেষে সালাম ফিরানাের পর বলতেন-

“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর;

লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালা না’বুদু ইল্লা ইয়াহু, লাহুন নি’মাতু ওয়ালাহু ফাযলু ওয়ালাহুছ ছানাউল হাসান, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিসীনা লাহুদ্দীন ওয়ালাও কারিহাল কাফিরূন।” [সহিহ মুসলিম]

অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত ইবাদতের যােগ্য কোনাে মাবুদ নেই। তিনি এক তাঁর কোনাে শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁর। তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ব্যতীত গুনাহ থেকে বিরত থাকার ও ইবাদত করার শক্তি কারাে নেই। আল্লাহ ব্যতীত কোনাে ইলাহ্ নেই। আমরা তাঁকে ছাড়া আর কারাে ইবাদত করি না। সমস্ত অনুগ্রহ ও শ্রেষ্ঠত্ব তাঁরই। সকল সুন্দর ও ভাল প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি ব্যতীত আর কোনাে ইলাহ নেই। আমরা ধর্মকে একমাত্র তাঁরই জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছি, যদিও কাফেরা তা পছন্দ করে না।

৩. রাসূল (সা.) ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত না করে আরও অনেক দোয়া শিখিয়েছেন। যেমন, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

“ যে ব্যক্তি প্রত্যেক সালাতের পর তেত্রিশ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে, তেত্রিশ বার ‘আলহামদু -লিল্লাহ’ বলবে ও তেত্রিশ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে; এরপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।

অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাতের যােগ্য কোনাে মাবুদ নেই। তিনি এক তার কোনাে শরীক নেই। রাজত্ব তারই এবং প্রশংসা তার। তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান বলে যে একশ পূর্ণ করবে। তার পাপগুলাে ক্ষমা করে দেয়া হবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।” [সহিহ মুসলিম]

এ ছাড়াও সালাতের পর আরাে অনেক যিকির ও দো’আর কথা হাদীসে এসেছে। সেগুলাে আদায় করা যেতে পারে। যেমন: সুরা ইখলাছ, সূরা ফালাক, সুরা নাছ পাঠ করার কথা এসেছে। তিরমিজিতে ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করার বর্ণনা এসেছে ।

সারকথা

ফরজ নামাজের পর এসব দো’আ একই সাথে আদায় করতে হবে, এমন কোনাে বাধ্য বাধকতা নেই। বরং সময় ও সুযােগ মত যা সহজ সেগুলাে আদায় করা যেতে পারে। মােটকথা হলাে, এ সুন্নতটি যেন আমরা কোনাে কারণে ভুলে না যাই এবং এর স্থলে অন্য  কোনো পন্থা স্থান না দেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন-

“যে ব্যক্তি এমন কোনাে আমল করবে যা আমার শরিয়ত সমর্থন করে না তা প্রত্যাখ্যাত।” [সহিহ মুসলিম ]

অনেকে সালাত শেষে এমন কিছু আমল করতে দেখা যায় যেগুলাে হাদীসে পাওয়া যায় না। তাই শারিয়তে কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা যা প্রমানিত নয়, সেগুলাে বর্জন করতে হবে। ঠিক তেমনি ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত শরিয়তে নেই, অর্থাৎ তা বিদআত। তাই ইহা অবশ্যই বর্জন করা উচিত এবং এ সম্পর্কে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

আরও দেখুন বিশ্বখ্যাত শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফি.) এর ফাতওয়া এখানে…

মহান আল্লাহ আমাদের বিদআত মুক্ত ইবাদত করার তৌফিক দান করুক,আমিন।

তথ্য সহায়তাঃ

Exit mobile version