ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস ও ইসলামী শর’ঈ দৃষ্টিভঙ্গি

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস কি? আপনি বিশুদ্ধ ভাবে এর দলিল কতটুকু খুঁজেছেন? ১৪ ফেব্রুয়ারি তথা “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” সম্পর্কে কমবেশি এখন আমরা সবাই জানার চেষ্টা করছি। ইন্টারনেট বা গুগলে এ দিবসের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী পাঠকের সার্চ করার সংখ্যাটাও এখন ঢের বেশি। কিন্তু  এই ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়ে তবুও কম বিতর্ক নেই, রয়েছে পক্ষে বিপক্ষে অনেক মত ও কাহিনি। তাই বর্তমানে আমরা এর একাধিক প্রচলিত ইতিহাস বা কাহিনি সম্পর্কে জানতে পারি৷

কিন্তু এসকল গল্প বা কাহিনির অন্ততরালে কেউ বা কারা সঠিক বিশুদ্ধ তথ্যটি আমাদের কাছ থেকে ঢেকে রেখেছে। যা আজ আমাদের জানানো হচ্ছে না, রাখা হয়েছে দৃষ্টির অগোচরে। ফলে অনৈতিকতার চর্চা, আধুনিকতা ও তথা কথিত রোমান্টিকতার নামে এ দিবস আজ তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীর বিশেষ দিনে পরিনত হয়েছে। আর এ পিছনে রয়েছে সেই তথাকথিত অবৈধ এক প্রেমের রচিত গল্প বা কাহিনি। যা তরুণ সমাজকে বেশ প্রভাবিত করেছে। ফলে এ গল্প বা রচিত কাহিনির  প্রচার আজ সবাইকে পাপের রাজ্যে আন্দোলিত করেছে এটা বলতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ আপনি মুসলিম হয়েও আজ বেশ অমনোযোগী ও ব্যর্থ।

এটা স্পষ্টত যে, এসকল রচিত কাহিনি থেকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি এর সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ বা দলিল কেউ দিতে পারেনি। ফলে রচিত হয়েছে অনেক গল্প বা কাহিনি। দেখুন আমরা আজ আবেগী জাতিতে পরিণত হয়েছি। তাই একটি কাহিনি শুনেছি আর নিজেকে অনৈতিক পাপের রাজ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। আর পালন করছি এক বিশ্ব যিনার দিবস। আফসোস!!!

মূলত কথিত এই বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেকেই সুস্পষ্ট ধারণা রাখি না। আমার অনেকে মনে করি এ বিষয়ের উৎপত্তির সাথে কোনো ধর্মীয় বিষয় নেই। আর ইসলাম ধর্ম এই কথিত ভালোবাসা দিবসটিকে কোন দৃষ্টিতে দেখে সে সম্পর্কেও আমরা আজ মুসলিম হয়ে ভালোভাবে অবহিত নই। তাই আজকের চেষ্টা কথিত এ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস এবং এ দিবসটি নিয়ে ইসলামি দৃষ্টিতে একটি বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক প্রতিবেদন তৈরি করার, ইং শা আল্লাহ।

ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস

১৪ ই ফেব্রুয়ারী সাধু ভ্যালেন্টাইন দিবস বর্তমানে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নামে ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে আমাদের দেশে পালিত হয়। মূলত দিবসটি ছিল প্রাচীন ইউরােপীয় গ্রীক-রােমানপৌত্তলিকদের একটি ধর্মীয় দিবস। ভারতীয় আর্যদের মতই প্রাচীন রােমান পৌত্তলিকগণ মধ্য ফেব্রুয়ারী বা ১লা ফাল্গুন ভূমি, নারীদের উর্বরতা, তাদের  বিবাহ এবং সন্তান কামনায় প্রাচীন দেবদেবীদের বর লাভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বিভিন্ন নগ্ন ও অশ্লীল উৎসব পালন করত।

যা লুপারকালিয়া (Lupercalia) উৎসব (feast of Lupercalis) নামে প্রচলিত ছিল। ইউরােপে খৃস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা লাভের পরেও এ সকল অশ্লীল উৎসব ও বিকৃত ভালোবাসা  অব্যাহত থাকে। তাই পরে একে  খৃস্টীয়’ রূপ দেওয়া হয়।

ইউরােপে খৃস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠার পর ধর্মের নামে, বিশ্বাসের নামে, ডাইনী শিকারের নামে, অবিশ্বাস বা ধর্মীয় ভিন্নমতের (heresy) অভিযােগে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। তখন বিভিন্ন প্রকারের অশ্লীলতা, পাপাচার, মুর্তিপূজা, সাধুপূজা ইত্যাদির প্রশ্রয় দেওয়া হয়।

বস্তুত হযরত ঈসা (আ.) এর প্রস্থানের কয়েক বৎসর পরে শৌল নামক এক ইহূদী-যিনি পরে পৌল নাম ধারণ করেন। তিনি ধর্ম ও শরীয়তকে বিকৃত করেন। শৌল প্রথমে ঈসা (আ.)-এর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদের উপর কঠিন অত্যাচার করতেন।

এরপর হঠাৎ তিনি দাবি করেন যে, যীশু তাকে দেখা দিয়েছেন এবং তাকে ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে ঈসা (আ)- এর মূল অনুসারীরা তার বিষয়ে সন্দেহ করার কারণে তিনি এশিয়া মাইনর ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করেন।

বর্তমানে প্রচলিত খৃস্টান ধর্মের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। তার এ ধর্মের মূলনীতি হলাে, ঈশ্বরের মর্যাদা রক্ষার জন্য যত খুশি মিথ্যা বলো। প্রয়ােজন মত যত ইচ্ছা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে এবং মিথ্যা বলে মানুষকে খৃস্টান বানাও।

পৌল নিজেই বলেছেন , “For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory ; why yet am I also judged as a sinner? আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমি  এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন ?

বর্তমানে প্রচলিত বাইবেল থেকে যে কোনাে পাঠক দেখবেন যে, যীশু খৃস্ট যেখানে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে, সালাত আদায় করতে, সিয়াম পালন করতে, সম্পদ সঞ্চয় না করতে, নারীর দিকে দৃষ্টিপাত না করতে, শূকরের মাংস ভক্ষণ না করতে, খাতনা করতে, তাওরাতের সকল নিয়ম পালন করতে, ব্যভিচার বর্জণ করতে, সততা ও পবিত্রতা অর্জন করতে এবং মানুষ হিসেবে সবাইকে একটি সুস্থ  ভালোবাসা  নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু সেখানে পৌল এ সকল বিধান সব বাতিল করে বলেছেন যে, শুধু যীশুকে ত্রাণকর্তা বিশ্বাস করলেই চলবে। বরং তিনি এ সকল বিধান নিয়ে নােংরা ভাবে উপহাস করে বলেছেন, বিধান পালন করে যদি জান্নাতে যেতে হয় তবে যীশু কি জন্য?

যীশু-ভক্তির নামে তিনি নিজেই যীশুর সকল শিক্ষা বাতিল করে দিয়েছেন। পৌল প্রতিষ্ঠিত এ খৃস্টান ধর্মের মূল চরিত্রই হলাে যুক্তি ও দলিল দিয়ে বা পাদরি-পােপদের নামে ধর্মের মধ্যে নতুন নতুন অনুষ্ঠান ও নিয়মকানুন জারি করা এবং যে সমাজে ও যুগে যা প্রচলিত আছে তাকে একটি ‘খৃস্টীয়’ নাম দিয়ে বৈধ করে নেওয়া।

এজন্য জে . হিকস (J. Hicks) তার লেখা (The Myth of God Incarnate) গ্রন্থে বলেন, “Christianity has throughout its history been a continuously growing and changing movement of adjustments ” .

এ পরিবর্তনের ধারায় ৫ম-৬ষ্ঠ খৃস্টীয় শতকে লুপারকালিয়া উৎসবকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে বা সাধু ভ্যালেন্টাইনের দিবস’ তথা (ভালোবাসা দিবস) নামের চালানাের ব্যবস্থা করা হয়।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক ব্যক্তিটি কে ছিলেন তা নিয়ে অনেক কথা আছে। তবে মূল কথা হলাে, লুপারকালিয়া উৎসবকে খৃস্টান রূপ প্রদান করা। এভাবে আমরা দেখছি যে, এ দিবসটি একান্তই পৌত্তলিক ও খৃস্টানদের ধর্মীয় দিবস।

বর্তমানে প্রচলিত ভালোবাসা দিবস

(০১)  আমরা ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বর্তমান যুগে “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ” নাম দিয়ে এটিকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ বা সার্বজনীন রূপ দেওয়ার একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কার্যকর রয়েছে। যে দিবসটির কথা কয়েক বৎসর আগেও এদেশের কেউই জানত না, সে দিবসটির কথা জানে না এমন মানুষ এখন দেশে নেই বললেই চলে।

ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমেই বর্তমানে এরূপ করা সম্ভব হয়েছে। এ চক্রান্তের উদ্দেশ্য “ভালোবাসা দিবস” নামে যুবক-যুবতীদেরকে মাতিয়ে তুলে ব্যাপক বাণিজ্য করা, যুবক-যুবতীদের নৈতিক ও চারিত্রিক ভিত্তি নষ্ট করে দেওয়া এবং তাদেরকে ভােগমুখী করে স্থায়ীভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদের অনুগত করে রাখা।

(০২) ইংরেজীতে Love, বাংলায় ভালোবাসা এবং  আরবীতে মাহাব্বাত। পানাহার, দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি কর্মের মত ভালোবাসাও ইসলামের দৃষ্টিতে কখনাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং কখনাে কঠিন নিষিদ্ধ হারাম কর্ম। পিতামাতাকে ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীসন্তানদেরকে, ভাইবােনকে, আত্মীয়-স্বজনদের, সঙ্গীসাথী ও বন্ধুদের , সত্যানুষদেরকে, সকল মুসলিমকে, সকল মানুষকে এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসা ইসলাম নির্দেশিত কর্ম।

এরূপ ভালোবাসা মানুষের মানবীয় মূল্যবােধ উজ্জীবিত করে, হৃদয়কে প্রশস্ত ও প্রশান্ত করে। সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে কল্যাণময়, গঠনমূলক ভূমিকা এবং ত্যাগস্বীকারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।

(০৩) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদের প্রচারিত তথাকথিত “বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার এ দিকগুলি একেবারেই উপেক্ষিত, অথচ সংঘাতময় এ পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযােগ্য করার জন্য এরূপ ভালোবাসার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কতই না প্রয়ােজন!

আরও পড়ুনঃ

আওরঙ্গজেব: সম্রাট আওরঙ্গজেবের ইসলামি শাসনামল সম্পর্কে জানুন

কোরআনের দৃষ্টিতে অশ্লীলতা বা পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়

ইসলামে আয় ও ব্যয় এর নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানুন

ভালোবাসার একটি বিশেষ দিক নারী ও পুরুষের জৈবিক ভালোবাসা। আন্তর্জাতিক বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে শুধু যুবক-যুবতীদের এরূপ জৈবিক ও বিবাহের বেহায়াপনা উস্কে দিচ্ছে।

(০৪) বর্তমানে যুবক – যুবতীদের বয়সের উন্মাদনাকে পুঁজি করে তারা তাদেরকে অশ্লীলতার পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।

ধর্মের নামে অনেক ধর্মে, বিশেষত পাদ্রী-পুরােহিত নিয়ন্ত্রিত খৃস্টান ধর্মে নারী-পুরুষের এরূপ ভালোবাসা, দৈহিক সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবনকে অবহেলা করা হয়েছে বা ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে। নারীকে শয়তানের দোসর মনে করা হয়েছে।

স্ত্রীর সাহচার্য বা পারিবারিক জীবনকে পরকালের মুক্তির বা আল্লাহর প্রেম অর্জনের পথে অন্তরায় বলে মনে করা হয়েছে। এজন্য সন্যাস বা বৈরাগ্যকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

তাই এখনাে যেখানেই তারা সুযােগ পায় সংসার ও পরিবার বর্জন করে ‘নান’ (nun), মঙ্ক (monk) বা সন্যাসী হওয়ার উৎসাহ দেয় এবং এরূপ হওয়াকে ধার্মিকতার জন্য উত্তম বলে প্রচার করে।

মধ্যযুগীয় খৃস্টীয় গীর্জা ও মঠগুলির ইতিহাসে এ সকল সন্যাসী-সন্যাসিনীর অশ্লীলতার বিবরণ পড়লে গা শিউরে ওঠে এবং আধুনিক যুগের অশ্লীল গল্পের চেয়ে জঘন্যতর অগণিত ঘটনা আমরা দেখতে পাই। বস্তুত, এ সকল চিন্তা সবই মানবতা বিরােধী ও প্রকৃতি বিরােধী।

ইসলামে এরূপ চিন্তা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বরং পরিবার গঠন করা এবং পারিবারিক কাঠামাের মধ্যে নারী-পুরুষের এরূপ জৈবিক প্রেমকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলে গণ্য করা হয়েছে।

ভলোবাসা সম্পর্কে  ইসলাম কি বলে?

একঃ আমাদের ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস জানা পাশাাপাশি প্রকৃত ভালোবাসা কি সেটাও জানা খুবই প্রয়োজনে। নব জাতিকে টিকিয়ে রাখতে মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে এ জৈবিক ভালোবাসা প্রদান করেছেন। এরূপ ভালোবাসার প্রবল আকর্ষণে মানুষ পরিবার গঠন করে, সন্তান গ্রহণ করে, পরিবার-সন্তানের জন্য সকল কষ্ট অকাতরে সহ্য করে এবং এভাবেই মানব জাতি পৃথিবীতে টিকে আছে।

মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ ভালোবাসাকে একমুখী বা পরিবারমুখী করা অত্যাবশ্যকীয়। যদি কোনাে সমাজে পরিবারিক সম্পর্কের বাইরে নারী-পুরুষের এরূপ ভালোবাসা সহজলভ্য হয়ে যায়, তবে সে সমাজে পরিবার গঠন ও পরিবার সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে যায় এবং ক্রমান্বয়ে সে সমাজ ধ্বংস হয়ে।

এজন্য সকল আসমানী ধর্ম ও সকল সভ্য মানুষ ব্যভিচার ও বিবাহের ‘ভালোবাসা’ কঠিনতম অপরাধ ও পাপ বলে গণ্য করেছে। ইসলামে শুধু ব্যভিচারকেই নিষেধ করা হয় নি, ব্যভিচারের নিকটে নিয়ে যায় বা ব্যভিচারের পথ খুলে দিতে পারে এমন সকল কর্ম কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-

“আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন সকল প্রকার অশ্লীলতা, তা প্রকাশ্য হােক আর অপ্রকাশ্য হােক।” [আল আরাফঃ ৩৩]

“তােমর নিকটবর্তী হয়াে না ব্যভিচারের, নিশ্চয় তা অশ্লীল এবং নিকৃষ্ট আচরণ।” [বনি ইসরাইলঃ ৩২]

“তােমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কোনাে প্রকারের অশ্লীলতার নিকটবর্তী হয়াে না।” [আল-কুরআন]

জঘন্যতম বর্বরতা হলাে ধর্মের নামে অশ্লীলতা। বর্তমান যুগের বাউল, ফকীর, সন্যাসী নামের প্রতারকদের ন্যায় আরবের অনেক মানুষ ধার্মিকতার নামে বা যিকর, দুআ, হজ্জ, ধ্যান ইত্যাদির সাথে বেপর্দা, নগ্নতা অশ্লীলতার সংমিশ্রণ ঘটাতাে।

এ বিষয়ে আল্লাহ তায়া’লা বলেন-

“যখন তারা কোনাে অশ্লীল -বেহায়া কর্ম করে তখন বলে আমাদের পূর্বপুরুষরা এরূপ করতেন বলে আমরা দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদেরকে এরূপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বল, আল্লাহ কখনােই অশ্লীলতার নির্দেশ দেন না,তােমরা কি আল্লাহর নামে এমন কিছু বলছ যা তােমরা জান না?” [আল আরাফঃ ২৮]

ব্যভিচারে পথ রোধের অন্যতম দিক চক্ষু সংঘত করা, নারী-পুরুষের মনের মধ্যে জৈবিক কামনা সৃষ্টি করা কোনো কিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত না করা।

আল্লাহ তায়া’লা আরও বলেন-

“মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযাত করে এবং তাদের সম্ভ্রম হিফাজত করে…মুৃমিন নারীদের  বলো, যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযাত করে এবং তাদের সম্ভ্রমকে হেফাজত করে।” [সূরা আন-নুরঃ ৩০]

দুইঃ রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “যখন কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রােগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না”[ইবনে মাজাহ]। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক ভাল দিক রয়েছে। তারা জাগতিকভাবে অনেক উন্নতি লাভ করেছে। তবে অশ্লীলতার প্রসারে যে অবক্ষয় তাদের স্পর্শ করেছে তা তাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে সার্বিক ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করেছে।

আজ ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সবার না জানার কারনে ভালোবাসার নামে ছেলেমেয়েরা ভালোবাসাকে উন্মুক্ত করে পথেঘাটে সহজলভ্য করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কেউই আর পরিবার গঠনের মত কঠিন ঝামেলাই যেতে চাচ্ছে না। পরিবার গঠন করলেও পরিবার টিকছে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার খুবই ভয়ঙ্কর। বিবাহের জৈবিক’ ভালোবাসার সহজলভ্যতাই এগুলির অন্যতম কারণ।

তিনঃ ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে না জানা ও কথিত ভালোবাসার একটি ভয়ংকর ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০% মানুষ পারিবারিক জীবন যাপন করতো। ২০০০ সালে সে দেশের প্রায় ৫০% মানুষ কোনােরকম পারিবারিক বন্ধন ছাড়া একেবারেই পৃথক ও একক জীবন যাপন করা শুরু করে।

বাকী ৫০% ভাগ যারা পরিবার গঠন করেছে তাদেরও প্রায় তিনভাগের একভাগের কোনাে সন্তান সন্ততি নেই। পরিবার গঠন, পরিবারের মধ্যে পবিত্র ভালোবাসার লালন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম ও লালন এখন ‘সভ্য’ মানুষদের উদ্দেশ্য নয়, বরং সভ্য মানুষদের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ‘অসভ্য পশুদের মত নিজে বেঁচে থাকা এবং আনন্দ-ফুর্তি করা।

এজন্য ইউরােপে-আমেরিকায় পারিবারিক কাঠামাে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সহিংসতা, স্বার্থপরতা ও হিংস্রতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

চারঃ আমাদের কথিত ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস জেনে নিতে হবে। প্রকৃত ভালোবাসা মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য মানব সমাজে  প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা আমাদের দায়িত্ব। পিতামাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, সত্যানুষ, সকল মুসলমান এবং সকল মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার প্রসারের জন্য আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

পারিবারিক কাঠামাের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার স্থায়িত্ব ও বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । তবে এ সকল ভালোবাসার বাণী প্রচারের জন্য ‘ভালোবাসা দিবস’-কে বেছে নেওয়া বৈধ নয়।

কারণ আমরা জানি যে, এ দিবসটি পৌত্তলিক ও খৃস্টানদের একটি ধর্মীয় দিবস। আর কোনাে ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় দিবস পালন করা কুফরী, যাতে মুমিনের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।

আমরা জানি, পিতামাতা, আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুদেরকে আপ্যায়ন করা বা শুভেচ্ছে বিনিময় করা একটি ভাল কর্ম। কিন্তু দুর্গাপূজা বা বড়দিন উপলক্ষ্যে কোনাে মুমিন এ কাজ করলে তার ঈমান নষ্ট হবে, কারণ তিনি অন্য ধর্মের বিধান বা দিবস পালন করার মাধ্যমে নিজের ধর্ম বর্জন করেছেন।

ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস না জেনেই, এই দিবস পালন করতে পিতামাতা, সন্তানসন্ততি বা স্বামী-স্ত্রীকে মেসেজ পাঠানাে, শুভেচ্ছা জানানাে বা উপহার দেওয়া একই রকমের পাপ। এছাড়া যেহেতু দিবসটি ভালোবাসার নামে বেহায়াপনা ও ব্যভিচার প্রচারের জন্যই নির্ধারিত, সেহেতু কোনােভাবে দিবস পালন করার অর্থ এ দিবস পালনে সহযােগিতা করা এবং একে স্বীকৃতি দেওয়া।

যে যুবক-যুবতী তার যৌবনকে কলঙ্কমুক্ত ও পবিত্র রাখতে পারবে এবং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে থাকতে পারবে তাকে আল্লাহ কেয়ামতের দিন আল্লাহর প্রিয়তম আওলিয়াদের সাথে একই কাতারে মহান আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষ নসিহত:

(০১)  যুবক-যুবতী, কিশাের-কিশোরীদের অনুরােধ করব, বয়সের উন্মাদনায় ভুলভ্রান্তি ও পাপ হয়ে যেতে পারে, তবে অন্তত দুটি বিষয় থেকে সর্বদা আত্মরক্ষা করবে: ব্যভিচার ও মাদকতা।

আর যে কোনাে অবস্থায় নামায ছাড়বে না। ইনশা-আল্লাহ এ দুনিয়ার জীবনেই তােমাদের বয়স যখন ৪০/৫০ হবে তখন তােমরাই অনুভব করবে যে, তােমাদের যে সকল বন্ধু পাপের পথে পা বাড়িয়েছিল তাদের চেয়ে আল্লাহ তােমাকে ভাল রেখেছেন এবং কিয়ামতে তারা আল্লাহর আরশের নীচে মহান ওলীদের কাতারে স্থান লাভ করবে।

(০২) সম্মানিত পাঠকগণ, আমাদের নিজেদের সন্তানদের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, মানব সভ্যতার স্বার্থে এবং আমাদের আখিরাতের মুক্তির স্বার্থে ভালোবাসার নামে বেহায়াপনা ও ব্যভিচারের উস্কানি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রােধ করা আমাদের অন্যতম জরুরী দায়িত্ব।

‘ভালোবাসা’ দিবসের নামে যুবক-যুবতীদের আড্ডা, গল্পগুজব, মেসেজ আদান প্রদান, উপহার আদান প্রদান, উল্লাস করা বা অনুরূপ যে কোনাে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহের ভালোবাসার উস্কানি দেওয়া শূকরের মাংস ভক্ষণ করার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর পাপ।

আমরা জানি, শূকরের মাংস ভক্ষণ করা যেমন হারাম, তেমনি হারাম ব্যভিচারের উস্কানিমূলক সকল কর্ম। তবে পার্থক্য এই যে, শূকরের মাংস একবার ভক্ষণ করলে বারবার ভক্ষণ করার অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয় না, কিন্তু যে কোনাে উপলক্ষে কিশাের-কিশােরী ও যুবক-যুবতী ‘ভালোবাসা’-র নামে ফ্রি মেলামেশা বা আড়ার খপ্পরে পড়লে তার মধ্যে এ বিষয়ে অদম্য আগ্রহ তৈরী হয় এবং ক্রমান্বয়ে সে ব্যভিচার ও আনুষঙ্গিক সকল পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে যায়।

(০৩) সতর্ক হােন! ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস না জেনে কথিত ভালোবাসা দিবস বা অন্য কোনাে নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সমর্থন করা, প্রশ্রয় দেওয়া বা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সােচ্চার না হওয়া আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন ধ্বংস করবে এবং আপনার, আপনার পরিবার ও সমাজে আল্লাহর সুনিশ্চিত গযব বয়ে আনবে। বিষয়টিকে সহজ ভাবে নিবেন না। নিজের ব্যবসা, রাজনীতি বা অন্য কোনাে স্বার্থের কারণে ভালোবাসা দিবস পালনে সহযােগিতা করবেন না।

মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বলেছেন-

“যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তােমরা জান না।” [সূরা নুরঃ ১৯]

(০৪) সাবধান! মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে হালকা করে দেখবেন না!! কখন কিভাবে আপনার জীবনে দুনিয়াতেই ‘যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি’ নেমে আসবে আপনি তা অনুমানও করতে পারবেন না।

রােগব্যধি, জাগতিক অপমান, শাস্তি, লাঞ্ছনা, পরিবারের অশান্তি সন্তানদের অধঃপতন ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে আল্লাহর শাস্তি আপনার জীবনকে স্পর্শ করতে পারে। কাজেই আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করুন।

অশ্লীলতার সকল পথ রােধে সচেষ্ট হােন। কোনােভাবে অশ্লীলতার প্রসারে সহায়ক হবেন না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন। আমীন!!

সুতরাং আসুন বর্তমানে প্রচলিত এই বিকৃত ভালোবাসা দিবসকে পরিহার করি। এই বিকৃত ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করি। কারণ এর সাথে ইসলামের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। আর আপনি একজন মুসলিম তাই এ যিনার দিবসের সাথে আপনারও কোন সম্পর্কে নেই। তাই ইহা আপনার জন্য অবশ্যই পরিত্যক্ত। আসুন সবাই ইসলামের আলোকে সুস্থ সুন্দর মনুষ্যত্ব উজ্জীবিত ভালোবাসা গ্রহণ করি, অশ্লীলতাকে ঘৃণা করি।

তথ্যসুত্রঃ

Exit mobile version