ফ্রিল্যান্সিং কেন করবো! এটা আমার জন্য সঠিক! ফ্রিল্যান্সিং করা না করার সিদ্ধান্ত নিতে এমন দোটানায় পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। ফ্রিল্যান্সিংকে পার্ট-টাইম নাকি ফুল-টাইম পেশা হিসেবে গ্রহন করবেন! চলুন ফ্রিল্যান্সিংয়ের আদ্যন্ত ধারনা নেয়া যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে দায়, জবাবদিহিতা এবং বন্ধনমুক্ত, স্ব-নিযুক্ত একটি স্বাধীন পেশা। জ্ঞান ও দক্ষতা বিনিয়োগ করে একজন ফ্রিল্যান্সার চুক্তির ভিত্তিতে কর্মঘণ্টা হিসেবে তার ক্লায়েন্টের কাজ করে থাকে। যেখানে ৯টা -৫ টা অফিসের মত বাধা ধরা নিয়মের বালাই নেই। মজার বিষয় ফ্রিল্যান্সার গাড়িতে, বাড়িতে এমনকি ভ্রমণের জায়গায় বসেও কাজ করতে পারে। প্রশিক্ষণ, জ্ঞান, সৃষ্টিশীল ধারণা, সৃজনশীলতা, অভিজ্ঞতা, উপস্থাপনার কৌশলের উপর নির্ভর করে একজন ফ্রিল্যান্সারের ক্যারিয়ার।
ফ্রিল্যান্সিং একটি স্বাধীন পেশা। পেশা উপভোগের সাথে ফ্রিল্যান্সার এর আবেগ জড়িত। তারা যা করতে পছন্দ করে এবং যে বিষয়ে দক্ষ সেটা বিনিয়োগ করেই অর্থ উপার্জন এবং ক্যারিয়ার গড়তে পারবে। সর্বক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্নাঙ্গ ক্ষমতা থাকায় একজন ফ্রিল্যান্সার নিজেই নিজের বস।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের নমনীয়তা বড় সুবিধা। দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো ক্লায়েন্টের কাজ করা সুযোগ রয়েছে। আমাজন, আলি-এক্সপ্রেসের মত বিশ্বব্যাপী মার্কেটপ্লেসে কাজ করা যায় অফিস বা দোকান ছাড়া।
ঘন্টাপ্রতি কাজের চার্জ নির্ধারণ করার সুযোগ থাকছে। যাতায়াত খরচ এবং লাঞ্চ আউটের প্রয়োজন নেই। টিপটপ অফিস পোশাকের বাধ্যবাধকতা নেই। সবশেষে কর্ম-জীবনের ভারসাম্য রাখা যায়।
ফ্রিল্যান্সিং পেশা অনন্য কারন এটি অফিস বা ডেস্ক কাজের মতো নয়। আপনার ঘর, বারান্দা এমনকি বাগান হয়ে উঠতে পারে আপনার কাজের জায়গা। যেখানে আপনি সাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় বা কর্মঘণ্টা হয় না। ফ্রিল্যান্সাররা নিজেদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী যত ঘন্টা কাজ করতে পারে ততটাই কাজের সময় । তবে সব প্রজেক্টে ক্লায়েন্টের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে সময় নির্ধারণের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়।
অধিক সময় কম্পিউটারে ব্যয় করা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য রয়েছে অসংখ্য পদ। যেমনঃ
উপরের যেকোনো একটি টপিকের উপর আপনার আগ্রহ থাকলে প্রশিক্ষণের দ্বারা নিজেকে আরো দক্ষ ও সমৃদ্ধ করে ঢুকে পরতে পারবেন ফাইভার, আপওয়ার্কের মত অসংখ্য প্লাটফর্মে। এত অপশনের মাঝে ফ্রিল্যান্সিং করা না করার সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার। আপনার কাজের ক্ষেত্রে পার্মানেন্ট ক্লায়েন্ট তৈরি করতে পারলে এগিয়ে যাবেন বহুদূর।
নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট এবং একটা কোয়ালিটিফুল ডেস্কটপ ম্যানেজ করা ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রথম পদক্ষেপ। এছাড়াও শুরুর দিকে ফ্রিল্যান্সারদের সফটওয়্যার, ডোমেইন, হোস্টিং, থিম, প্লাগইন, অফিস সরঞ্জাম, পোর্টফলিও ওয়েবসাইট ইত্যাদিতে নগদ বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হবে। একজন ফুল-টাইম ফ্রিল্যান্সারের জন্য একটি পোর্টফোলিও আবশ্যক।
প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কিছু বাদ দেয়া গেলেও প্রফেশনাল ফ্রিল্যান্সার হতে এগুলোর সবই প্রয়োজন হবে। যার জন্য অর্থ সঞ্চয় করা অপরিহার্য।
ফ্রিল্যান্সিং করা না করার সিদ্ধান্তে উপার্জনের বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। আত্মমুখী কার্যকলাপ এবং স্ব-নিযুক্ত পেশা হওয়ায় ফ্রিল্যান্সারদের আয় নিশ্চিত নয়। ব্যক্তিভেদে উপার্জন ভিন্ন হতে পারে। মাসিক আয় সমহারে হয় না। উপার্জন নির্ভর করে কাজের লোড নেয়ার ক্ষমতা, দক্ষতা, উপস্থাপনা এবং কর্মঘণ্টার উপর।
শুরুর দিকে এটা অসুবিধা বলে গন্য হলেও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পেলে আয় পরিবর্তনশীল। কোনো মাসে $৪০০ ডলার আবার পরের মাসে $১০০ ডলার হতে পারে। ফ্রিল্যান্সারদের জীবনে আয়ের পরিবর্তন নিত্যদিনের ঘটনা। দীর্ঘ সময় লেগে থাকা, কাজের মান এবং ক্লায়েন্ট পরিচালনা করার দক্ষতা ফ্রিল্যান্সারের উপার্জিত অর্থের অঙ্ক বাড়াতে পারে।
অফলাইন এবং অনলাইন ক্লায়েন্টের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ফাইভার, আপওয়ার্ক এর মত অসংখ্য সাইট আছে যেখানে ক্লায়েন্টরা ফ্রিল্যান্সার নিয়োগের জন্য আসে। সেখানে সৎ এবং অসৎ যেকোনো ধরনের ক্লায়েন্টের সাথে আপনার সাক্ষাত হতে পারে।
তাই কাজ শুরুর আগে তাদের অতীতের নিয়োগ পোস্ট রেকর্ডস, পেমেন্ট রেকর্ডস, ক্লায়েন্টদের চাহিদা এবং প্রয়োজন যাচাই করা বাঞ্ছনীয়।
সব ক্লায়েন্ট বন্ধুত্বপূর্ণ হয় না। কিছু ক্লায়েন্ট অযাচিত প্রশ্ন করতে পছন্দ করে এবং খুতখুতে হয়। এদের প্রকল্প সময়মত জমা না দিতে পারলে বা উপস্থাপনা মন মত না হলে নেগেটিভ রিভিউ দিতে পারে। তাদের সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন চিহ্নিত করতে হবে। তাদেরকে পরিচালনা করার জন্য কমিউনিকেশন স্কিল বাড়াতে হবে।
কাজ পাওয়ার পর ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন হতে হবে এবং ক্রমাগত কাজের অগ্রগতির আপডেট দিতে হবে। নিয়মিত ই-মেল চেক এবং প্রতিউত্তর করতে দেরি করা যাবে না। পরিবর্তনের নির্দেশ থাকলে তা পালন করতে হবে। কাজের প্রতি সিরিয়াস এবং ক্লায়েন্টের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হলে ৫-স্টার রেটিং পেতে কোনো বাধা থাকবে না।
নেতিবাচকতা কাটিয়ে নিজেকে শক্তিশালী পেশাদার হিসেবে রুপান্তরিত করাটা সম্পূর্ণ একজন ফ্রিল্যান্সারের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল।
চাকরি প্রতি টান, ব্যবস্থাপকের অধীনে কাজের ইচ্ছে এবং প্রাথমিক উপার্জনের জন্য ফ্রিল্যান্সিং করতে চাইলে পার্ট-টাইম হিসেবে শুরু করাটা যুক্তিযুক্ত। ৯০% অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার বলবেন ফুল-টাইম করার আগে পার্ট-টাইম করা উচিৎ। কাজ সম্পর্কে ধারনা থাকা এবং নিজে অভিজ্ঞতা নেওয়া দুটি ভিন্ন জিনিস। কাজের মাধ্যমে শিখতে এবং কাজের গতি বাড়াতে চাইলে পার্ট-টাইম ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রবেশ করা অপরিহার্য। শুরুটা যত শক্তিশালী হবে পরবর্তী দিনগুলো ততটাই মসৃন হবে।
উদাহরনস্বরূপ: একজন পার্ট-টাইম ফ্রিল্যান্স রাইটার এর ক্যারিয়ার শুরু হয় ঘন্টাপ্রতি $১ বা $২ ডলারে ১০০০ শব্দ সাপ্লাই দিয়ে । শুরুর দিকে উপার্জন কম তবে খ্যাতির দিকে এগিয়ে যেতে শুরুটা এভাবেই হয়। হতাশ হবেন না। কয়েক মাস লেখার পর দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে প্রতি হাজার শব্দের জন্য $৫ থেকে $১০ ডলার চাইতে পারেন। এমনকি ইংরেজিতে পারদর্শী হলে এবং কোয়ালিটি ভালো হলে হাজার প্রতি $৩০ ডলার বা অধীক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
পরাধীন চাকরি এবং অফিসের তাড়াহুড়ো করতে না চাইলে এবং নিজেই নিজের বস হতে চাইলে ফুল-টাইম ফ্রিল্যান্সিং আপনার জন্য। শুরু থেকে খ্যাতি পর্যন্ত যেতে কি কি অসুবিধা হতে পারে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনি জেনে গেছেন। এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন সেগুলোর মোকাবেলা করার জন্য আপনি প্রস্তুত কিনা। যদি প্রস্তুত হন ফুল-টাইম ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে কিছু বিবেচ্য বিষয় রয়েছে যেমন:
বর্তমান পেশা ছাড়ার আগে কমপক্ষে ছয় মাসের ভরনপোষণের জন্য নগদ অর্থ সঞ্চয় করতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে ভালো এমাউন্ট আয় পর্যন্ত যেতে সর্বনিম্ন ৬-৭ মাসের জার্নি। খ্যাতি তৈরি করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। শুরুতেই উচ্চ আয়ের কাজ পাওয়া যাবে না। সেই দিনগুলোর দৈনন্দিন মুদি থেকে শুরু করে বীমা, ভাড়া, যাতায়াত, বিনোদন সবকিছুর জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়িয়ে চলতে হবে।
একই কাজের জন্য যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে আলোচনায় তাদের তুলনায় পারদর্শী হতে হবে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলতে হবে এবং পরিষেবা অফার করতে হবে। অর্থ সংক্রান্ত আলোচনা করতে কখনোই লজ্জাবোধ করা যাবে না। ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে কর্মঘণ্টার মূল্যহার বাড়াতে হবে, অন্যথায় চিরদিনই কম বেতনের চাকরিতে আটকে থাকতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে আত্মবিশ্বাস অহংকার বা অভদ্রতায় রূপ না নেয়। আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং ক্লায়েন্টদের সাথে বিনয়ী হতে হবে। কেননা তারাই আপনাকে অর্থ এবং নিখুঁত ৫-স্টার প্রদান করবে।
নিজের পছন্দ, আগ্রহ ও দক্ষতা চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত করা ফ্রিল্যান্সিং করা না করার সিদ্ধান্তে মূখ্য বিবেচ্য বিষয়। ক্লায়েন্টরা আপনাকে তখনই বেছে নেবে যখন আপনি সেরাদের একজন হবেন। ক্লায়েন্টকে উৎসাহিত করতে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা উপস্থাপনে প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে উন্নত কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যোগাযোগ এবং অনলাইনে বিচরণের সময় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বদা নিজেকে আপডেট রাখার বিকল্প নেই।
অনেকে মনে করেন ফ্রিল্যান্সিং হলো কম্পিউটারের সামনে বসা এবং অর্থ উপার্জন করা। আসলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আপনাকে অফিসের চেয়ে বেশি কাজ করতে হবে। তাই সময়কে সূচী অনুযায়ী কাজ, পরিবার, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ভাগ করতে হতে পারে।
আপনি ছাত্র হলে পার্ট-টাইম ফ্রিল্যান্সিং উপযুক্ত। পার্ট-টাইমে আপনি ছোট ছোট কাজ করার সুযোগ পাবেন। স্নাতক হলে ধীরে ধীরে ফুল-টাইম ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রবেশ করতে পারেন। ফুল-টাইমে দীর্ঘমেয়াদি বড় বড় প্রজেক্টে কাজ পাওয়ার চান্স থাকে। আপনি কত সময়ে কোন অবস্থানে যেতে চান বিজ্ঞতার সাথে তার লক্ষ্য ঠিক করুন যাতে পরে অনুশোচনা করতে না হয়।
শেষ পর্যন্ত, আপনি যদি মনে করেন যে ফ্রিল্যান্সিং আপনার জন্য, তবে চিহ্নিত করুন আপনার পছন্দের কাজের ক্ষেত্র। নিজেকে উৎসর্গ করে দিন ক্লায়েন্টের পরিষেবায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করলে কাজে গতি এবং শৃঙ্খলা আসে এবং একটা ভালো পরিণতি আশা করা যায়। আপনি আপনার স্বপ্নের কাছাকাছি, শুধুমাত্র উপলব্ধি করা বাকি।
Nice