নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ নিয়ে বহু আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে। ইন্টারনেটে এ সম্পর্কে বহু প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে৷ তাই এতো বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি না। শুধু ইসলামিক কিছু নীতি ও সাধারণ কিছু যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
যা আমাদের ইসলাম সস্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারনা সৃষ্টি করবে বলে আশা করি। আর নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ বা মুসলিম হওয়ার গল্পে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে কি প্রভাব ফেলেছে? এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র ।
আলহামদুলিল্লাহ ইসলাম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন বিধান। কোনো গল্প বা কথিত ঘটনা ইসলামের জন্য সামান্যতম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং মানব ইতিহাসে ইসলামের গুরুত্ব প্রত্যেক মানবজাতির কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবুও অন্তরের কালো আধার আজও অনেক মানুষকে কলুষিত করে রেখেছে৷
কিন্তু তাদের জন্য একটি আলোর প্রদীপ জীবনের অন্তিম সজ্জা পর্যন্ত আলোর পথে আহ্বান করে যাবে। আর এই আহ্বানের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজে নিয়েছেন। তাইতো মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার ( প্রকৃত সংখ্যা একমাত্র মহান আল্লাহই ভালো জানেন) নবী ও রাসূল প্রেরন করেছেন। যাতে প্রত্যেক জাতীর কাছে সত্যের বানী পৌঁছে যায়।
মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালা নফস, চিন্তাশক্তি, বিবেক ও জ্ঞান দান করেছেন। যেন সত্য ও মিথ্যা যাচাই করতে সে সক্ষম হয়। তাই নবী বা রাসূলগণ কোনো জাতীর উপর জোর করে ধর্মের বানী চাপিয়ে দেননি। বরং নিরলসভাবে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তো ইচ্ছে করলেই তাঁর কর্তৃত্ব আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আমাদের সবকিছুর সঠিক পথ স্পট করে দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন মাত্র।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“ধর্ম মানতে কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি নেই। সঠিক পথ ভুল পথ থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে গেছে। তাই যে তাগুত (মিথ্যা প্রভুদের) অস্বীকার করবে, এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আনবে,সে অবশ্যই এমন এক মজবুত হাতল ধরবে,যা ভাঙ্গার কোনো আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সব শোনেন,সব জানেন।” [আল-বাক্বারাহ ২৫৬]
তবুও বহু মানুষ তার নফসের গোলামি করে সত্যের বানী প্রত্যাখ্যান করে বহু নবী ও রাসূলগণকে নির্মম ভাবে নির্যাতন ও হত্যা করেছে। তবুও নবীগণ আল্লাহ বানী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থেকে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে যাননি। বরং তারা নবী রাসূলগণকে পাগল ও তাদের শত্রু মনে করতে থাকে। ফলে বহু জাতি আল্লাহর বানী ত্যাগ করে আজও শয়তানের পদার্পণ অনুসরণ করে যাচ্ছে।
ইসলামি ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব। মানব ইতিহাসে বহু রাজা, বাদশাহ প্রজা ইসলামের দাওয়াত পাওয়া সত্যেও শয়তানের প্রতারণা ও নফসের গোলামির কারনে জান্নাতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে জাহান্নামে যাত্রা করেছে।
যেমন- নমরুদ ও ফিরাউনদের মত এতো বড় প্রতাপশালী ব্যক্তিগণ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় না নিয়ে শয়তানকে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর বানী গ্রহণ করতো তাহলে তাদের বিশাল সম্রাজ্যের সকল মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে বাধ্য হতো। ফলে তারাও জান্নাতের অধিবাসী হয়ে যেত।
নিল আর্মস্ট্রং তো তাদের তুলনায় অতি সাধারণত ব্যক্তি মাত্র। এমন তো নয় নীল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করায় হাজার হাজার খ্রিষ্টান মুসলিম হয়ে যেত। এটাই ভাল হতো তাইতো? আসলে না। বরং তিনি যদি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করতেন তবে স্বয়ং নিজেই লাভবান হতেন। জান্নাতের অধিবাসীদের দলে নাম লেখাতেন। এতে ইসলামের বা আল্লাহর কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই।
নিঃসন্দেহে প্রত্যেক মানুষ কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে ভালোবাসে। তাই নওমুসলিমরা যখন তাদের মুসলিম হওয়ার ঘটনা বর্নণা করেন তখন অনেকের মাঝেই ইসলাম সম্পর্কে পজেটিভ চিন্তা জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু এসব গল্পের মাধ্যমে ইসলামের গুরুত্ব প্রকাশের কোনো বিশেষ
প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারন ইসলামের গুরুত্ব ও আদর্শ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন-
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হলো ইসলাম।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯)
হেদায়েতের পূর্নাঙ্গ মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। শুধু নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ নয় বরং সমগ্র মানব জাতির হেদায়েত একমাত্র মহান বর আল্লাহর কাছে। তাই যিনি মুসলিম হয়েছেন তার প্রতি আল্লাহর হেদায়েত নসিব হয়েছে এটাই বলতে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির মাঝে চিন্তা,চেতনা ও বিবেক দিয়েছেন মানুষের জন্য। যিনি তা চিন্তা করে এবং হেদায়েতের তামান্না করে। একমাত্র তার জন্যই আল্লাহর রেখেছেন হেদায়েতের মহাপুরস্কার।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“তারা ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে (মুসলমান হয়ে) আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। (হে রাসুল! আপনি) বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক।” (সুরা হুজাতঃ ১৭)
তাই ইসলামের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার গল্প কেন? কোনো নওমুসলিমদের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং অনুপ্রেরণা ও বিশেষ নসিহতের জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে মাত্র। আর হেদায়েতের তামান্না যার কলবে রয়েছে। ইনশাআল্লাহ সে আল্লাহর হেদায়েত লাভ করবেই।
কথিত ঘটনায় বর্নিত হয়েছে,“তিনি যখন চাঁদে পদার্পণ করলেন তিনি নাকি একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং চাঁদের পৃষ্ঠে মাঝ বরাবর জোড়া লাগানো দেখলেন। পরবর্তীতে পৃথিবীতে এসে মিশর সফর করে জানতে পারলেন এটা আযানের ধ্বনি এবং আরো জানতে পারলেন মোহাম্মদ (সা.) এর চাঁদ দ্বিখন্ড করার মুজেযা। ফলে অনুপ্রাণিত হয়ে নিল আর্মস্ট্রং ইসলামগ্রহন করলেন। “
আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহ চাইলে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। সেখানে বিজ্ঞানের সুত্রের কোনো প্রয়োজন হয় না। কেননা ইসলাম বিজ্ঞানের গবেষণার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং বিজ্ঞান ইসলামের গবেষণার উপর নির্ভর করে চলে৷ তাই এই ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকতো তবে তা নিঃসন্দেহে একটি বিস্ময়কর অনুপ্রেরণা মূলক ঘটনা হতো। কিন্তু ব্যক্তি যখন ঘটনা নিজেই অস্বীকার করে তখন এর কোন গুরুত্বের প্রশ্নেই আসে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার কথা তিনি নিজেই অস্বীকার করেছেন। তাহলে এই ঘটনার উৎস কোথায়? মূলত এটা ছিল ইহুদি বা খ্রিষ্টানদের একটি সুক্ষ্ম চালাকি বলেই আমি মনে করি। এই ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে তারা সমগ্র মানবজাতিকে একটি ধোঁকা দেওয়ার প্রচেষ্টা করেছে হয়তো। ফলে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে কিছু ইসলামি দা’ইরাও ভুল করে নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহন করার গল্প প্রচার করেছিল। এটা আমাদের এখন মেনে নিতেই হবে।
কিন্তু এই ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা হয়তো ভুলে গেছে ইসলাম একটি বিজ্ঞান সম্পন্ন, আদর্শ, সহিহ বানী ও বিশুদ্ধ তথ্য নির্ভর একটি জীবন ব্যবস্থা। এখানে মিথ্যার কোনো আশ্রয় নেই। আর এটা স্পষ্টত যে, ইসলামের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য কোনো কল্পিত মিথ্যা কাহিনী উল্লেখ করার বিন্দু মাত্র গুরুত্ব বা প্রয়োজন নেই।
তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহন ও কথিত ঘটনা নিজেই অস্বীকার করেছিলেন। তবে নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অনেক প্রশংসামূলক বক্তব্য রয়েছে।যেমন-
শেখ জিন্দনির বর্ননায় পাওয়া যায়, নিল আর্মস্ট্রং পবিত্র কোরআনের বিস্ময়ক বিজ্ঞান সম্পর্কে বলেন, “আল কোরআনের তথ্যের সাথে আধুনিক জোতিশাস্ত্রের কি অসাধারণ মিল রয়েছে। কি অবাক লাগে উভয়ের সাথে কোনো গড়মিল নেই, নেই কোনো সংঘর্ষ। কি চমৎকার মিল প্রাচীন এই গ্রন্থ ও আধুনিক বিজ্ঞানের মাঝে!”
আমরা নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার গল্প সহিহ তথ্য প্রমান ছাড়া বিশ্বাস করতে পারি না। তবে ইসলাম সম্পর্কে তাঁর এতো সুন্দর ও মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অবশ্যই প্রসংশা ও ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কপালে হেদায়েত নসিব হয়নি। অথবা সে জেনেশুনেই সত্যকে গোপন করেছে।
[০১] নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার গল্পটা ভুুুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। তিনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আমরা এটা বলতে দিধাবোধ করছি না। একজন বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে তার সম্মান রয়েছে। কিন্তু তার নামে মিথ্যা গল্প রচনা করে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করার সামান্য চেষ্টা করার কোনো যৌক্তিকতা বা ভিক্তি নেই।
একটা কথা চিন্তা করুন, এতো বড় একজন বিজ্ঞানী ও নভোচারী ইসলাম ধর্মগ্রহণ করলো অথচ পৃথিবীর কোনো মুসলিম দেশ তার সংবাদ প্রচার করলো না৷ এমনকি কোনো আলেম, ইসলামি স্কলার বা কোন ইসলামি দা’ইর সাথেও এ বিষয়ে তার বিশেষ কোন সাক্ষাৎকার প্রচার হয়নি। কি আশ্চর্য!!
ছবিঃ ডা. মরিস বুকাইলি এবং ইউসুফ ইসলাম
[০২] অথচ ডা.মরিস বুকাইলি কথা আপনারা সবাই হয়তো শুনে থাকবেন। ইসলাম ধর্মগ্রহণের পর তাঁর লেখা বই পর্যন্ত অনেক আলোরণ সৃষ্টি করেছে এবং বর্তমানে তার পরিচিতি বিশ্বব্যপী। তেমনি স্টিভ এ্যাডামাস ইংরেজ জনপ্রিয় গায়ক, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর নাম রাখেন ইউসুফ ইসলাম। তাকে নিয়ে টিভি, রেডিও ও ইসলামি অনেক সাক্ষাৎকার দেখতে পাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের সাথেও তিনি দেখা করেন।
অর্থাৎ বিখ্যাত ব্যক্তিরা ধর্মান্তরিত বা আশ্চর্য কোনো ঘটনার সম্মুখীন হলে তা মিডিয়ায় ভাইরাল হতে সামান্যতম অপেক্ষা করতে হয় না। মুহূর্তেই তা পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যম বা পত্রিকায় তা প্রচার হয়ে যায়।
তাহলে একটু ভাবুন, নিল আর্মস্ট্রং এতো বড় বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়া সত্যেও তাকে নিয়ে এরকম কোনো সাক্ষাৎকার বা প্রোগ্রাম অথবা গণমাধ্যমে কেন প্রচার হয়নি? কারণ তার ইসলাম ধর্মগ্রহনের কোনো স্পষ্ট তথ্য বা প্রমান নেই। বরং বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার ঘটনাকে তিনি নিজেই মিথ্যা ও ভিক্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। ২০০৫ সালে মালয়েশিয়ার একটি কনফারেন্সে তিনি তার সম্পর্কে এই মিথ্যা ঘটনাকে গুজব বলেই উড়িয়ে দেন।
আর ইসলাম ধর্মে সহিহ দলিল ব্যতিত কোনো তথ্য কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। মিথ্যা অথবা জাল তথ্য হিসেবে তা বাতিল বলে গন্য হবে। এমন কি প্রিয় রাসূল (সাঃ) কোনো হাদিসও যদি সহিহ দলিল দ্বারা প্রমানিত না হয় তবে তাও বাতিল। এটাই ইসলামি শরীয়া ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা।
সুতরাং নিল আর্মস্ট্রং-এর ইসলামগ্রহণ করার নামে উক্ত মিথ্যা গল্পের ইসলামে কোনো ভিক্তি নেই। বরং সাধারণ মুসলিম ভাইদের অন্ধ বিশ্বাসের কারণে অমুসলিম ভাইয়েরা ইসলামের নামে মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যম পেয়ে যাচ্ছে। তাই দ্বীনকে ভালো করে জানার চেষ্টা করুন, অন্ধবিশ্বাস পরিহার করে বাস্তবতা ও সহিহ দলিলের আলোকে ইসলামের দীপ্তবানী নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে। মহান আল্লাহর তৌফিক দান করুক। আমিন।
তারপরও বলতে চাই- প্রকৃত সত্য মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন