“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
কাজী নজরুলের এই কালজয়ী বাণী সমাজে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এমনকি এই আধুনিক বিশ্বের অনেক মানুষ আজও এই কথাগুলোর সাথে পুরোপুরি একমত হয়ে উঠতে পারেনি।
অথচ নারী পুরুষের সমতার দাবি জানিয়ে আজ থেকে আরও বহু বছর আগেই কলম তুলে ধরেছিলেন এক অসামান্য নারী। যার অবদান এই উপমহাদেশের নারীদের জীবনে এনেছিল আমূল পরিবর্তন।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সেই অসাধারণ নারী। ৯ ডিসেম্বর তাঁর অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে পালন করা হয় রোকেয়া দিবস।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
রোকেয়া খাতুনের জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে, রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের ছিলেন সেখানকার জমিদার এবং বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। রোকেয়ার পূর্ব পুরুষেরা মোঘল আমলে সৈনিক ও বিচার বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে রোকেয়ার বেড়ে ওঠা। তাঁর দুই বোন এবং তিন ভাই ছিলেন, যাদের মধ্যে একজন শিশু বয়সে মারা যান। বাড়িতেই প্রাথমিক ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন রোকেয়া।
কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর ছিলো অসীম আগ্রহ। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং বোন কামরুন্নেসা খাতুন তাঁকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করেন। ইব্রাহিম সাবেরের তত্তাবধানে কামরুন্নেসা ও রোকেয়া বাংলা এবং ইংরেজি শেখেন।
১৮ বছর বয়সে ১৮৯৮ সালে রোকেয়ার বিয়ে হয় ৩৮ বছর বয়সী বিপত্নীক খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। সাখাওয়াত হোসেন ভাগলপুরের ঊর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
ইংল্যান্ডে কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও সাখাওয়াত হোসেন Royal Agriculture Society of England এর সদস্য ছিলেন। বিয়ের পর রোকেয়ার নতুন পরিচয় হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত নামে।
স্বামীর উৎসাহে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে সমানভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এমনকি সাখাওয়াত হোসেনের আগ্রহ ও উৎসাহেই বেগম রোকেয়া সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ করেছিলেন। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন।
নারীর দুঃখ দুর্দশা ও সমান অধিকারের দাবী বেগম রোকেয়ার সাহিত্যে তীব্রভাবে ফুটে উঠতো। ১৯০২ সালে প্রথমবারের মতো বাংলায় তাঁর রচিত প্রবন্ধ “পিপাসা” প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৫ এ প্রকাশিত হয় “মতিচুর”। দুই খন্ডে প্রকাশিত এ প্রবন্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায় নারীদের নিয়ে তাঁর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে তাঁর রচিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী Sultana’s Dream প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসিকাটিতে তিনি দেখিয়েছেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার এক বিপরীত চিত্র। সে সমাজে তখনকার পুরুষদের ভূমিকায় ছিলেন নারীরা।
বেগম রোকেয়া রচিত উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে Sultana’s Dream অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সওগাত, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, নওরোজ, The Mussalman, Indian Ladies Magazine ও আরও নানান পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর রচনা প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি বিভিন্ন সময়ে মিসেস আর এস হোসেন নাম ব্যবহার করেও লিখতেন।
পিপাসা, মতিচুর, Sultana’s Dream, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, নারীর অধিকার, বলিগর্ত, God Gives Man Robs, Education Ideals for the modern Indian Girl.
বেগম রোকেয়া কেবল কলম দিয়েই নারীদের অগ্রগতিতে অবদান রাখেননি। তিনি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিয়েও নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর ৫ মাস পরে ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিলো Shakhawat Memorial Girl’s High School.
বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো মাত্র ৫জন ছাত্রী নিয়ে। কিন্তু সাখাওয়াত হোসেনের পরিবারের চাপে তাঁকে বিদ্যালয়টি সরিয়ে আনতে হয়। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে তিনি কলকাতায় বিদ্যালয়টি চালু করেন। সেসময় মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই শোচনীয় ছিলো। অভিভাবকরা মেয়েদের শিক্ষিত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেন না।
বেগম রোকেয়া তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। মেয়েদের বাবা মাকে বোঝাতেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু। ২৪ বছর যাবত বেগম রোকেয়া এই বিদ্যালয় পরিচালনা করেছিলেন।
এছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারী সহযোগীতা সংস্থা আঞ্জুমানে-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিলো বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সম্মেলনের আয়োজন করা। এসব কর্মসূচীতে আলোচিত হতো নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কথা, নারী পুরুষের সমতার কথা।
হৃদরোগ জনিত কারণে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, নিজের ৫২তম জন্মদিনের এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের সোদপুরের পানিহাটি গ্রামে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালন করা হয় “বেগম রোকেয়া দিবস”। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটিতে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক নানান কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়।
এছাড়াও সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এবং বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নারীদেরকে “রোকেয়া পদক” দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে Begum Rokeya Memorial Center, রয়েছে রোকেয়া সরণি। বেগম রোকেয়ার পৈতৃক নিবাস রংপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের জীবনে এক অসামান্য পরিবর্তনের সূচনা করে দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সাহিত্য অঙ্গনেও নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়েছেন তিনি। নারী জাগরণের অগ্রদূত ও মানবমুক্তির অগ্নিশিখা এই মহিয়সী নারীর ১৪০তম জন্মদিবস এবং একইসাথে ৮৮তম প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
মন্তব্য লিখুন