জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়ে কিংবা ফিনল্যান্ড, আমেরিকা বা চায়না এসব উন্নত দেশে হাইস্পিড ট্রেন বা টানেল যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সহজলভ্য হলেও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই অভাব পূরণ করতে যাচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার “কর্ণফুলী টানেল” প্রথম আন্ডারওয়ার্ল্ড টানেল। ভারতে স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থায় টানেল থাকলেও নদীর নিচে টানেল নির্মাণ সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম।
বাংলাদেশ নদী মাতৃকদেশ। এদেশের বুকে ছড়িয়ে আছে হাজারো নদী। আর এই নদীগুলোকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নগর, বন্দর কিংবা শহর। তেমন এক নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর। এটি কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। আর এই কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভগে ভাগ করেছে। এক তীরে শহর ও বন্দর নগরী ও অন্য তীরে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা।
এই নদীর উপর দিয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও, এখানে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই আছে। যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে তার তুলনায় তিনটি ব্রিজ অপ্রতুল। আর নতুন করে কোনো ব্রিজ কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। কারণ নদীর মরফোলজিকাল দিক অনুযায়ী, নদীর তলদেশে পলি জমা হওয়া এক বিরাট সমস্যা এবং তা চট্টগ্রাম বন্দর এর জন্য বিরাট হুমকি স্বরুপ। তাই এর বিকল্প পথ তৈরি করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চট্টগ্রামে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। চট্টগ্রামের লাল দিঘির মাঠে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশের জন্য এটা প্রায় অসম্ভব ভেবে জনসাধারণ মনে করে এটা শুধুই জনসভার প্রতিশ্রুতি।
সমীক্ষা ও যাচাই এর কাজ চললেও প্রতিশ্রুতি নিয়ে সঙ্কা দূর হয় নি চট্টগ্রামবাসীর। তবে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চিনের প্রসিডেন্ট শি চিন ফিং প্রকল্পের উদ্ভোদন করলে সকলের মুখে হাসি ফুটে। দূর হয়ে যায় সকল ধরনের সঙ্কা।শুরু হয়ে যায় জমি অধিগ্রহণের কাজ এবং অর্থ পাশ করাতে যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকু সময় এর পর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
টানেল প্রযুক্তিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারের একটি স্বপ্ন ছিলো। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে শুরু করে ২০১৭ সালে। বিশ্ব বানিজ্য বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু চায়নার আগ্রহ ও প্রযুক্তিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটে তৈরি হওয়া এই প্রকল্পে ৭০% বেশি অর্থ দিচ্ছে চিন।
বাকি অংশের অর্থের সহায়তা আসবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে নদীর দুই পাশের প্রায় ৩৮১ একর জমির প্রয়োজন ছিলো। সরকারের সহায়তায় খুব সজজেই সেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরপর স্থানীয়দের জন্য পুর্নবাসন ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল বোরিং এর কাজ উদ্ভোদন করেন।এই কাজটি পেয়েছেন China Comunication Construction Company (CCCC) লিমিটেড। এই কোম্পানিটি চায়নাতে এমন অসংখ্য কানেস্ট্রেকশনের কাজ করেছে।
কর্ণফুলী নদীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের নদীর তলদেশে ২৪৫০ মিটার লম্বা টানেল স্থাপন করা হবে। সংযোগ সড়ক থেকে নদীর তলদেশে প্রায় ৪২.৮ মিটার গভীরতায় নির্মাণ করা হবে সব ধরনের যান চলাচল করার মতো সড়ক। এই গভীরতায় একটি ১৪ তলা বিল্ডিং অনায়াসেই ডুবে যাবে। সাধারণত এটি একটি টানেল ভাবলেও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মূলত দুটি টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। একটি ব্যবহৃত হবে যাওয়ার কাজে,অন্যটি আসার কাজে।
প্রতি টানেলে রয়েছে দুই লেন বিশিষ্ট যোগাযোগ ব্যাবস্থা। দুই টানেলে মোট চার লেনের যোগাযোগ ব্যাবস্থা তৈরি হচ্ছে। টানেলের বাইরের অংশের উচ্চতা হবে ১০.৮মিটার।এবং ভিতরের অংশের উচ্চতা ৪.৯ মিটার।
এই খনন কাজের জন্য চায়না থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে বিশাল এক টানেল বোরিং মেশিন। বিশাল আকারের এই টানেল বোরিং মেশিনগুলা আমাদের কল্পনার চেয়েও বহুগুণ বড়। আয়তন ও খনন কাজের প্রয়োজনে ব্যবহৃত এক একটি মেশিন ৮০ থেকে ১৩০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। মেশিনের যে অংশটি খননের কাজে ব্যবহৃত হয় সেটির দৈর্ঘ্য ৫১ মিটার লম্বা।
বিশাল আকার এই মেশিনটির ওজন সাড়ে চার হাজার টনের বেশি । মাটির নিচে খনন কাজের জন্য ব্যবহৃত এই দৈতাকৃতির মেশিনটি দামের দিক থেকে ও কম নয়। গড়ে ১০- ১৮ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত এর দাম হয়ে থাকে এক একটি টানেল বোটিং মেশিনের।
এই মেশিনটি শুধু খনন কাজই সম্পন্ন করে না, এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত সকল কাজ ই সম্পন্ন করে। মেশিনটির মাধ্যমেই সংক্রিয়ভাবে সেগমেন্টগুলা যুক্ত করে, রিং তৈরি করা হচ্ছে প্রকল্পের। একটি রিং সম্পন্ন করা হলে প্রায় দুই মিটার টানেল তৈরি হয়ে যায়।
এভাবে ১৯৬১৬টি সেগমেন্ট এর মাধ্যমে ২৪৫২ টি রিং তৈরি করা হচ্ছে। যেই রিংগুলার মাধ্যমে ২৪৫০ মিটার টানেল তৈরি হবে। বিশাল এই সেগমেন্ট গুলা তৈরি হচ্ছে চায়নার জিংজিয়াং ফ্যাক্টরিতে। এর মধ্যে ১২০০০ সেগমেন্ট চট্টগ্রার এসে পৌঁছেছে।
কর্ণফুলী টানেলটি নদীর তলদেশে দুইটি টিউবের মাধ্যমে তৈরি হলেও এই দুটি টিউবের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে মোট তিনটি জায়গাতে। যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলে যাত্রীরা সহজেই অন্য টানেলে অবস্থান করতে পারে। এই পুরা টানেল জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ফারার এক্সট্রেইনার মেশিন। ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ এবং অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা ও রয়েছে।টানেলটিতে এত শক্তিশালী করে তৈরি করা হচ্ছে যাতে করে এটা দিয়ে সব রকমের ভারী যান চলাচল করতে পারে।
টানেলটি সরাসরি যুক্ত হয়ে যাবে ঢাকা -চট্টগ্রাম -কক্সবাজার মহাসড়কের সাথে। এবং ভবিষ্যতে এটি এশিয়ান হাইওয়ের সাথেও যুক্ত হয়ে যাবে। কর্ণফুলী টানেল এখন আর কোনো রুপ কথার গল্প নয়। এটি এখন বাস্তব। আর তা সম্ভব হয়েছে শুধু মাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একাগ্র প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে।
টানেলের কাজ সম্পন্ন হলে চট্টগ্রামে বিদেশী বিনিয়োগ অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়াও কোরিয়ান ইকোনিমিক্স জোনে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা আরও কয়েক গুণ। কর্ণফুলী টানেল যেমন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করবে তেমনই যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। এখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ চাইনিস সিভিল ইঞ্জিয়ার এবং টেকনিশিয়ান অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে যাদের সাথে প্রতিটি পর্যায়ে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশী ইঞ্জনিয়াররা।
মূলত কর্ণফুলী টানেল বাংলদেশের প্রজেক্ট হলেও এর থেকে বড় ধরনের লভ্যাংশ পাবে চীন। অতীতে এমন বড় বড় টানেল খনন কাজের মেশিনগুলো বাজারজাত করেছে ইউরোপ ও আমেরিকার কোম্পানিগুলো। চায়না এই প্রথম বারের মতো এই কাজ পেয়েছে এবং তা বাংলাদেশে এই প্রোজেক্টের মাধ্যেমে । চায়না প্রথমবারের মতো তাদের এই টানেল বোরিং মেশিন বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করার সুযোগ পেয়েছে।
বিশেষ করে টানেল বোরিং মেশিন এর ক্ষেত্রে একচেটিয়া দাপট রয়েছে জার্মানির। তবে এই প্রথমরারের মতো ভাগ বসিয়েছে চায়না। ভারত, পাকিস্থান, নেপালসহ দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ই প্রথম মাটির নিচে টানেল বসানো উদ্যোগ নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করেছে।
এই কর্ণফুলী টানেল এর কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের শেষের দিকে। এই কাজ শেষ হলে চট্টগ্রামবাসীর জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এবং বাংলাদেশ প্রবেশ করবে যোগাযোগ ব্যবস্থাlর এক নতুন অধ্যায়ে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন